সামাজিক অস্থিরতা ও পরিবারের দায়
সামাজিক অস্থিরতা হঠাৎ করেই যেন প্রবলরূপ ধারণ করেছে। পারিবারিক সামাজিক অবক্ষয়জনিত একের পর বীভৎস ঘটনার সাক্ষী হয়েছে দেশ। হত্যা, ধর্ষণ, আত্মহননের মিছিলে বেরিয়ে পড়ছে সমাজের এবং নৈতিকতার বিপর্যয় এবং অধঃপতনের ভয়ানক চিত্র। প্রতিদিনই ঘটছে নানা নৃশংস ঘটনা।
আমরা ক্রমেই এক নিষ্ঠুর সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি যেখানে মানবিকতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দয়া, মমতা এসব শব্দের কোনো অস্তিত্বই নেই! তার জায়গা দখল করে নিয়েছে অনৈতিকতা, অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, জিঘাংসা, হিংসা, বিদ্বেষ কিংবা এ জাতীয় সব নেতিবাচক শব্দের কালো হাত।
ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের মাত্রা যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। শিশু থেকে বয়স্ক কোনো নারীই নিরাপদ নয় ধর্ষকদের থাবা থেকে। নারীরা যেন আজ কোথাও নিরাপদ নয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, গৃহবধূ এমনকি অবুঝ শিশুও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। প্রতিদিনের খবরের কাগজে এমন অনেক খবর আসে, যা দেখলে যে কোনো সভ্য মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়।
শুধু গত ২৮ ফেব্রুয়ারির কয়েকটি সংবাদের শিরোনাম পড়লে অতিসহজেই বুঝতে পারব সামাজিক অবক্ষয় কোন পর্যায় গিয়ে ঠেকেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় মাদকাসক্ত মেয়ের কাঁচির আঘাতে মা রহিমা বেগম (৫০) নিহত হয়েছেন। ছাগলে কাঁঠালের মুচি খাওয়ায় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় চাচা ভুট্টো মোল্লাকে (৪০) ফালা দিয়ে খুন করে ভাতিজা শফিকুল ইসলাম (২২)। মসজিদের ধান চুরি করা নিয়ে রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় কোব্বাস আলী (৬০) নামে এক বৃদ্ধকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পার্বতীপুর স্বামীর মিথ্যা অপবাদ সইতে না পেরে মা রতনা বেগম ৫ বছরের শিশু হাসিকে পুকুরে ছুড়ে ফেলে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রংপুরের বদরগঞ্জে গলাকেটে মেয়েকে হত্যার ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন মা নুরনাহার বেগম। গাইবান্ধায় কলেজছাত্রিকে কুপিয়ে হত্যা, মা গ্রেফতার। এমন ঘটনা হয়তো আরো অনেক থাকতে পারে।
গত বছরের শুরুতে বনানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। মাত্র কয়েকমাস আগে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণ, খাগড়াছড়িতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের এক প্রতিবন্ধী নারীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের এই ভয়াবহতা ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে।
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে সচেতন নাগরিক এমনকি জনসাধারণের মাঝে। ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পর বরগুনার রিফাত শরীফের হত্যাকাণ্ড বড় ধরনের আলোড়ন তুলেছে দেশে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার-শত শত লোকের সামনে রিফাতকে কুপিয়ে মারল সন্ত্রাসীরা, কেউ এগিয়ে এলো না তাকে বাঁচাতে। প্রাকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে আর আমরা দর্শকের ভূমিকা পালন করছি। মা-মেয়েকে দড়ি বেঁধে প্রকাশ্যে করা হয় নির্যাতন, ছেলে ধরার গুজবে প্রকাশ্যে এক নারীকে হত্যা করতেও আমরা দেখেছি, গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে টানা ৩২ দিন ধরে সেই পরিবারের সাথে নিষ্ঠুরতা করা হচ্ছে কিন্তু আশপাশের কেউ এগিয়ে না আসায় সহজেই উপলব্ধি করা যায় আমাদের অবস্থান কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।
আজ আমরা এতটাই অবক্ষয়ে জর্জরিত যে, বিবেকের যেন মৃত্যু ঘটেছে। যে দিকে তাকাই শুধু অস্থিরতা। মাত্র পৌনে এক ভরি স্বর্ণের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে হত্যা করা হয় পাঁচ ও ছয় বছর বয়সী দু’টি শিশুকে। এই শিশুহত্যার রহস্য উদঘাটনের মধ্যেই নরসিংদীতে ছয়, আট ও দশ বছর বয়সী তিন ভাই-বোনকে হত্যা করে আপন ভাই।
সমাজের অবস্থা দেখুন- অশান্তির জ্বালা মেটাতে মা অবুঝ শিশুকে শাড়ির সাথে বেঁধে ঝাঁপ দিচ্ছেন নদীতে। কুমিল্লায় দরজা আটকে এক গৃহবধূর হাত-পা বেঁধে গায়ে অকটেন ঢেলে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে পাষণ্ড স্বামীর বিরুদ্ধে। নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এক কলেজছাত্রীকে কুপিয়ে জখম করেছে এক বখাটে। স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় সাভারের সিরামিক্স বাজার এলাকায় গৃহবধূ ও তার স্বামীকে কুপিয়ে জখম করেছে বখাটেরা।
বর্তমানে যে সামাজিক ও পরিবেশগত অবস্থা তাতে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অশান্তি বাড়ছে। ফলে মানুষের মধ্যে চরম হতাশা কাজ করছে। আর এ হতাশা থেকে তার মধ্যে এক ধরনের আগ্রাসী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তির মধ্যে নেতিবাচক দিকগুলো ফুটে ওঠে। সে আত্মবিশ্বাসী হয় না। তার মধ্যে ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি কাজ করে। নৃশংস হয়ে ওঠে। এর ফলে ব্যক্তি নিজে যেমন অন্যকে ধ্বংস করতে চায়, অন্যদিকে সে নিজেও এর শিকার হয়। এ ক্ষেত্রে নারীরা নৃশংসতার শিকার হয় বেশি। মূলত আমরা প্রতিনিয়ত যেসব পৈশাচিক আর হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি তা আসলে সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। এসব আমাদের অবক্ষয় আর সামাজিক সঙ্কটের চিত্র। অনেক ক্ষেত্রেই সবার অজান্তে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও অসাম্য বিস্তার লাভ করেছে ভয়াবহ আকারে।
এছাড়া যুব সমাজ আজ মাদকে আসক্ত হয়ে দিকবিদিক ঘুরছে। আজ নগর থেকে শুরু করে নিবিড় পাড়াগাঁয়েও ছড়িয়ে পড়ছে মাদকের ছোবল। প্রযুক্তির অপব্যবহারে ফলে নিমেষে পাল্টে যাচ্ছে সমাজ। যুবসমাজ যেন আজ অস্থির আর তাই সমাজে বাড়ছে নানামুখী অস্থিরতা। নীতি আদর্শ এবং মূল্যবোধ যেন সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
আসলে লোভ, ন্যায়বিচার, বৈষম্য, নৈতিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদি অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে, ফলে আত্মহত্যা, ধর্ষণ ও হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা বেড়েই চলছে। পারিবারিক কলহ, যৌনাচার, অশ্লীলতা, ধর্ষণ, খুন, ইভটিজিং, অ্যাসিড-সন্ত্রাস, শিশু হত্যা, নির্যাতন, মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সামাজিক সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোয় ফাটল ধরছে, ঢুকে পড়ছে অবিশ্বাস। ফলে বাবা-মায়ের হাতে সন্তান বা বিপরীত, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক প্রেমিকা, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে, যা সমাজ অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ।
এসব সামাজিক অস্থিরতার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে যুবসমাজ। অথচ তারা একটি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। কোন জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যুবকদের ভূমিকা ব্যাপক। অথচ তারা আজ শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে হয়ে যাচ্ছে বখাটে, মদ্যপ, ধর্ষক ও সন্ত্রাসী। ইতিহাস ঐতিহ্য আর ক্রমবর্ধমান সভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে মানুষ তার আপন সত্তার কথা ভুলে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানান অপকর্মে। প্রশ্ন হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা এক ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ কী? বিশিষ্টজনদের মতে, সামাজিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিচারহীনতা ও প্রযুক্তির প্রসারের কারণে ঘটছে এ ধরনের ঘটনা। সাধারণত দেখা যায় উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেক সন্তানদের মধ্যে মাদকাসক্ত বেড়ে গেছে। পিতা-মাতাও জানতে পারেন না কখন তাদের সন্তানরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে।
এ ধরনের ঘটনা রোধে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যেমন আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে, তেমনি পারিবারিক সচেতনতাও বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক অনুশাসনের প্রতিও জোর দিতে হবে। সন্তানদের প্রতি যদি বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া যায় এবং তারা কী করছে, কোথায় সময় কাটাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখা হয় তাহলে হয়তো সামাজিক অপরাধের মাত্রা অনেকটাই কমে যাবে।
আবার মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, আকাশ সংস্কৃতির কুপ্রভাব, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও মাদকের কারণে মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। সহিংসতার বিকাশ ঘটছে। দেখা গেছে, যেসব নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটছে সেখানে খুনিরা হয়তো কখনও খুনি ছিল না। এ ক্ষেত্রে আকাশ সংস্কৃতি, প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব ও মাদকের বিস্তারের কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের জিঘাংসা ও মানসিক অস্থিরতা কাজ করে। এর ফলে ব্যক্তি গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং খুনের মতো জঘন্যতম কাজ করতেও পিছপা হয় না। কিন্তু এ ধরনের পৈশাচিকতা কখনও কাম্য হতে পারে না।
সর্বগ্রাসী সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। সেই সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের অনুশীলন, পরমত সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা আজ আমাদের সবার দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। যার শুরুটা হতে হবে গৃহাভ্যন্তর থেকেই।
শেষে এটাই বলবো, এসব ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই যথেষ্ট নয়। এসব নৃশংসতার বিরুদ্ধে সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ এগিয়ে আসতে হবে, গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ। বিশেষ করে সামাজিক অস্থিরতা ও অবক্ষয় থেকে মুক্তি পেতে পারিবারিক বন্ধন জোরদারের বিকল্প নেই এবং ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে।
এইচআর/জেআইএম