‘ছেলেকে দেখে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলেন মা’

মার্জিয়া লিপি
মার্জিয়া লিপি মার্জিয়া লিপি , লেখক, গবেষক
প্রকাশিত: ০৮:১৫ এএম, ০১ মার্চ ২০২১

সাধারণ শাশ্বত বাঙালি নারীর মতোই ছিলেন তমিজা খাতুন। খুব মানবিক ও দানশীল ছিলেন। মানুষকে আপ্যায়ন করতে পছন্দ করতেন। ছেলেমেয়েদের সব সময় ন্যায় আর সত্যের পথে চলার কথা বলতেন। এমনকি মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুল হামিদ জীবনের অনেক ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতেন বিচক্ষণ মা তমিজা খাতুনের সঙ্গে পরামর্শ করে।

যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু বিহারিদের ফেলে যাওয়া একটি বাড়ি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুল হামিদকে নিতে বলেন। বঙ্গবন্ধুকে সিদ্ধান্ত জানানোর পূর্বে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুল হামিদ মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চান। মা তমিজা খাতুন সন্তান মোঃ আবদুল হামিদকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, বাড়িটি বিহারিদের ফেলে যাওয়া। মা তখন ছেলেকে বলেন, “বাবা, তুমি এ বাড়ি নিবে না। তুমি বঙ্গবন্ধুকে বলবা, ‘আমি বাড়ি নিতে নিষেধ করেছি। অন্যের ফেলে যাওয়া বাড়ি যতই বড় হোক, ভালো হোক তা হবে আমাদের জন্য দীর্ঘশ্বাস আর অভিশাপের’।” কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার পাশাপাশি গ্রাম কামালপুর এবং ইসলামপুর। প্রকৃতির অপরূপ শোভন আবহ এখানকার জনপদে। বর্ষায় হাওরের চারদিকে দৃষ্টিজুড়ে পানিতে থইথই করে। শুকনা মৌসুমে পানি শুকিয়ে হাওরের উর্বর পলির জমিতে ধানের ক্ষেত সবুজ কার্পেটের মতো বিছিয়ে থাকে।

ইসলামপুরের প্রতাপশালী জোতদার মুন্সী আব্বাস উদ্দিনের চার সন্তানের মধ্যে সবার বড় তমিজা খাতুন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তাঁর। সে আমলে মিঠামইনে মেয়েদের শিক্ষার উপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক কোনো স্কুল ছিল না। তমিজা খাতুন আর তাঁর ছোট এক ভাই, দুই বোন মিলে বাড়িতে মৌলভী সাহেবের কাছে কোরআন শরিফ পড়তে শিখেন। পাশের গ্রাম কামালপুরের মো. তায়েব উদ্দিনের বিয়ে হয় ইসলামপুরের মুন্সী আব্বাস উদ্দিনের জ্যেষ্ঠ কন্যা তমিজা খাতুনের সঙ্গে। বিয়ের সময় তমিজা খাতুনের বয়স ছিল মাত্র ১০ কিংবা ১১। মো. তায়েব উদ্দিন এবং তমিজা খাতুনের চার পুত্র এবং এক কন্যা—আবদুল গনি, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, আছিয়া আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অধ্যক্ষ আবদুল হক।

তমিজা খাতুন সম্পর্কে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের স্মৃতিকথা

মা তমিজা খাতুন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও মেয়েদের শিক্ষায় খুব আগ্রহী ছিলেন। সর্বকনিষ্ঠ সন্তান আবদুল হক মায়ের নামে তমিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৪ সালে তমিজা খাতুন তাঁর স্বামী মো. তায়েব উদ্দিন এবং বাবা মুন্সী আব্বাস উদ্দিনের কাছ থেকে যা সম্পত্তি লাভ করেন তা স্কুল প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে দান করেন। সব সম্পত্তি স্কুলে দান করার পর একমাত্র মেয়ে আছিয়া খাতুন মাকে বলেন, ‘মা আমি তোমার একমাত্র মেয়ে, তুমি তো তোমার সবকিছুই স্কুলে দিয়ে দিলে; আমাকে তো তোমার কিছুই দিলে না।’ উত্তরে মা তমিজা খাতুন মেয়েকে বলেন, ‘তুমি তো আমার একমাত্র মেয়ে—তুমি একা, তোমার কোনো বোন নেই। তোমাকে কিছুই দিলাম না- এ কথা সত্য কিন্তু এখন স্কুলের শত শত মেয়ে তোমার বোন।’ অনেক বড় মনের অধিকারী ছিলেন তিনি। যতদিন বেঁচে ছিলেন সব সময় স্কুলের খোঁজ-খবর নিতেন।

মেয়েরা স্কুলে অনুপস্থিত থাকলে তাদের না আসার কারণ জানতে চাইতেন। সন্তানদের জীবনে মা তমিজা খাতুন ছিলেন সব ভালো কিছু করার প্রেরণার উৎস। তাঁকে জিজ্ঞেস না করে তাঁর ছেলেমেয়েরা কিছুই করতেন না, কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন না। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই ও আবদুল হক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে মেঘালয়ে যান বড় ভাই মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে। আবদুল হক চলে যান প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য আগরতলায়। মেঘালয়ের মিলিটারি একাডেমিতে এক মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই। গেরিলা যুদ্ধের জন্য নেওয়া প্রশিক্ষণের মূলনীতি ছিল ‘হিট অ্যান্ড রান’। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে সেজন্য প্রশিক্ষক তাঁদের নিজেদের বাঁচিয়ে রেখে যুদ্ধ করার কলাকৌশল শিখিয়েছিলেন। এলএমজি ও মর্টারের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ ছিল তাঁর। প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে মেঘালয়ের বালাটে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্পে অবস্থান করেছেন। কখনোবা সেখান থেকে দেশের ভেতরে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিয়েছেন আবদুল হাই। যুদ্ধের দিনগুলোতে বিস্ফোরক ব্যবহার করে ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংস করেছেন।

jagonews24

শিক্ষিত যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য প্রণোদনায় কাজ করতেন তিনি। ইউনিয়ন অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা ভাগ করে কাজ করেছেন যুদ্ধের দিনগুলোতে। বিশেষ দূত মারফত অগ্রিম খোঁজখবর নিতেন। এলাকার স্থানীয় জনগণও তাঁদের অগ্রিম বিভিন্ন সংবাদ পৌঁছে দিতেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় যুদ্ধকালীন সময়ের বিভিন্ন স্মৃতি উল্লেখ করেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই।

একাত্তরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্মৃতি তাঁর বাবা মো. তায়েব উদ্দিনকে নিয়ে। নভেম্বর মাসে মো. তায়েব উদ্দিন সেদিন বালাট ক্যাম্প থেকে দেশে ফিরে আসার জন্য রওনা দেন। বড় ভাই মোঃ আবদুল হামিদসহ আবদুল হাইও বাবাকে এগিয়ে দেয়ার জন্য রওনা করেন। পাঁচ-ছয় মাইলের পথ শেষে নৌকায় রওনা দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত না গিয়ে ফিরে আসেন আবদুল হাই। বাবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়া হয় না। মেঘালয় থেকে দেশে ফেরার সময় বাবা মো. তায়েব উদ্দিন ছেলে আবদুল হাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করেন। ভোরবেলায় নৌকা ছাড়ে মেঘালয় থেকে। বাবার সঙ্গে আর দেখা হয় না ছেলেদের জীবদ্দশায়। পথে রাজাকারের হাতে ধরা পড়ে এবং নির্যাতনের ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই তাঁর মৃত্যু হয়।

যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তমিজা খাতুনের সন্তানরা কেউ তেমন প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না। ১৯৭৬-এর পর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুল হামিদের জেলজীবন শুরু হয়। সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি থাকার পর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই মিঠামইনে ফিরে আসেন। সে সময় প্রায় ২০ বছর সময় মা তমিজা খাতুনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে তাঁর। মায়েরও তার প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা ছিল অনেক বেশি। তিনি কলেজে শিক্ষকতা করতেন সে সময়। পাশাপাশি কৃষিকাজ ও স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে পুনরায় রাজধানী ঢাকা শহরে ফিরে আসেন, স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পর। ‘মুক্তিযুদ্ধ শেষে মা তমিজা খাতুনের সঙ্গে যখন দেখা হয় সে সময়টা ছিল রাত ৮টা-৯টা। ডাক শুনে একটা হারিকেন হাতে নিয়ে ছেলেকে দেখে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলেন মা।’ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাইয়ের মতে, ‘মা তমিজা খাতুন ছিলেন একটা প্রতিষ্ঠানের মতো। তিনি তাঁর বাস্তবতা দিয়ে সন্তানদের বড় করতে ও প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন আমৃত্যু।’

ছেলে মোঃ আবদুল হামিদের আইয়ুববিরোধী রাজনীতি ছিল পাকিস্তান আমলে অন্যতম অপরাধ। সেজন্য সমগ্র পরিবারকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করতে এই মহীয়সী নারীকে জীবনভর সহ্য করতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতা। তবে প্রতিকূল অবস্থায় কিছুতেই দমে যাননি তিনি। সন্তান আর সংসারের জন্য নিজের জীবন তুচ্ছ মনে করেছেন। পরিবারের সবার ভরণ-পোষণ করতে গিয়ে নিজের দিকে তাকানোর সুযোগ পাননি সংগ্রামী নারী তমিজা খাতুন। ছেলের নির্বাচনের সময় শত শত মানুষের খাবারের তদারকি করতেন নিজের হাতে। বীর মুক্তিযোদ্ধা মহামান্য রাষ্ট্রপতি সন্তান মোঃ আবদুল হামিদকে সব সময়ই বলতেন, ‘তুমি জীবনে কিছু একটা হবা, আমার দোয়া আছে তোমার প্রতি।’ সন্তান মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুল হামিদের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জেল-জুলুম, হুলিয়া আর নির্যাতন শুরু হয় ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে। পরবর্তীতে ’৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ সালের ছয় দফা, ’৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, সর্বোপরি ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন আর ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন মোঃ আবদুল হামিদ এবং পাশে ছিলেন তাঁর দুই ভাই—আবদুল হাই এবং ও অধ্যক্ষ আবদুল হক। একাত্তরের আগস্ট মাসের প্রথম দিকে হাজি মো. তায়েব উদ্দিনের পরিবার তাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের সঙ্গে বালাটের ক্যাম্পে অবস্থান নেন।

মোঃ আবদুল হামিদের রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয় ১৯৫৯ সালে তৎকালীন ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করে। মোঃ আবদুল হামিদ ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ’৭১-এর মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কিশোরগঞ্জে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেন। ১৭ মার্চ কিশোরগঞ্জ শহরের রথখোলা মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ওইদিন সকালেই স্বাধীনতার ঘোষণা টেলিগ্রামে পেয়ে সর্বাত্মক মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মোঃ আবদুল হামিদ ভারতের আগরতলায় চলে যান। মেঘালয়ের টেকেরহাট, গুমাঘাট, পানছড়া, মৈলাম হয়ে বালাট পৌঁছেন তিনি ও সহযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ থেকে আগতদের জন্য ইয়ুথ রিসিপশন ক্যাম্প চালু করেন। মেঘালয়ে রিক্রুটিং ক্যাম্পের চেয়ারম্যান ও কিশোরগঞ্জ জেলার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (মুজিব বাহিনী) সাব-সেক্টর কমান্ডার পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বালাটে ‘যুবা অভ্যর্থনা ক্যাম্প’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর অপারেশন পরিচালনা করেন।

jagonews24

মুক্তিযুদ্ধের সময় মোঃ আবদুল হামিদের কামালপুর গ্রামের বাড়ি এবং শহীদ আব্দুল মজিদ ভূঁইয়ার ধোবাজোড়া গ্রামের বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি হিসেবে সুপরিচিত ছিল। ২৬ আগস্ট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় কামালপুরে হাজি মো. তায়েব উদ্দিনের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। একাত্তরে তাঁর পরিবারসহ অন্যান্য প্রায় সবাই বড় ছেলে চেয়ারম্যান আবদুল গনির শ্বশুরবাড়ি ঘাগড়া ইউনিয়নের ধোবাজোড়া গ্রামে আশ্রয় নেন। ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আবদুল গনির শ্বশুরবাড়ি আক্রমণ করে। তমিজা খাতুন ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে। সে সময় শুধুমাত্র বাড়িতে ছিলেন মা তমিজা খাতুন। পাশের বাড়ির চাচাতো দেবর ও একমাত্র মেয়ে আছিয়া আলম শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁকে দেখাশোনা করার জন্য চলে আসেন।

পরিবারের সব সদস্যকে অনিশ্চিত অবস্থায় সীমান্তের ওপারে মেঘালয়ে পাঠিয়ে নিজে শুধু চোখের পানি ফেলতেন। প্রায়ই জায়নামাজে বসে প্রার্থনা করতেন স্বামী-সন্তান-নাতিরা যেন নিরাপদে থাকে। লোকমুখে বিভিন্ন সময়ে বিপদের কথা শুনে কান্নাকাটি করতেন; তবে তাঁর বিশ্বাস ছিল ‘দেশ একদিন স্বাধীন হবে; স্বামী-সন্তান তাঁর কাছে ফিরে আসবে।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র এক মাস কয়েক দিন পূর্বে তমিজা খাতুনের জীবনে ঘটে যায় দুঃস্বপ্ন। নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে স্বামী হাজি মো. তায়েব উদ্দিন মেঘালয়ের বালাট ক্যাম্প থেকে ছেলেদের না জানিয়ে দেশে ফিরে আসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বাড়ি ফেরার পথে রাজাকাররা তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে এমনকি শীতের মধ্যে বৃদ্ধের পরণের কাপড় রেখে দেয়। রাজাকারদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে নৌকায় বাড়িতে ফেরার সময় বৃষ্টিতে ভিজে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। তিনি ১৪ নভেম্বর নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ মনোনীত জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) মহামান্য মোঃ আবদুল হামিদ। পরবর্তীতে ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সাতবার এমপি নির্বাচিত হন।

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে মোঃ আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন এবং কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৬-৭৮ সালে তৎকালীন সরকারের সময় তিনি কারারুদ্ধ হন।

মো. আবদুল হামিদ সপ্তম জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার এবং স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২৪ এপ্রিল ২০১৩ বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। মোঃ আবদুল হামিদ ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছেন।

নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে রাষ্ট্রপতি বলেন, রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময়ে আমাকেও গ্রেফতার করা হয়। আমি ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলাম। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমি কৃষকের সন্তান হয়ে রাষ্ট্রপতি হয়েছি। আমি সারা জীবন সততাকে হৃদয়ে ধারণ ও লালন করেছি। দীর্ঘ সময় রাজনীতি করতে গিয়ে জেল খেটেছি। মামলা-হুলিয়া, পরোয়ানা নিয়ে রাজনীতি করেছি। আদর্শের সঙ্গে কখনও বিশ্বাস ঘাতকতা করিনি। রাজনীতিতে সততা ও জনগণের এবং মায়ের দোয়া ছিল বলেই আজ আমি রাষ্ট্রপতি।’

মা তমিজা খাতুনের চলার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। ছেলে মোঃ আবদুল হামিদ কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। একাত্তরে রাজাকাররা তাঁদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়; মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে তাঁর তিন ছেলে এবং পরবর্তীতে পরিবারের অন্যান্য প্রায় সব সদস্য দেশ ছেড়ে ভারতের মেঘালয়ে আশ্রয় নেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই স্বামী হাজি মো. তায়েব উদ্দিনের মৃত্যু হয়। সন্তান আবদুল হামিদের রাজনৈতিক জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বদাই বাবা মো. তায়েব উদ্দিন পাশে থেকে উৎসাহ দিতেন।

হাজি মো. তায়েব উদ্দিনের মৃত্যুর পর নতুন করে জীবনযুদ্ধ শুরু হয় তমিজা খাতুনের জীবনে। আগুনে পুড়িয়ে ফেলা অবশিষ্ট টিন দিয়ে বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বসতবাড়ি পুনর্নির্মাণ করেন। হাজি মো. তায়েব উদ্দিনের অনুপস্থিতিতে ছেলেদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেন। জীবনে যেন তার ছেলেরা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেন সে চেষ্টা করেন আমৃত্যু।

পরিচয় :
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ
২নং সেক্টর মুক্তিযোদ্ধা, কিশোরগঞ্জ জেলার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (মুজিব বাহিনী) সাব-সেক্টর কমান্ডার, মেঘালয়ে রিক্রুটিং ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হিসেবে তৎকালীন সুনামগঞ্জ ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ১৩ জানুয়ারি এবং ২৬ মার্চ ২০১৮
সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান : বঙ্গভবন, রাষ্ট্রপতির বাসভবন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

মুক্তিযোদ্ধা প্রিন্সিপাল আবদুল হক ২নং সেক্টর মুক্তিযোদ্ধা
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : লালমাটিয়া ৫, ৭, ৯, ৯ মে ২০১৮

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই
২নং সেক্টর মুক্তিযোদ্ধা
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : পশ্চিম আগারগাঁও মে ২০১৮
কৃতজ্ঞতা : আছিয়া আলম, শামসুন্নাহার নেলী, ডরিন আজিজ

তথ্যসূত্র
‘একাত্তর মুক্তিযোদ্ধার মা’, মার্জিয়া লিপি, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ৪৬/১ হেমেন্দ্র দাস রোড, সূত্রাপুর, ঢাকা-১১০০।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

মা তমিজা খাতুনের চলার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। ছেলে মোঃ আবদুল হামিদ কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। একাত্তরে রাজাকাররা তাঁদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়; মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে তাঁর তিন ছেলে এবং পরবর্তীতে পরিবারের অন্যান্য প্রায় সব সদস্য দেশ ছেড়ে ভারতের মেঘালয়ে আশ্রয় নেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই স্বামী হাজি মো. তায়েব উদ্দিনের মৃত্যু হয়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।