এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চলে না

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:২০ এএম, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক আরেক শিক্ষককে নিয়ে কটূক্তি করছে, একজন আরেকজনকে চৌর্যবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত করছে। এসব আবার সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে।

সম্প্রতি সাংবাদিকতা বিভাগের সামিয়া রহমানসহ তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পর আরও একজন খ্যাতনামা শিক্ষকের বিষয়েও পত্রিকায় খবর এসেছে। এই চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এর আগেও নানা জনের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ শোনা গেছে। কিন্তু এবার হইচই যেন বেশ অন্যরকম।

বিষয়টা শুধু এমন নয় যে, সিন্ডিকেট শাস্তি দেওয়ায়ই বেশি আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে কদর্য শিক্ষক রাজনীতিও ছায়া ফেলছে। বিদ্বেষ আর বিভাজন যে শিক্ষক রাজনীতির আদর্শ এখন, সেখানে এটাই হয়তো নিয়তি। দেশের সবচেয়ে বড় এবং জাতির আশা-আকাঙক্ষার প্রতীক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এসব আলোচনা সবাইকে হতাশ করে। এখানে যারা পড়েছেন, এখনও পড়ছেন, এখানে যেসব শিক্ষক এখনও শিক্ষা ও জ্ঞানের চর্চায় নিবেদিত তাদের সবার জন্যই এমন সব খবর বেদনার। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বিদ্যা অর্জন করেছি, সাধ্যমতো সে বিদ্যা সমাজের জন্য কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছি, সে বিশ্ববিদ্যালয় আজ আমার কাছে এমনভাবে উপস্থিত হবে সেটা ভাবতে কষ্ট হয়।

প্রশ্ন হলো, এ অবস্থায় কী করে পৌঁছল এক স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান? অনেকেই বলবেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয় যে, সমাজের অধঃপতন তার গায়ে লাগবে না। কথায় যুক্তি আছে। তবে একথাও তো বলি যে, সঙ্কটের সময় বারবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই পথ দেখিয়েছে। তাহলে আজ কেন সে পথহারা হবে?

ছাত্র রাজনীতি নিয়ে যত আলোচনা করি ততটা হয় না এখানকার শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে। দলভিত্তিক রাজনীতির বাইরে এখন শাসক দল সমর্থিত শিক্ষক গ্রুপের ভেতর যে কত গ্রুপ সেটাও এক গবেষণার বিষয় হতে পারে। এখান থেকেই শুরু হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার সমস্যা। ‘প্রথম শ্রেণি পেলে শিক্ষক হওয়া যাবে’ – এই এক দর্শন পুরো সিস্টেমকে নষ্ট করেছে। এখন শিক্ষক নিয়োগ যতটা হয়, তার চেয়ে বেশি হয় ভোটার নিয়োগ। একবার শিক্ষক হয়ে গেলে আর কোনো ভাবনা নেই। গবেষণা, প্রশিক্ষণ ছাড়াই শুধু দলবাজি করে পদোন্নতি, পদ-পদবি পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিকে অযাচার বলা যায় কিনা সেটা শিক্ষকরা নিজেরাই ভেবে দেখতে পারেন।

উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য একজন থাকেন ঠিকই। তার ভূমিকা একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা। কিন্তু আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য শুধু প্রশাসনিক প্রধান নন, তিনি রাজনীতিরও প্রধান। তিনি শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগেরও কর্ণধার।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য নির্ভর করে শিক্ষকদের তৈরি পাঠ্যক্রমের ওপর। এটা ছাত্রদের কাছে ধর্মগ্রন্থের মতো। আমাদের এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সেই ব্রত কম। অনেকেই আছেন ক্লাস আর পরীক্ষা কার্যক্রমে নিয়মিত অংশ নেন না। কিন্তু তাদের কিছু বলা যায় না। এমন শিক্ষকের কথা শুনেছি একটি কোর্সে মাত্র তিনদিন ক্লাসে গেছেন এবং তাও পুরো সময় শ্রেণিকক্ষে থাকেননি। কোন ভালো পাবলিকেশন ছাড়া অধ্যাপক হয়েছেন, এমন সংখ্যা ভুরি ভুরি। শিক্ষকতার পাশাপাশি ব্যবসা বা অন্য জায়গায় ফুলটাইম চাকরি করছেন এমন নজিরও আছে।

শিক্ষকদের প্রধান কাজই হলো শিক্ষাদান। একজন আদর্শ এবং যথার্থ শিক্ষকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত তিনি কতখানি শিক্ষাদানের কাজটি করছেন। শিক্ষাদানের পেশার প্রতি তিনি কতটা দায়বদ্ধ, কতটা নিষ্ঠাবান, কতটা নিবেদিতপ্রাণ। এ কথা ঠিক যে, এই বিশ্বায়নের সময়ে ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু তারা সাথে নিয়ে যায় শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া কিছু নীতিনৈতিকতার শিক্ষাও। শিক্ষকের বিচ্যুতি যদি এমন নগ্নভাবে উন্মোচিত হয় তাহলে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

সমাজের অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের নৈতিক স্খলন মেনে নিতে পারলেও মানুষ শিক্ষকদেরটা মানতে চায় না। তাদের সন্মানের জায়গাটা এমনই। ক্লাসরুমই জ্ঞান অর্জনের একমাত্র স্থান নয়। শিক্ষকদের লেকচার শিক্ষার্থীদের বেদবাক্যের মতো পৌঁছে গেলেই চলে না। শ্রেণিকক্ষে ভালো পড়ানোর পাশাপাশি আদর্শ শিক্ষকের সংখ্যা কমে গেলে যে মস্ত বড় ক্ষতি হয় সেটা নিয়ে ভাবনা দরকার। শিক্ষকের কাছে আছে নৈতিকতার বৃহত্তর দাবি, যা অস্বীকার করার উপায় নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটেছে অনেক। কিন্তু মনোজগতের উন্নয়ন বেশি প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টরসহ অনেকের আচরণই শিক্ষকসুলভ নয়, এমন কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়। নির্মম শাসক হয়ে কিংবা শিক্ষক রাজনীতির গ্রুপ লিডার হয়ে শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখা যায় না।

সারাদেশেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ চলছে জটিল সমস্যার মধ্যে দিয়ে। তারই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা জটিল থেকে ক্রমশ জটিলতর হয়ে উঠছে। আমরা শুধু আশা করতে পারি এ অবস্থা থেকে মুক্তির একটা রাস্তা খুঁজে নেবেন আমাদের শিক্ষকরা।

এইচআর/ফারুক/এমএস

প্রথম শ্রেণি পেলে শিক্ষক হওয়া যাবে’ – এই এক দর্শন পুরো সিস্টেমকে নষ্ট করেছে। এখন শিক্ষক নিয়োগ যতটা হয়, তার চেয়ে বেশি হয় ভোটার নিয়োগ। একবার শিক্ষক হয়ে গেলে আর কোনো ভাবনা নেই। গবেষণা, প্রশিক্ষণ ছাড়াই শুধু দলবাজি করে পদোন্নতি, পদ-পদবি পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিকে অযাচার বলা যায় কিনা সেটা শিক্ষকরা নিজেরাই ভেবে দেখতে পারেন।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।