সংক্রমণ ঘটুক সংস্কৃতিচর্চার
ছেলেবেলায় ফিরে যাই আমি প্রতিদিনই। পথ চলতে, কাজের ফাঁকে ফেলে আসা মেঠোপথে একবার ফিরবই। সেখানে বর্ণিল চড়কি ঘোরে সারাক্ষণ। কী আনন্দ, কী আনন্দ। আকাশে-বাতাসে শুধু আনন্দরেণু উড়ে বেড়াত। আমরা বন্ধুরা, ভাইবোনরা সেই রেণুর পেছনে ছুটে বেড়াতাম। ফেব্রুয়ারি এলে সেই হারিয়ে যাওয়া আনন্দের ভেলা আবার ফিরে আসে। শুধু কি আনন্দ? ভেলায় ভেসে থাকে স্বপ্ন। ঘুমিয়ে, জেগে ফেব্রুয়ারিতে আমরা শহীদ মিনার তৈরির স্বপ্ন দেখতাম।
বাড়ির উঠোনে কিংবা গলির মোড়ে আমরা শহীদ মিনার বানাতাম। আল্পনা করতাম সড়কে, দেয়ালে। ঘরে ঘরে চলত রেওয়াজ। গান, আবৃত্তির। ২১ ফেব্রুয়ারির সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান। পুরো মহল্লা ঘিরে হৈ চৈ। ছোটবড় সবাই সেই উৎসবের অংশীদার। ধীরে ধীরে কর্মজীবনে ব্যস্ত হতে হতে একসময় দেখলাম, মহল্লা থেকে ওই উৎসব হারিয়ে যাচ্ছে। মার্চ, ফেব্রুয়ারি, বৈশাখ, ডিসেম্বর- কখন আসে কখন চলে যায়, টেরই পাই না। ধীরে ধীরে দেখলাম গলির মুখে ছেলেদের জটলা বাড়ছে। বদলে যাচ্ছে তাদের আচরণ, মুখের ভাষা।
একসময় পাড়ার মেয়েরাও এদের সঙ্গে যোগ দিতে থাকে। কানে আসে ধূমপান, মাদকের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। শুনি কেউ কারাগারে যাচ্ছে, কেউ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আহত বা নিহত হয়েছে খবর পাই। গলির আলো যেন নিভে যাচ্ছিল। অন্ধকার প্রকট হতে থাকে। আমি নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করি। আমি কি তবে অন্ধকার এড়িয়ে গা বাঁচিয়ে চলছি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই ওদের বলি আসো আমরা শহীদ দিবসের প্রভাতফেরির আয়োজন করি। ব্যস অন্ধকার ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেরাই ঝাঁপ দিল। দেয়ালে পথে আল্পনা হলো। মাটি, বাঁশ দিয়ে তৈরি হলো শহীদ মিনার।
সন্তানদের ওপর দায় না চাপিয়ে, নিজের কাজটি করা জরুরি। আমি এবং আমরা বন্ধুরা সেই কাজ করার জন্য নিজেদের তৈরি করতে থাকি। সন্তানদের জন্য খেলার জয়াগা প্রস্তুত করা। ওদের সংগঠন করতে শেখানো। যেকোনো প্রাকৃতিক ও মানবিক বিপর্যয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রণোদনা দেয়া। এই করোনাকালেই আমার তরুণ সহকর্মীরা যেভাবে বিপন্ন মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। ওই উদ্যোগের পর থেকে আমার সেই তরুণ বন্ধুরা একের পর এক নতুন স্বপ্ন ও উদ্যোগে ঝাঁপ দিচ্ছে।
মূলত ওদের প্রাণচাঞ্চল্য দেখেই, আমরা আবার পূর্বাচল নতুন শহরে শহীদ মিনার তৈরির স্বপ্ন দেখতে থাকি। দেখলাম তরুণদের পাশে দাঁড়াতে মানুষের অভাব নেই। নতুন স্বপ্নের কথা শোনে রাজউকের মতো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলো। বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানতো আছেই, ব্যক্তিগতভাবেই যে যার মতো করে ছুটে আসছেন। আমরা যেন সেই ছোটবেলায় ফিরে যাচ্ছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইট, বাঁশ, ফুল এনে শহীদ মিনার তৈরির ওই আনন্দে ফিরে যাচ্ছি।
আসলে আমাদের তরুণদের স্বপ্নের কাছে ফিরে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তরুণদের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে হলে, তাদের নিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করতে হবে পাড়া-মহল্লায়। যে মহল্লায় সংস্কৃতির চর্চা থাকবে। সেখানে মাদক ও সন্ত্রাস প্রবেশ করতে হবে। এখনকার নাগরিক জীবনে মহল্লার আগের সেই আদল অবশিষ্ট নেই আর। সকলে আমরা নিজ নিজ ক্রংক্রিটের খুপড়িতে মুখ লুকিয়ে থাকি।
মহল্লার কার কী হলো দূরে থাক, উল্টোদিকের খুপড়ির মানুষগুলো কারা, কেমন আছে তাই জানি না। এই বাস্তবতায়, অ্যাপার্ন্টমেন্ট ঘিরেও আমরা সম্মিলিত সংস্কৃতিচর্চা শুরু করতে পারি। কোথাও কোথাও শুরু হয়েছে। তবে সেই শুরুর বিস্তার প্রয়োজন। সংক্রমণ প্রয়োজন। তাহলেই দেখা যাবে সামাজিকভাবে আমরা যে রোগশোকে ভুগছি, তা থেকে মুক্তি পাব। না হলে অসুখটি ক্রণিক রোগে রূপ নিতে বাধ্য।
এইচআর/বিএ/এমএস