ফরেনসিকের হালচাল : যা হওয়া উচিত আর যা হচ্ছে

সম্প্রতি ফরেনসিকের ওপর আমার দুটি লেখা জাগো নিউজে প্রকাশিত হওয়ার পর যে অভাবনীয় সাড়া পেয়েছি তা আমাকে বিস্মিত করেছে। সেই লেখা প্রকাশের ফলে গত ২৩ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিষয়ের সিনিয়র অধ্যাপকরা মিলিত হয়েছিলেন। আমার লেখায় প্রকাশিত এবং উল্লেখিত ঘটনার সত্যতা সবাই মেনে নিয়েছেন।

সেই লেখার সূত্রে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এবং ভুক্তভোগী অনেকেই আমাকে তাদের কষ্ট নিগড়ে দিয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা প্রমাণ বিবর্জিত। পরীক্ষায় লেনদেন সংশ্লিষ্ট একজন, যে নিজেই ভুক্তভোগী, কীভাবে আদান প্রদান হয়েছে সব জানিয়েছেন অথচ প্রমাণ নেই বলে সে ঘটনা আমি প্রকাশ করতে পারছি না। অনেকেই সুস্থ মেডিকোলিগ্যাল সেবা প্রদানে ফরেনসিক বিভাগের যা করণীয় সে বিষয়ে আমাকে কলম ধরতে অনুরোধ জানিয়েছেন। সেই কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশের মেডিকোলিগ্যাল ব্যবস্থার রাজধানী, আমার সাবেক কর্মস্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে কি অরাজকতা চলছে এবং কী তার প্রতিকার তা নিয়ে কলম ধরলাম। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, মেডিকোলিগ্যাল সার্ভিসে সেবার যে ধারা আমি চালু করেছিলাম তার সাথে সাম্প্রতিক সুবিধা অসুবিধার কিছু সংযোজন এবং বিয়োজন করা হলে, এটিই হবে উপযুক্ত মেডিকোলিগ্যাল সেবা। এখন জানা যাক, কি ধারা আমি চালু করেছিলাম।

ঢামেকের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে যে ধারা আমার কর্মকালে চালু করেছিলাম : আমি যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছিলাম তখন অফিস শুরুর আগে মর্গে অবস্থান করে প্রতিটি লাশের সুরতহাল পড়ে এবং বাহ্যিক পরীক্ষার নোট নিজের খাতায় নিয়ে নিজ অফিসে ঢুকতাম। সবাইকে অফিসের নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হওয়া এবং হাজিরা বোর্ডে জানান দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। অফিস সময়ে বোর্ডের দিকে তাকালেই বোঝা যেত কে কোথায় কি কাজে ব্যস্ত।

শিক্ষাদান এবং ময়নাতদন্ত কাজে দুজন সহকারী অধ্যাপককে প্রধান করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাদের দেওয়া শিডিউল মতো আমাদের সবাইকে কাজ করতে হতো। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আমি কোনো দিন সেখানে হস্তক্ষেপ করিনি। শিক্ষাদানের শিডিউল না মানা ছিল ফরবিডেন বিষয়। ময়নাতদন্ত করার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট আমার টেবিলে চলে আসত। আমি আমার সাথে রাখা নিজ নোটের সাথে তা মিলিয়ে দেখতাম, গরমিল হলে ময়নাতদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করে নিজ হাতে কম্পিউটারে তুলে রাখতাম।

এজন্য একটি টেবিল প্রস্তুত করা ছিল, যেখানে দিনওয়ারি লেখা ছিল, কেস নম্বর, কবে লাশ এসেছে, কবে ময়নাতদন্ত হয়েছে, কবে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে, কে ময়নাতদন্তকারী, কোন থানার কেস, কে কবে প্রতিবেদন নিয়ে গেছে। এর একটি আপডেটেড হার্ড কপি আমার ব্যাগে রাখতাম। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সে সময় একবার ঢাকা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সভাপতিত্বে ঢাকা জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় সাভার থানার ওসি উন্মুক্তভাবে দেরিতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তির নালিশ জানালে সেই সভায় আমি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে কেস নম্বর জানতে চাই।

কেস নম্বর জানালে আমি আমার ব্যাগে থাকা নথি ঘেটে তৎক্ষণাৎ কবে লাশ এসেছে, কবে ময়নাতদন্ত হয়েছে, কবে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে, কে ময়নাতদন্ত করেছেন, সংশ্লিষ্ট থানার কে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে গেছেন তা জানিয়ে দিতে সক্ষম হই। সেই মিটিং থেকে ঢাকার একজন পুলিশ কর্মকর্তা সরাসরি থানায় কথা বলে আমার দেওয়া তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হলে উন্মুক্ত সভায় সেই কর্মকর্তা ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তবে আমি ঢামেকে যোগ দেওয়ার আগে যারা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট জমা না দিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেছিলেন তাদের দিয়ে সেই প্রতিবেদন তৈরি করাতে আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।

সে সময় কোনো প্রতিবেদন সময় মতো আমার টেবিলে না এলে প্রথমে মৌখিক এবং পরে লিখিত কৈফিয়ত তলব করা হোত। কেমিক্যাল রিপোর্টের অপেক্ষাকালীন সময়ে সাময়িক প্রতিবেদন দেওয়া হতো। মহাখালীর কেমিক্যাল ল্যাবে যোগাযোগ করে দ্রুত রিপোর্ট আনার ব্যবস্থা করা হতো। সে সময় ময়নাতদন্ত এবং ক্লাস সব প্রভাষকদের জন্য সমভাবে বণ্টন করা ছিল। তবে রেপ ভিকটিম পরীক্ষায় শুধু সিনিয়রদের রাখা হতো। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আমার জন্যও মাত্র একদিন ময়নাতদন্তের জন্য বরাদ্দ থাকতো; তবে প্রশাসনিক কাজের চাপে অনেক সময় কোন লেকচারারকে তা সামাল দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে হতো। ডিএফএম অধ্যায়নরত সব শিক্ষার্থীর লগবুক অনুযায়ী ময়নাতদন্ত করতে দেওয়া হতো রোস্টারে থাকা দায়িত্বপ্রাপ্তদের জিম্মায়।

বেসরকারি শিক্ষার্থীদের মূল বইতে লেখার অনুমতি ছিল না। সকালে প্রাপ্ত মৃতদেহ থেকে বাছাই করা দু-একটি কেসের ময়নাতদন্তের সময় আমি নিজে উপস্থিত থেকে ডিএফএম শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতাম। সপ্তাহের একদিন সম্ভবত প্রতি বুধবার সকালের বিভাগীয় সেমিনারে সবাইকে হাজির থাকতে হতো এবং সেমিনার শেষে সেই সপ্তাহের মেডিকোলিগ্যাল কেস নিয়ে শিক্ষণীয় উন্মুক্ত আলোচনা হতো। অন্যান্য মেডিকেল কলেজ (প্রাইভেট) থেকে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদানেও রোস্টার ছিল। কলেজ অধ্যক্ষের জ্ঞাতসারে সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থের ৫০ শতাংশ গবেষণা এবং বিভাগীয় আপ্যায়নের জন্য রেখে বাকি ৫০ শতাংশ সবার মাঝে বণ্টন করা হতো এবং এই হিসাব ছিল স্বচ্ছ এবং সবার জন্য উন্মুক্ত।

সে সময় বিভাগের বাইরে বিশাল আকারে টাঙিয়ে রেখেছিলাম অ্যাকাউন্টিবিলিটি আর ট্রানপারেন্সির পোস্টার, যা অফিসে ঢোকার সময় সবার নজরে পড়ত। মর্গে টাঙিয়ে ছিলাম কোনো অভিযোগ থাকলে বিভাগীয় প্রধানের সাথে যোগাযোগ করুন। বিভাগের সব কর্মকর্তাকে জানিয়ে রেখেছিলাম, অভিযোগ এলে যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে দর্শনার্থীর সাক্ষাৎকারের সময় দুপুর ১টা–২টা নির্ধারিত থাকলেও অনেক সময় তা মানা যেত না।

বর্তমানে ঢামেকের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে যে ধারা চলছে সেটি জানা যাক :
অভিযোগ রয়েছে বর্তমানে হাজিরা চলে নিজের খেয়াল খুশিমতো। আমার সময়ে প্রস্তুতকৃত হাজিরা বোর্ড হারিয়ে গেছে। ডিএফএম শিক্ষার্থীরা কোন রকম গাইড বা যথাযথ গাইড ছাড়া নিজেকে স্পেশালিস্ট হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ময়নাতদন্তকারীদের কোর্টে হাজির হওয়া তাদের কাজের অন্তর্ভুক্ত যা বাধ্যতামূলকও বটে। সপ্তাহে পাঁচদিন ময়নাতদন্তে সময় ব্যয় হলে কখন কোর্টে হাজির হয়, ডিএফএম শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান বা প্রশাসনিক কাজ করা হয় তা বোধগম্য নয়। ডিএফএম শিক্ষার্থীদের দ্বারা ময়নাতদন্ত করিয়ে অন্য কেউ যদি মূল প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেন তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সিআরপিসিতে বলা আছে ন্যূনতম সরকারি মেডিকেল অফিসার ছাড়া অন্য কেউ ময়নাতদন্ত করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে প্রাইভেট ডিএফএম শিক্ষার্থীরা কীভাবে ময়নাতদন্ত করেন তা বোধগম্য নয়। প্রাইভেট মেডিকেল থেকে প্রাপ্ত টাকা-পয়সার পরিষ্কার কোনো হিসাব নেই।

মনে রাখা প্রয়োজন, যে নেতা তাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়। এজন্য সফলতা আর ব্যর্থতার দায়ভার তার ওপরই বর্তায়। কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য কাউকে বসিয়ে দেওয়ার যে সংস্কৃতি চলমান তার কুফল স্টেকহোল্ডারদের ভোগ করতে হয়। আমার এই লেখা সমগ্র অব্যবস্থার বিরুদ্ধে তা সে যেখানেই হোক। আমি চাই, ভুল অনুধাবন করে সব মেডিকেল কলেজে মেডিকোলিগ্যাল সেবার একই নিয়ম চালু করা হোক।

এখনও সময় আছে, ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক পথে এগোনোর, মেডিকোলিগ্যাল সার্ভিসে সত্যিকারের সেবা প্রদানের। প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের আগেই মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটির ব্যানারে সিনিয়র অধ্যাপকরা যদি ব্যবস্থা নেন, আমি তাকে স্বাগতম জানাই। সঠিক তদন্তে দুষ্কর্ম করে কেউ কোনো দিন পার পেতে পারেনি বা পারবে না। শুধু মনে রাখতে হবে, লোকার্ড প্রিন্সিপালের সেই অলঙ্ঘনীয় তত্ত্ব। যেখানে বলা আছে, অপরাধী তার কুকর্মের ছাপ ঘটনাস্থলে রেখে যাবেই। সেক্ষেত্রে বাঁচার জন্য প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের তদবির অনেক ক্ষেত্রেই কোনো কাজে আসবে না।

লেখক : ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান। বর্তমানে অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন, ইউনিভার্সিটি টেকনোলোজি মারা মালয়েশিয়ায় কর্মরত।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

যে নেতা তাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়। এজন্য সফলতা আর ব্যর্থতার দায়ভার তার উপরেই বর্তায়। কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য কাউকে বসিয়ে দেওয়ার যে সংস্কৃতি চলমান তার কুফল স্টেক হোল্ডারদের ভোগ করতে হয়। আমার এই লেখা সমগ্র অব্যবস্থার বিরুদ্ধে তা সে যেখানেই হোক। আমি চাই, ভুল অনুধাবন করে সকল মেডিকেল কলেজে মেডিকোলিগাল সেবার একই নিয়ম চালু করা হোক।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।