ঘরের কথা পরের কাছে...
ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘর সামলাতে না পারলে পরকে সামলানো বেশ মুশকিল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই কথাটা বেশ গুরুত্বপুর্ণ। আশার কথা, দেশে এখন রাজনৈতিক কোনো অস্থিরতা নেই। ফলে বিরোধী দলকে সামলানোর তেমন কোনো চাপও নেই সরকারের কাছে। সে কারণেই কী সরকারি দল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে? গত কয়েক দিনে সরকারি দলের ভেতরেই যে ধরনের কথাবার্তা, অভিযোগ, ঈর্ষা, কটূক্তি চালাচালি হচ্ছে তা দেখে মনে হলো সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ ও সমালোচনা করার জন্য বিরোধী দলের প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে সরকারি দলের লোকজনই যথেষ্ট।
ঢাকা শহরের একটি রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানের সামনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন নানা পেশার কয়েকজন সাধারণ মানুষ। কেউ চা খাচ্ছে। কেউ অলস ভঙ্গিতে বেঞ্চির ওপর চুপচাপ বসে আছে। সবার নজর একজন বক্তার দিকে। মাঝ বয়সী ওই লোক চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, ‘ওই যে কথায় আছে না? ঘরের কথা পরে জানলো কেমনে? এমনে... তার কথা শুনে উপস্থিত সবাই সমর্থন সূচক হাততালি দিয়ে সমস্বরে বলল, হয় হয়... আপনে ঠিকই বলছেন। একদম খাঁটি কথা! ঘরের কথা পরে জানলো কেমনে? এই যে... এম নে?
সবাইকে থামিয়ে দিয়ে একজন বয়স্ক লোক বললেন, দ্যাশে তো বিরোধী দলের দরকার নাই। সরকারের লোকজনই তো দেখি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতেছে। তাকে থামিয়ে দিয়ে অন্য একজন বলল, আপনারা যাই বলেন না কেন ভাই, ওবায়দুল কাদেরের পরিবারকে রাজাকার পরিবার বলার সাহস বিরোধী দলের কারও হবে না। অভিযোগটা ভাবেন একবার? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পরিবার নাকি রাজাকার পরিবার। অভিযোগটা কে করেছে? আওয়ামী লীগেরই একজন নেতা করেছে। চিন্তা কইর্যা দ্যাখেন ষড়যন্ত্রটা কোন পর্যায়ে শুরু হইছে?
চায়ের দোকানের সামনের মিনি পার্লামেন্ট আরও সরব হয়ে উঠলো। অফিসে যাব বলে বাহন খুঁজছি। একজন রিকশাওয়ালা আগ্রহ দেখিয়ে রিকশা নিয়ে এলো! বলল, স্যার ওঠেন। রিকশায় যাচ্ছি। মনে হলো রিকশাওয়ালা আমাকে কিছু বলতে চায়। আমার ধারণাই সত্যি হলো। রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, স্যার ঘটনা যা শুনলাম সত্য নাকি?
অবাক হয়ে জানতে চাইলাম- কি শুনেছ?
ওবায়দুল কাদের সাবের বংশ নাকি রাজাকারের বংশ?
বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে বলেছে আপনাকে এই সব বাজে কথা?
রিকশাওয়ালা এতটুকু বিচলিত হলো না। বরং সবজান্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বলল, ফেসবুকে দেখছি স্যার। আপনি দেখবেন? আমার মোবাইল ফোনে আছে... বলেই সে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠল! তাকে থামিয়ে দিলাম।
নির্ধারিত গন্তব্যে এসে পড়েছি। রিকশাওয়ালা যাওয়ার সময় সাহস করে জিজ্ঞেস করলো, ঘটনাটা কি সত্য স্যার? আমরা তো জানি কাদের সাব একজন মুক্তিযোদ্ধা। অথচ তার পরিবারকে ‘রাজাকার পরিবার’ বলতেছে। তাও আবার নিজের দলের লোক কথাটা বলতেছে... আলামত কিন্তু ভালো না স্যার... বিরোধী দলের কেউ যদি এই কথা বলতো তাইলে তো স্যার এতক্ষণে জেল, জুলুম, হুলিয়া শুরু হইয়া যাইত! কি বলেন স্যার হইত না?
একবার মনে হলো রিকশাওয়ালাকে ধমক দিয়ে বলি, ভাই তোমার এত কথার দরকার কী? আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর নিতে চাচ্ছ? পরক্ষণেই মনে হলো, কথা তো মানুষ বলবেই। কেননা কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
কথা কি নিক্সন চৌধুরী শুরু করেছিলেন? নাকি আব্দুল কাদের মির্জা? দুই নেতার কাউকেই আমি সামনাসামনি দেখিনি। তবে নিক্সন চৌধুরীর আমি একজন ভক্ত। তরুণ রাজনীতিবিদ। সত্য বলতে ভয় পান না। সেজন্যই তাকে আমার পছন্দ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিক্সন চৌধুরীর জ্বালাময়ী একটি বক্তৃতা শোনার পর একটু যেন হোঁচট খেয়েছি। দলেরই একজন নেতা সম্পর্কে এসব কি বলছেন তিনি? বক্তৃতায় যার সম্পর্কে বিষোদগার করছেন তার অন্য একটি পরিচয়ও আছে। তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। একথা ভেবেও তো নিক্সন চৌধুরীর উচিত ছিল একটু রয়েসয়ে কথা বলা।
পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই কাদের মির্জার বক্তব্য শুনলাম। একবার মনে হলো কাদের মির্জার বক্তব্য সমর্থনযোগ্য! পরক্ষণেই মনে প্রশ্ন জাগল তার হঠাৎ এত প্রতিবাদী ভূমিকার কারণ কী? দলে থেকেই দলের নেতা-নেত্রীদের সম্পর্কে সমালোচনা করছেন। তার তো একবার ভাবা উচিত ছিল, যে দলের নেতাদের সম্পর্কে সমালোচনা করছেন সেই দলের সাধারণ সম্পাদক তারই বড় ভাই। অভিযোগের তীর কী বড় ভাইয়ের দিকে যাবে না?
তাছাড়া নিক্সন চৌধুরী সম্পর্কে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তাও সমর্থনযোগ্য নয়। আবার নিজের দলের একজন নেতাকে পাগল আখ্যা দিয়ে পাগলা গারদে পাঠানোর যে বক্তব্য দিয়েছেন নিক্সন চৌধুরী তাও তো সমর্থন করা যায় না। ফলে হলো কী দেশের রাজনীতি এক ধরনের কৌতুকপূর্ণ আলোচনায় উঠে গেল! হঠাৎ এই কৌতুকে নতুন মাত্রা যুক্ত হলো! নোয়াখালী-৪ আসনের সাংসদ একরামুল হক চৌধুরী এক ভিডিও বার্তায় বলে বসলেন, ‘কাদের পরিবার রাজাকার’। কী মারাত্মক অভিযোগ। যে রাজনৈতিক দলটি দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে সেই দলের সাধারণ সম্পাদকের পরিবার নাকি রাজাকার পরিবার। এই অভিযোগ বিরোধী পক্ষের কেউ করলে না হয় একটা কথা ছিল। কিন্তু দলেরই একজন দায়িত্ববান নেতা এই অভিযোগ করছেন তাও দলের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে। যদিও একরামুল হক চৌধুরী তার প্রথম ভিডিও বার্তার কিছু পরেই দ্বিতীয় ভিডিও বার্তায় সুর পাল্টে ফেলেন। ওবায়দুল কাদেরকে তিনি সম্মানের সাথে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেন! কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। খারাপ খবর বাতাসের চেয়ে দ্রুত বেগে ছড়ায়। এই খবরও দ্রুত ছড়িয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো একরামুল হক চৌধুরী হঠাৎ দলের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে এমন মানহানিকর বক্তব্য কেন দিলেন? ওবায়দুল কাদের তো দলের সাধারণ নেতা নন। তিনি দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। তার বেলায় যখন কেউ এভাবে প্রকাশ্যে মানহানিকর বক্তব্য দেয়ার সাহস করে তখন কি দল সম্পর্কে নেতিবাচক নানা প্রশ্নের ডালপালা ছড়ায় না? একই ভাবে হঠাৎ করে কাদের মির্জার প্রতিবাদী নেতা হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও নানা ধরনের প্রশ্নের ডালপালা ছড়িয়েছে। আপন ভাই দলের সাধারণ সম্পাদক। কাজেই দলের নেতাদের সম্পর্কে প্রতিবাদী বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে কাদের মির্জার কি একটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল না?
অন্যদিকে একরামুল হক চৌধুরীর বক্তব্য নিয়েও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তিনি হঠাৎ করেই কেন বললেন- কাদেরের পরিবার রাজাকার। আবার স্বল্প সময়ের ব্যবধানে হঠাৎই বা কেন সুর পাল্টালেন? বললেন, ওবায়দুল কাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা। দুর্মুখেরা অবশ্য এক্ষেত্রে নানা বিষয়ে বিরোধসহ ঈর্ষাকাতর নানা ঘটনাকে দায়ী করছেন। একই সাথে নিক্সন চৌধুরীর বক্তব্য নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। কাদের মির্জা সম্পর্কে বিষোদগার করতে গিয়ে তিনি দাবি করেন একমাত্র তার নির্বাচনী এলাকায়ই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। দেশের অন্য কোথাও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। তার এই বক্তব্য দেশের জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়াকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে অনেকে মত দেন।
অভিজ্ঞ মহল মনে করে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে আমাদের দেশ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় স্বগৌরবে এগিয়ে চলছে। এমন সময়ে আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীর মধ্যে সহনশীল ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সম্পর্ক জোরদার করা জরুরি। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘটছে তার উল্টোটা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে দলীয় শৃঙ্খলা মোটেই অনুসরণ করা হচ্ছে না। বরং নিজেদের মধ্যে বিভাজনের প্রক্রিয়া চলছে জোরেশোরে। ঘরের কথা প্রকাশ্যেই পরকে জানানো হচ্ছে।
এখন হয়তো এটাকে কোনো সমস্যা বলে মনে হবে না। কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব ঘটবে ভবিষ্যতে! এই যে ঘরের কথা পরকে জানানো হচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। ঘর আর পর এক জিনিস নয়। যত দ্বন্দ্বই থাকুক আপন ঘরই আপনাকে আগলে রাখবে। কিন্তু পরের ঘর আগলে রাখবে না। কাজেই ঘরের কথা ঘরে রাখাই ভালো।
শুভ কামনা ঘরের মানুষদের জন্য।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।
এইচআর/জেআইএম