চিনিশিল্প বাঁচান কৃষকস্বার্থ রক্ষা করুন
সজীব ওয়াফি
দেশের বেশিরভাগ চিনিকল উত্তরবঙ্গে অবস্থিত। রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫ টি চিনিকলের বন্ধ হওয়া ৬ চিনিকলে ২ হাজার ৮৮৪ জন শ্রমিক কর্মচারী কর্মরত। ২০১১ সালের পরে অস্থায়ী শ্রমিকদের আর হয়নি স্থায়ীকরণও। আখ চাষে জড়িত আছে কৃষক শ্রমিকসহ লাখ লাখ মানুষের স্বার্থ। কৃষক-শ্রমিক সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ আসে এই আখ থেকেই। তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে বকেয়া পাওনা না পাওয়ায়। ভারতের থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় উত্তরাঞ্চলে খরার কারণে আখের পরিবর্তে অন্য ফসল উৎপাদনও দুরূহ হয়ে উঠবে।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ২৭ নম্বর আদেশবলে গঠিত হয় বাংলাদেশ চিনিকল কর্পোরেশন। ১ জুলাই ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ চিনিকল কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন একীভূত করে ৬৮ টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশন (BSFIC) যাত্রা শুরু করে। বিভিন্ন সময়ে ৫০ টি প্রতিষ্ঠান সাবেক মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে করা হয় বেসরকারিকরণ। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানি লোকসানের কারণে শেয়ারহোল্ডারদের কোন লভ্যাংশ দিতে পারে না। ফলাফলে দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমানের কোম্পানি হিসেবে 'Z' শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত আছে। ২০২০ সালে এসে কর্পোরেশনের চালু ছিল ১৮ টি প্রতিষ্ঠান; এরমধ্যে ১৫ টি চিনিকল, সহযোগী শিল্প হিসেবে কেরু এন্ড কোং লিঃ, একটি ডিস্টিলারি কারখানা এবং একটি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান।
কর্পোরেশন বিগত পাঁচ বছরের ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। আছে ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণের দায়। শ্রমিক কর্মচারীর বেতন-ভাতা ও গ্রাচুইটি, ভবিষ্যৎ তহবিল, আখের মূল্য এবং সরবরাহকারীর বিল বাবদ বকেয়া পড়েছে ৫৫১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। জানানো হয়েছে শুধুমাত্র ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ টি চিনিকল বন্ধ থাকবে। লোকসানের সমস্ত দায় দেয়া হয়েছে শ্রমিকদের উপর। অথচ চিনিকলে লোকসানের অন্যতম কারণ উৎপাদন খরচ মোতাবেক আখের দাম না পাওয়ায় চিনি উৎপাদনের জন্য মাড়াই মৌসুমে কর্পোরেশন পর্যাপ্ত আখ পায় না। চিনিকলে সময়মত বিক্রি করাও যায় না, তখন সুক্রোজের পরিমাণ কমে গিয়ে চিনি আহরণ ক্ষমতা হারায়। বিক্রি করলেও সময়মত অর্থ পাওয়া যায় না। যার কারণে কৃষকরা বাধ্য হয়ে অন্য ফসল ফলানোর চেষ্টা করছেন। যারা আখ চাষ করছেন তারা গুড় উৎপাদকের কাছে বিক্রি করেছেন। ফলাফলে বছরের বড় একটা সময় জুড়ে আখের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বেশিরভাগ চিনিকলে নেই বহুমুখী উৎপাদনের সুযোগ।
কৃষকদের দেয়া হয় না কোন ভর্তুকি। বরং কর্পোরেশনকে ঋণ নিতে বাধ্য করা হয়। সেই ঋণের বড় একটা অংশ মাড়াই মৌসুমে আখ পাওয়ার বিনিময়ে কৃষকদের ভিতরে ঋণ হিসেবে বিতরণ হয়। চুক্তিবদ্ধ আখচাষিরা ঋণ গ্রহণ করে ঋণের সুদসহ এ পর্যন্ত ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ (প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা) পরিশোধ করলেও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তা ব্যাংকে পরিশোধ না করে নানান কাজে ব্যবহার করেছেন। উপরন্তু প্রতিবছর চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণের সুদ যোগ হচ্ছে চিনি উৎপাদন খরচের সাথে। চিনিকল এলাকায় রাস্তা করার খরচও উৎপাদন খরচের সাথে দেখানো হয়। আধুনিকায়নে নাই কোন বিনিয়োগ। নষ্ট ও পুরাতন যন্ত্র ব্যবহারে শুধুমাত্র চিনিই কম আহরিত হচ্ছে না। বরং মাড়াইয়ে টন প্রতি বিদ্যুতের ব্যবহার, অপচয়, রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কোন যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে গেলে আহৃত রসটুকুও নষ্ট হয়ে যায়। প্রক্রিয়া কালীন রসের তাপমাত্রা ও অম্লত্ব নির্দিষ্ট মাত্রার কম বেশি হলেও চিনি কম পাওয়া যায়। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে। টেন্ডার ও কন্ট্রাক্ট প্রদানের বেলায় কমিশন নিয়ে কাজ প্রদানসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সীমাহীন দুর্নীতি ছিলো মিলের খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয় ও মেরামত, উপজাত বিক্রি, আখের ওজন, সার-বীজ ও কীটনাশক প্রদানে। দুর্নীতির কারণে খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকসানও বেড়েছে লাগামহীন।
মাটির ও আবহাওয়া বিবেচনায় উন্নত জাতের আখ চাষে কখনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্পোরেশন। কৃষকও উৎসাহ পায়নি কারণ সব গ্রেডের আখের দাম একেই। অথচ উন্নত মানের আখের ফলন সম্ভব। দুর্নীতি লুটপাট নির্মূল করে সামনের দিকে আগানো সম্ভব একসময়ে লাভজনক এই চিনিকলের।
বন্ধ হওয়া মিল শ্রমিকদের বাকী ৯ টি মিলে সমন্বয়ের কথা বলা হলেও এই বিপুল সংখ্যক স্থায়ী, অস্থায়ী ও মৌসুমি শ্রমিকদের ধারণ করার যথেষ্ট সক্ষমতা নেই। তারউপরে অন্য এলাকায় গিয়ে শিকার হতে পারেন হেনস্তার। নারী শ্রমিকদের জন্য যেটা পুরোপুরি অসম্ভব। চালু থাকা বাকি চিনিকল গুলোতেও ৫-৬ মাস ধরে শ্রমিক কর্মচারীরা বেতন ভাতা পাচ্ছেন না। মিল লোকসান দিয়ে যাচ্ছে, সরকার ভর্তুকি দিতে অপারগ, এমতাবস্থায় নতুন সহকর্মী যোগদান করলে ঐ এলাকার কর্মীরা কি নতুন সহকর্মীদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হবেন না?
বন্ধ চিনিকলগুলোর আখ চালু চিনিকলে নিয়ে গেলে, চালু কলগুলো আগের চেয়ে বেশি চিনি উৎপাদন করবে এরকম যুক্তি দেয়া হলেও বাস্তবতায় এটা কৃষকদের সাথে প্রহসন! কারণ ভৌগোলিক দূরত্ব অনেক। টালবাহানা করতে করতে ইতোমধ্যে এ মৌসুমের আখে ফুল এসে গেছে, আখগুলো শুকিয়ে যাবে এখন। হতাশ হয়ে আগুনও ধরিয়ে দিয়েছেন কোন কোন চাষী।
ভারতে বিগত বছরগুলো থেকে আখের বাম্পার ফলন হওয়ায় তাদের চিনিশিল্প চরম সংকটে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত আখের উৎপাদন হওয়ায় বিপুল পরিমাণে চিনির মজুদ গড়ে উঠেছে সেখানে। অতিরিক্ত উৎপাদনে ভ্যন্তরীণ বাজারেও পণ্যটির দাম কম। আন্তর্জাতিক বাজারে ধারাবাহিক দরপতন, ব্রাজিল-থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে বাড়তি উৎপাদনের এবং বিভিন্ন কারণে ভারতের চিনি রফতানি কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বাড়েনি। যার কারনে ভারতে চিনির মজুদ ১ কোটি ১৫ লাখ ১৫ হাজার টন ছাড়িয়েছে। উদ্বৃত্ত চিনি বিক্রি করতে পারছেন না ভারতীয় উৎপাদক ও রফতানিকারকরা। ফলে আখচাষিদের পাওনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে চিনিকলগুলো। এরইমধ্যে আখচাষিদের পাওনার পরিমাণ ৬ হাজার ৫০০ কোটি রুপি ছাড়িয়েছে।
পাওনা অর্থ না পাওয়ায় বিপাকে পরেছেন দরিদ্র চাষীরা। উৎপাদনকারীরাও পৌছে গেছেন খাদের কিনারে। ২০২০-২১ মৌসুমে ৬০ লাখ টন চিনি রফতানিতে ভর্তুকির অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার। গত অর্থবছরে ৬০ লাখ টন রফতানির পরিমাণ ধরা হলেও রফতানি হয়েছিল ৫৭ লাখ টন চিনি। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদশে শুল্কবিহীন চিনি রফতানি করতে ভারতীয় আমলা-মন্ত্রীদের দৌড়ঝাঁপ লক্ষ্যণীয়। তাহলে কি ভারতীয় উদ্বৃত্ত চিনি বাংলাদেশে রফতানি করতেই ক্রমে ক্রমে আমাদের চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে? আমাদের কৃষক শ্রমিকের স্বার্থ ক্ষুন্ন করে ইচ্ছাকৃতভাবেই লোকসানের অজুহাত নয়তো?
বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি চিনিকল ছাড়া কোন চিনিকল নেই। বেসরকারি খাতে কয়েকটি রিফাইনারি আছে, যারা বিদেশ থেকে তরল চিনি আমদানি করে এখানে রিফাইন করে। ভারত সরকারের পক্ষে বিগত বছরগুলোতে রিফাইনিং খাতে বিনিয়োগ করার আগ্রহ দেখিয়েছে। রাসায়নিক এই চিনি স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। অন্যদিকে আমাদের দেশি কলগুলো থেকে উৎপাদিত চিনি ভালো মানের এবং স্বাস্থ্যসম্মত। চাহিদা সত্ত্বেও সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থায় পরিবর্তন না আনায় খুচরা বিক্রেতা এবং ভোক্তাদের কাছে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছায় না এই চিনি। টিসিবিও কখনো দেশি মিলের চিনি বিক্রি করতে সহায়তা করেনি। বিপরীতে বিপুল পরিমাণে অবিক্রীত চিনি নষ্ট হতে থাকে গুদামে। আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যেই যদি চিনিকল বন্ধ হয়ে থাকে, তবে একসাথে কেন ৬ টি চিনিকল বন্ধ হবে? পর্যায়ক্রমে একটা একটা চিনিকল আধুনিকায়নের অসুবিধা কি! দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় না এনে আন্দোলনরত কৃষক-শ্রমিকদেরই কেন ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে!
বিরাষ্ট্রীয়করণ হলেও বর্তমানের চেয়ে অল্প মজুরিতে শ্রমিকরা বাধ্য হবে মানবেতর জীবনযাপনে। বেসরকারিকরণ পূর্বের কারখানাগুলোও অধিকাংশ আর টিকে থাকেনি। বরং সস্তায় জমি ও যন্ত্রপাতি লুট হয়ে গেছে। পরিত্যক্ত জমি দেখিয়ে বড় অঙ্কের ব্যাংকঋণ হাতিয়ে নিয়েছে ব্যক্তিমালিকেরা। বিদেশি বিনিয়োগের কথা বলা হলেও, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা কল কেন তাদের হাতে দিতে হবে? নতুন নতুন কল স্থাপনে তারা বিনিয়োগ করতে পারেন না?
চিনিকল বন্ধ হয়ে গেলে শুধুমাত্র আখের সাথে জড়িত কৃষক-শ্রমিকেরাই বিপদগ্রস্ত হবেন এমনটা না। ব্যাগাস ও ঝোলাগুড় কেনা-বেচার ব্যবসা করে অনেকের সংসার চলে। আখের বর্জ্য থেকে প্রেসমাড ব্যবহৃত হয় আশেপাশের কৃষি কাজে সার হিসেবে। মিল এলাকা ঘিরে চলে ভাতের হোটেল, মুদি দোকান, বাজার, পরিবহন ব্যবসা, বিদ্যালয়, কলেজ, মসজিদ, আবাসিক এলাকা এবং ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ চিনিকল নির্ভর একটা জনপদের পুরো অর্থনীতি। চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেয়ায় ইতোমধ্যে প্রান্তিক এই মানুষেরা হুমকির মুখেও পড়েছেন।
চিনিকলগুলো বন্ধের কারণে কর্পোরেশনের মোট চিনি উৎপাদন হ্রাস পাবে আশঙ্কাজনক। সঠিক ব্যবস্থা নিয়ে চিনিকলগুলো পুনরায় লাভজনক করা সম্ভব। সুতরাং এখনই রুখতে হবে চিনির বাজার অসহনীয় এবং কোন বিশেষ মহলের বাজার তৈরি করে দেয়ার এই ষড়যন্ত্র। দুঃসময়ে ভারতের পেঁয়াজ বন্ধ করে দেয়া এবং লুটেরা সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর থেকে শিক্ষা নেয়া কর্তব্য। কৃষক শ্রমিক রক্ষায় সকল নাগরিকের জাতীয় লড়াই হোক।
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক।
এইচআর/জেআইএম