কাদের মির্জার ‘সত্যকথন' এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতি
নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আব্দুল কাদের মির্জা। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৬ জানুয়ারি। নির্বাচনের ফলাফল কি হবে তা আগাম না বলাই ভালো। তবে কাদের মির্জা এখন একটি আলোচিত নাম। সংবাদপত্রে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন। তার প্রশংসা শোনা যাচ্ছে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতাদের মুখেও। হঠাৎ করে একটি পৌরসভা নির্বাচনের মেয়র প্রার্থী এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন কেন?
বলা হচ্ছে, তিনি এমন কিছু সত্য কথা বলেছেন, যা সরকার , সরকারি দল এবং প্রশাসনের চরিত্র উদোম করে দিয়েছে। তার সত্য বচনগুলোও এখন আর রাজনীতি সচেতন কারো অজানা নেই। তিনি প্রথমে বলেছিলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগ ৩/৪ টি আসন পাবে। বাকি আসনগুলোতে হেরে যাবে এবং তারা পালানোর পথ খুঁজে পাবে না। তার বক্তব্য নানা কারণে অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং তিনি রাতারাতি ‘হিরো' বনে যান তার কথায় এটা স্পষ্ট যে, বর্তমানে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে না বা হওয়ার সম্ভাবনা কম। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের অনেকেই পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।
এ ধরনের কথা বহুদিন ধরেই বিএনপিসহ আওয়ামী লীগবিরোধী অনেকেই বলছেন। তাহলে কাদের মির্জার কথা এত বাজার পাওয়ার কারণ কি? কারণ সম্ভবত দুটি। এক. তিনি নিজে আওয়ামী লীগ করেন। দুই. তার ভাইয়ের পরিচয়। আব্দুল কাদের মির্জার বড় ভাই ওবায়দুল কাদের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতু মন্ত্রী। ওবায়দুল কাদেরের ভাইয়ের বক্তব্য দল এবং সরকারের বিরুদ্ধে গেলে তা অন্যদের লুফে নেওয়ারই কথা। বাস্তবে সেটাই হয়েছে।
কাদের মির্জা দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন কি না, তার বিরুদ্ধে দল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে কি না, তার বক্তব্যের জন্য ওবায়দুল কাদের বিব্রত বোধ করছেন কি না, সে সব প্রশ্ন সামনে আসছে। ওবায়দুল কাদের সরাসরি ভাইয়ের বিরুদ্ধে কিছু না বললেও এটা বলেছেন যে , প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের জন্য কেউ অপরিহার্য নন। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে কেউ রেহাই পাবেন না।
কাদের মির্জা কিন্তু কথা বলা বন্ধ করেননি। নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়ে তিনি প্রতিদিনই কথা বলছেন। সংবাদ মাধ্যমে তার বক্তব্য যা আসছে তাতে সরকারবিরোধীরাই উৎসাহিত হচ্ছে। যদিও কাদের মির্জা এটাও বলেছেন যে, পত্রপত্রিকা আসলগুলো লেখে না, এডিট করে আমার কথা বিকৃত করে, এগুলো প্রধানমন্ত্রী এবং আমাদের মন্ত্রীদের কাছে পাঠিয়ে আমার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছে। এখানে প্রশ্ন আসে, আসল কথা কোনগুলো? তার কোন বক্তব্য এডিট করে বিকৃত করা হয়েছে? তাকে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হতো। মোবাইল ফোনে হুমকি দেওয়ার কথা বলে তিনি তো এমনও বলেছেন যে, চারদিকে বারুদের গন্ধ পাই, অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনি। যেকোনো সময় আমার জীবন বিপন্ন হতে পারে। এটা কি তিনি বলেননি?
প্রায় প্রতিদিন তিনি কথা বলছেন। একদিন বলেছেন, আমার সঙ্গে কেউ নেই। ওবায়দুল কাদের নেই। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ আমার সঙ্গে নেই। ডিসি, এসপি, নির্বাচন অফিসার কেউ-ই নেই। তাহলে তার সঙ্গে কে আছে? তার নির্বাচনী এলাকার জনগণ এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ? হয়তো তাই। জনগণ তার সঙ্গে আছেন কি না সেটা বোঝা যাবে ভোটের দিন। যদি তার বক্তব্য অনুযায়ী ‘সুষ্ঠু' ভোট না হয় তাহলে কি হবে? বড় ভাই ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, আগামীতে জিততে হলে তাকে আরো সতর্ক হতে হবে। নিজের বউকে সামলাতে হবে। সঙ্গে যারা চলে তাদের ওপর নজর রাখতে হবে। কে কোথা থেকে মাসোহারা নেয়, সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
কাদের মির্জা বলেছেন, আমি একটা জায়গায় দুর্বল। ওবায়দুল কাদের সাহেব অসুস্থ, তিনি মারা যাবেন, এটা বললে আমি দুর্বল হয়ে যাই। তাকেও বুঝতে হবে, তিনি জাতীয় নেতা, আওয়ামী লীগের দুই বারের সাধারণ সম্পাদক। আমি নোয়াখালী ফেনীর অপরাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবো। কাদের মির্জা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। আবার এ-ও বলেছেন যে, প্রশাসনের লোকজন ভোটে জেতায় সহয়োগিতা করে এখন বেশি ‘উরতাছে'। তাদের বিচার হওয়া উচিত। দেশে যে দুর্নীতি-অনিয়ম হচ্ছে সে কথাও তিনি বারবারই বলছেন।
কাদের মির্জার সব কথা ‘পাগলের প্রলাপ' বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। ‘সব ঠিক হ্যায়' বলে যারা কোনো অভিযোগ শুনতে চান না, তারা তেলবাজ। বিপদের সময় এই তেলবাজদের খুঁজে পাওয়া যায় না। কাদের মির্জা হঠাৎ কেন সত্য কথনে উদ্বুদ্ধ হলেন, তার পেছনের রহস্য উন্মোচনে সময় ব্যয় না করে আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে, তিনি মিথ্যা অভিযোগ তুলে সরকারের জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতির তৈরি করেছেন কি না।
এটা মনে রাখতে হবে যে, কাদের মির্জা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী, কাউয়া বা হাইব্রিড নন। পারিবারিকভাবেই তিনি আওয়ামী লীগার। তার বড় ভাই ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, এখন আওয়ামী লীগে দ্বিতীয় প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি দলের জন্য জেলজুলুমও সহ্য করেছেন। তবে ত্যাগী নেতারা ক্ষমতায় গিয়ে ভোগের নেশায় মত্ত হন না, তা-ও নয়। রাজনীতিবিদদের চরিত্রভ্রষ্ট হওয়ার অনেক নজির আছেন। এক সময়ের বিশ্বাসীও বিশ্বাসঘাতরের ভূমিকায় নামতে পারেন। আওয়ামী লীগে খন্দকার মোশতাকসহ একাধিক এমন বিশ্বাসঘাতকের দৃষ্টান্ত আছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রেকর্ড সময় ধরে ক্ষমতায় আছে। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিও হচ্ছে। বাংলাদেশর সমৃদ্ধি চোখে পড়ছে দেশের বাইরেও। তার মানে কিন্তু এটা নয় যে যেভাবে চলছে, তার থেকে ভালো চলার কিছু নেই। সরকার এবং সরকারি দলের ভেতরেও অবশ্যই সমস্যা আছে। নানাভাবে তার বিকৃত বহিঃপ্রকাশও ঘটে। দায় এড়ানোর একটি অসুস্থ প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায়। আবর্জনা কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রেখে বাইরে থেকে সবকিছু ফিটফাট দেখানোর আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ভেতরের সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে দেশ আরও ভালো চলবে। দেশে যে আয় বৈষম্য, ধনবৈষম্য বাড়ছে তা অস্বীকার করা যাবে না। সরকারে থেকে, সরকারি দলের আশ্রয়ে থেকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার তথ্য গোপন করার মতো বিষয় নয়। বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচনে স্পষ্টবাদী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা কাদের মির্জা জয়লাভ করুন, সেটা যেমন চাই – তেমনি এটাও চাই, তার জয় বা পরাজয়ের মধ্য দিয়ে যেন তার উত্থাপিত অভিযোগগুলো ধামাচাপা পড়ে না যায়। শুধু কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি নয়, উচিত কথা বলার মতো লোকের সংখ্যা যেন দেশে বাড়ে এবং উচিত কথা শুনে গায়ে জ্বলুনি ধরা লোকের সংখ্যা যেন কমতে থাকে। উদারতা এবং সহনশীলতার মাত্রা না বাড়লে দেশের উন্নয়নযাত্রা কাঙ্ক্ষিত ফল দেবে না।
আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শে পরিচালিত রাজনৈতিক দল। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল ‘বাংলার দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। মুষ্টিমেয় মানুষের মুখে হাসি থাকলে, বেশি মানুষের জীবন যন্ত্রণাময় হলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি সঠিক পথে চলছে বলা যাবে কি? একদিকে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, অন্যদিকে প্রতিদিন ঘরে-বাইরে নারী নিগ্রহ-ধর্ষণ-নিপীড়ন-হত্যার খবর মোটেও সামাজিক সুস্থিতির পরিচয়বাহী নয়।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/জেআইএম