পূর্ণতার প্রত্যাবর্তন
রাজপথ থেকে কারাগার। কারাগার থেকে রাজপথ। এভাবেই জীবনের ৩৫টি বছর মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে। ১৪টি বছর। চার হাজার ৬৮২টি দিন কারাবাস। ব্রিটিশ আর পাকিস্তানি কসাইদের হাত থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যেই কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বঙ্গবন্ধুর নিদারুণ নিষ্ঠুর জীবনবরণ। স্বপ্ন বাঙালির নিজস্ব আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা। ধাপে ধাপে ঐক্যবদ্ধ করা। মিশন থেকে ভিশন। লক্ষ্য স্বাধীন বাংলা। জেলখানার সাথে প্রথম পরিচয় ১৯৩৮ সালে। সংগ্রাম থেকে মুক্তির দীর্ঘ পথে হাঁটতে গিয়ে পর্যায়ক্রমে ৪৮, ৪৯, ৫০ থেকে ৫২, ৫৪, ৫৮, ৬২, ৬৪, ৬৫, ৬৬, ৬৯, ৭১ সালে কারাবরণ বঙ্গবন্ধুর। মনে ধারণ করা বাসনা দীর্ঘ সাধনায় পিচ্ছিল পথপরিক্রমায় অর্জিত। এই অর্জনে বিসর্জন দিতে হয়েছে অনেক কিছুই। ভাষার জন্য রক্ত। দেশের জন্য ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত। অনেক কর্মী-সহযোদ্ধাকে হারিয়েছেন।
অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালি বিজয়। বাঙালির নিজের ঘর বাংলাদেশ। ঘরের চারদিক তখনও লাশ, কান্না, স্বজনদের হাহাকার। শরণার্থীদের আকাশ বাতাস ভারী হওয়া আর্তনাদ। এতকিছুর পরও প্রিয় মানুষকে পাওয়ার ব্যাকুলতা। সবকিছু পেয়েও অপূর্ণতা। যাকে ঘিরে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। অপেক্ষার পালা কখন আসবে পিতা? পিতা না আসা পর্যন্ত এই পাওয়ার পূর্ণতা নেই। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা! ভূখণ্ডে প্রিয় নেতাকে ফিরে পাওয়ার আবেগ। যার ডাকে নিরস্ত্র বাঙালি সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক মহাকাব্যের বজ্রকণ্ঠ ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দমায়ে রাখতে পারবে না’, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- বাঙালিদের শিরা-ধমনীতে প্রবেশ করেছিল। ফলে সশস্ত্র পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানিদের আনুষ্ঠানিক পরাজয়ে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়।
‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তোমার নেতা, আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ স্লোগান ধারণ করে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙালিরা তখনও জানেন না কোথায় আছেন বঙ্গবন্ধু? বাংলাদেশ যখন বিজয়ের অগ্রভাগে তখন পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বারোটি অভিযোগে অভিযুক্ত বঙ্গবন্ধু। ৭১ এর ১১ অগাস্ট লায়ালপুর জেলের অভ্যন্তরে চলছে মৃত্যুদণ্ডের আয়োজন। বাংলাদেশকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করা এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড। সারা পৃথিবী জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বঙ্গবন্ধুকে লায়ালপুর জেল থেকে মিয়ানওয়ালী জেলে স্থানান্তর করা হয় এবং সেই সেলের পাশে একটি কবরও খোঁড়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে দিতে সকল আয়োজন সম্পন্ন।
যেহেতু গোপনকাষ্ঠে বিচার সেহেতু আপিল করার কোনো সুযোগ ছিল না। এদিকে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান জানতে এবং মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে সারাবিশ্ব জানতে পারে বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন। তাতে স্বস্তি আসলেও। শুরু হয় অপেক্ষার এক দীর্ঘ প্রহর। কবে নেতা ফিরে আসবেন? পিতা ফিরে আসা ছাড়া এই বিজয় অর্থহীন। পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে পূর্ণ রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা দেয়া হলেও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মানুষটির চোখে মুখে ছিল প্রিয় মানুষগুলোর কাছে ফেরার আবেদন।
৮ জানুয়ারি ১৯৭২। মুক্ত হয়েই সাংবাদিকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তানের কারাগারের কনডেম সেলে আমি যখন ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখন বাংলাদেশের জনগণ আমাকে তাদের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছে। আমি মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। মনে রাখতে হবে, যে মানুষ মরতে প্রস্তুত তাকে কেউ মেরে ফেলতে পারে না। আমি প্রায় ৩৫ বছর ধরে রাজনীতি করছি। যেদিন আমাকে কারাগারে নেয়া হয় আমি বুঝতে পারছিলাম না বেঁচে থাকব নাকি মরে যাব। তবে আমি জানতাম বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন হবে, তাদের কেউ দমাতে পারবে না।’ মানুষের ভালোবাসার এতো ত্যাগ বিফলে যায়নি।
প্রতীক্ষার অবসান। লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের বিমানটি ঢাকার আকাশে প্রবেশ করে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, সোমবার। তখন ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ১টা ২০ মিনিট। চারদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢ্ল। দুইশ নব্বই দিন কারাজীবন। ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে আসা। মুক্ত হওয়া। সবই যেন অলৌকিক। তাই পিতাকে স্বচোখে দেখবার জন্য দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ এসেছে। প্রিয় নেতাকে বরণ করে নিতে। চারদিক স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে প্রকম্পিত বাংলার আকাশ-বাতাস। কোনো আইনি ব্যারিকেড এই আবেগকে ধরে রাখতে পারেনি সেদিন। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান লক্ষ লক্ষ জনতার স্রোত।
লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার মনের আশা পূর্ণ হয়েছে। আমার বাঙালি আজ মুক্তি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু কবি গুরুর উদ্দেশ্যে বলেন, হে কবি, আপনি বলেছিলেন, সাত কোটি সন্তানেরে হে বঙ্গ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি। আপনি এসে দেখে যান আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। এভাবেই দীর্ঘ সংগ্রাম থেকে মুক্তির লড়াইয়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন জাতির পিতা। তাই তো পিতার প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই একমাত্র স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা লাভ করে।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা ১৯৭২ সালে মানুষের মধ্য ছিল সেই আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাশা যেন যুগ যুগ ধরে মানুষের মাঝে বিরাজমান থাকে স্থায়ীভাবে। যুগ থেকে যুগান্তরে মানুষের মাঝে বঙ্গবন্ধু যেন বঙ্গবন্ধু হিসেবে উদ্ভাসিত হয় সে জন্য তার কর্মময় জীবন পঞ্জিকা সকলের ভেতরে পৌঁছাতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে যেন আর কোনোদিন ক্ষতবিক্ষত করতে না পারে ৭১ এর পরাজিত শক্তি আর দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা কালপ্রিটরা। সে জন্য ইতিহাসের প্রতিটি স্তরে বঙ্গবন্ধুকে পৌঁছে দিতে হবে। বাংলাদেশ নামক দেশের উইকিপিডিয়ায় ক্লিক করলেই যেন সারাবিশ্বের মানুষ সহজেই বাংলাদেশের সৃষ্টা সম্পর্কে জানতে পারে।
বিশ্বের সকল দেশের একাডেমিক গবেষণা স্তরে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস সংরক্ষণ ও তা বিতরণের যথাযোগ্য পদক্ষেপ নিতে হবে। ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়’ নীতির সৃষ্টাকে পৌঁছে দিতে বিশ্বের আনাচে-কানাচে। প্রত্যাবর্তন করেই দেশ গড়ার যে ডাক বঙ্গবন্ধু সবাইকে দিয়েছিলেন। যুগ যুগ ধরে দেশ গড়ার সেই স্পৃহা জাগানো এবং দেশপ্রেমের প্রেরণায় প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে সকলকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে যেভাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এককভাবে তার পরিশ্রমকে আরও সফল ও স্বার্থক করতে সকলকে বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের ইতিহাস ধারণ করে সহযোগিতা করতে হবে। তবেই প্রত্যাবর্তন স্বার্থক হবে। বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবন অক্ষয় হোক। বঙ্গবন্ধুর সমস্ত স্বপ্ন পূর্ণতা পাক।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ পরিচালক, বঙ্গবন্ধু চর্চা কেন্দ্র বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
এইচআর/বিএ/এমএস