ছাত্রলীগ : আন্দোলন সংগ্রামে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে
'তোমরা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করিও। ছাত্রলীগকে ভেঙে ফেলে দিও না। সকলকে আমার সালাম দিও।' ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র প্রতিষ্ঠান আমি গড়েছিলাম কয়েকজন নিঃস্বার্থ ছাত্রকর্মী নিয়ে। প্রত্যেকটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন, রাজবন্দিদের মুক্তি আন্দোলন, ব্যক্তি স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ও ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে বহু জেল-জুলুম সহ্য করেছে এই কর্মীরা। পূর্ব বাংলার ছয় দফার আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের পুরাভাগে থেকে আন্দোলন চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গোলমাল হলে আমার বুকে খুব আঘাত লাগে। তাই রেজাকে বললাম,'প্রতিষ্ঠান রক্ষা করিও'।
-কারাগারের রোজনামচা, পৃঃ২১১
শকুনের মরন কামড় থেকে বাঙালি জাতিকে উদ্ধারের প্রয়োজনেই ৪৮ এর ৪ঠা জানুয়ারি জন্ম নেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। জন্ম অথবা পথচলা কোনটাই ছিল না কখনও অনূকূলে। সময়ের স্রোতধারায় প্রতিকূল ঐতিহাসিক মুহূর্তে জন্ম। সংগ্রাম থেকে মুক্তিই যার স্পন্দন। অন্যায়ে প্রতিবাদের কণ্ঠ ছাত্রলীগ। মুক্তিকামী মানুষের আবেগের নাম ছাত্রলীগ। এই অনুভূতির জন্ম হয় পরিবারে। নানান বাধা বিপত্তি, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ৭৩ বছরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহৎ অসাম্প্রদায়িক পরিবার ছাত্রলীগ। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের পিঠ জুড়ে ছাত্রলীগের ইতিহাস। ত্যাগ আর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ছাত্রলীগের জন্ম।
৪৭ এ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয় বটে। কিন্তু সেটি ছিল সাম্প্রদায়িক বিভক্তি। যা ছিল অপ্রত্যাশিত। ব্রিটিশ আর মুসলিম লীগের দাবার চাল মাত্র। ফলে আদর্শিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জন্ম নেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বলে রাখা ভাল আওয়ামী লীগের আগে ছাত্রলীগের জন্ম দেন বঙ্গবন্ধু। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অসাম্প্রদায়িক বাংলার বীজ বঙ্গবন্ধু বাল্যকালেই ধারণ করেছিলেন। শুধু ছিল বাস্তবায়নের অপেক্ষা মাত্র। বাস্তবায়নের ভিশন ছিল বাংলাদেশ। হাতিয়ার হল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের অক্সিজেন হল ছাত্রলীগ। এজন্যই হয়তো আওয়ামী লীগের আগে ছাত্রলীগের জন্ম।
ছাত্রলীগ ছিল বঙ্গবন্ধুর ভ্যানগার্ড। বঙ্গবন্ধু যা কিছু সিদ্ধান্ত নিতেন সারা বাংলার প্রতিটি মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব ছিল ছাত্রলীগের। ফলে সময়ের পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু নিজ যোগ্যতায় হয়ে উঠেন বাঙালি জাতির একমাত্র বিশ্বাসের প্রতীক। একমাত্র নেতা। একমাত্র অস্তিত্বের প্রতীক। তৈরি করে ছিলেন একঝাঁক বিশ্বস্ত ছাত্রলীগের কর্মীবাহিনী। যাদের কাজই ছিল বিশুদ্ধ বাঙালি জাতির কাছে বঙ্গবন্ধুর বিশুদ্ধ বার্তা পৌঁছানো। মুক্তির ঠিকানা। নিখুঁত নিশানা। ধাপে ধাপে ঐক্যবদ্ধতা। প্রাণবন্ত ভাবে। জয় বাংলায় ছাত্রলীগ ঐক্যবদ্ধ। পুরো বাঙালি জাতিকে এক সুতোয় গাঁথার মিশন। পারলেন বঙ্গবন্ধু। এবার রাজপথ। সংগ্রাম। শেষ পেরেক। স্বপ্ন, সাধনা রূপদানের পালা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবব্ধ ছাত্রলীগের প্রথম আঘাত ভাষায়। তছনছ পাকিস্তানের কূটকৌশল। প্রথম আঘাতে বিজয়।
৫২ এর ভাষা আন্দোলনে মায়ের ভাষা বাংলা আদায়। পূর্ব বাংলার হাওয়ায় তখন একমাত্র প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু। লক্ষ্য স্থির। বাংলাদেশ। লটারি আর কারিশমা নয় এবার যোগ্যতার পরীক্ষা। ভালবাসা আর বিশ্বাসের ঠিকানা। যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে ৫৪ এর নির্বাচন। বাঙালিদের দীর্ঘদিন পুষিয়ে রাখা ক্ষোভের কাঙ্ক্ষিত বহিঃপ্রকাশ। মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা ছিল চরমে। তবে কাজ হয় নি। বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ পূর্ব বাংলার মানুষের মনের গহীনে বঙ্গবন্ধুকে এমনভাবে প্রবেশ করিয়েছে যা বের করে ফেলা সম্ভব ছিল না। ৫৫ তে সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগকে বাংলার মাটি থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায়।
আওয়ামী লীগ দিনে দিনে শক্তিশালী হতে থাকে। বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ। আস্থার ঠিকানা আওয়ামী লীগ। ভালবাসার আয়না বাঙালি জাতি। এভাবেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথ চলা। ৬২ তে শিক্ষার অধিকার ছিনিয়ে আনতে বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ ঝাঁপিয়ে পড়ে সকল প্রগতিশীল চিন্তার ছাত্র সমাজকে সঙ্গে নিয়ে। এবারও সফল। পথ অল্প। বাঙালি জাতির মনের ভাষা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই মুক্তির সনদ ৬৬ এর ৬ দফা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু।
মুক্তির সনদ মাঠ থেকে ময়দানে, রাজপথ থেকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের অক্সিজেন ছাত্রলীগ। পুরো জাতিকে অনুধাবন করাতে সক্ষম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু দিনের পর দিন থেকেছে জেলে থেকে জেলে। কিন্তু তাতে কি? বার্তা তো একটাই বাঙালির বাংলাদেশ। যা ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। পাকিস্তানরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে নানান ষড়যন্ত্র করলেন। কিন্তু পুরো বিশ্ব দেখলো অবাক হয়ে। কিভাবে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে বঙ্গবন্ধু।
৬৯ এর গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ। মুক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু। বিদায়ের শেষ ঘন্টা। শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। ৭০ এর ঐতিহাসিক নির্বাচন। মাঠে ঘাটে চষে বেড়িয়েছে ছাত্রলীগের নিঃস্বার্থ বাহিনী। ফলে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়। পাকিস্তানের টালমাটাল। ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা। বঙ্গবন্ধুর দাঁতভাঙা জবাব। ৭১ এর ২রা মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিক উত্তোলন করে। ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।....। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।... আমাদেরকে দাবায়ে রাখতে পারবা না....।
দীর্ঘ নয় মাস ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মী শহীদ হয়। জাতিকে স্বাধীনতাযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। লাল-সবুজের পতাকার ইতিহাস জুড়ে ছাত্রলীগ। বাংলাদেশের ইতিহাস মানেই ছাত্রলীগ। সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল আছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশ যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা বঙ্গবন্ধু নিজেই কারাগারের রোজনামচায় বলেছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক অনেকেই ছাত্রলীগকে বিভক্ত করার চেষ্টা করেছে। ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য ছিল সেটাই। তারা জানতো ছাত্রলীগকে বিভক্ত করতে পারলেই বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করা সহজ হবে। হয়তো সফল হয়েছে ৭১ এর পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আর বাংলাদেশ বিরোধী দেশী বিদেশী শক্তিরা। খুনি জিয়া আর মোশতাকের ষড়যন্ত্রে ৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হারিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের প্রদেশ হওয়ার পথে হাঁটে। কিন্তু খুনিরা জানে না বঙ্গবন্ধু অমর।
সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা ৮১ সালের ১৭ ই মে দেশে ফিরে আসার পর ঘুরে দাঁড়ায় ছাত্রলীগ। সকল বিভক্তি কাটিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ছাত্রলীগ দুর্বার গতিতে বঙ্গবন্ধুর আর্দশ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের। ২০ বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয় শেখ হাসিনা। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। জনগণের প্রত্যাশায় চারবার ক্ষমতায় থেকে দেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছে। করোনা মহামারিতেও দেশের মানুষকে সুশৃঙ্খলভাবে সেবা ও সকল রকমের সহযোগিতা দিয়ে দেশের উন্নয়নের চাকা রেখেছে সচল। করোনার প্রার্দূভাবে মানুষের মাঝে সেবা দিয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
১/১১-এ শেখ হাসিনা মুক্তির আন্দোলনে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল ছাত্রলীগ। সময়ের স্রোতে বিশ্বাসঘাতকেরও জন্ম হয়েছে ছাত্রলীগে। যার কারণে মাঝে মধ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিতর্কিত হয়েছে। বিশ্বাসঘাতকদের একটাই উদ্দেশ্য ছাত্রলীগকে শেখ হাসিনা থেকে আলাদা করা। আলাদা করতে পারলেই, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে আঘাত করা সহজ হবে। এজন্য ছাত্রলীগের নিঃস্বার্থ নেতাকর্মীদের সজাগ থাকবে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে ডিজিটাল ও এনালগ দুই পদ্ধতিতে শেখ হাসিনার সরকারের সকল উন্নয়নমূলক কার্যক্রমগুলো মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। যাতে ষড়যন্ত্রকারীরা অপপ্রচার ও গুজব ছড়াতে না পারে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন বইগুলো নিজে পড়তে হবে এবং সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে ব্যাপক প্রচার করতে হবে।
আজও মৌলবাদী সংগঠন ও ৭১-এর পরাজিত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে ছাত্রলীগ। এই লড়াইয়ের সফলতা যেমন আমাদের সকলের, তেমনিভাবে ব্যর্থতাও আমাদেরকে করুণ কষ্ট দেয় ও দেবে যুগযুগ ধরে। কারণ এই ব্যর্থতার কারণেই আমরা ৭৫ এর ১৫ই অগাস্ট জাতির পিতাকে হারিয়েছি।
হাজারও গৌরবগাথা ইতিহাস ছাত্রলীগের। ছাত্রলীগ করতে এসে কতজনকে যে মৌলবাদী শক্তির হাতে নৃশংসভাবে জীবন দিতে হয়েছে? তাদের পরিবারগুলোর কি অবস্থা? ৪৮ থেকে অদ্যাবধি কত লাখ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পঙ্গু হয়ে ভিখারির মতো জীবনযাপন করছে? কেউ কি খোঁজ রেখেছে? ছাত্রলীগ করতে এসে কত রাত্রি যে নেতাকর্মীরা ঘুমায় না, কত অত্যাচার সহ্য করে, মৃত্যুকে কতবার চোখের সামনে দেখেছে, মৌলবাদী শিবিরের অত্যাচারে কত জীবন সার্টিফিকেট ছাড়াই ঝড়ে গেছে তা কি খোঁজ নিয়েছে কেউ? ৪৮ থেকে অদ্যাবধি নরপশু পাকিস্তান ও ৭১এর পরাজিত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ছাত্রলীগ যত রক্ত দিয়েছে এতো রক্ত অন্য কাউকে দিতে হয়নি। সারাদেশে কত সংখ্যক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে আর কি পরিমাণ নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, হচ্ছে তার একটা তালিকা আশা করি।
সংগ্রাম আর মুক্তির আন্দোলনে হারিয়ে যাওয়া সকল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। নির্যাতিত সকল নেতাকর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন প্রত্যাশা করি। ছাত্রলীগের অনুভূতি, ভালবাসা,আস্থা, ভরসা, বিশ্বাসের একমাত্র অভিভাবক বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব বাছাই করা হোক ছাত্রলীগে। শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ পরিচালক, বঙ্গবন্ধু চর্চা কেন্দ্র বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
এইচআর/জেআইএম