স্যালুট ওমেন অফ কালার
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ গুলোর মধ্যে একটি এবং অন্যতম ধনী দেশ এ ব্যাপারে গোটা বিশ্বের কারোরই নিশ্চয়ই কোন সন্দেহ নেই। জীবনযাপনের মান, সুযোগ, সুবিধা, নাগরিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছুর মাপ কাঠিতেই অনেক এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যান্য অনেক উন্নয়নের সাথে সাথে এদেশে মেয়েদের জীবনযাপনের মানও ঈর্ষণীয়। মেয়েদের নিরাপত্তা অনেক বেশি। স্বাধীনতা অনেক বেশি। সামাজিক ব্যবস্থাও অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েদের অনেক অনুকূল। পোশাক আশাকের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে ব্যক্তি স্বাধীনতা সব কিছুই অনেক বেশি। মেয়েরা পড়ালেখা করবে এটা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি প্রায় সব ধরনের কাজেই মেয়েদের সুযোগ আছে।
মেয়ে বলে কেউ কোন কাজ করতে পারবে না, এমন কোন লিখিত কোন আইনের কথা শোনা যায় না। বরং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা অন্যান্য যেসব ক্ষেত্রে মেয়েদের পদচারণা কম সেসব ক্ষেত্রে মেয়েদের আলাদা কোটা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বা চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এতো কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পরও কিন্তু মানুষের মনের আঁধার পুরোপুরি ঘোচে না। আইনের বেড়াজাল দিয়ে মানুষের অনেক সুযোগকে দমিয়ে রাখা যায়। সেই বেড়াজাল তুলে নিলে সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত হয়। কিন্তু আইনের শাসন দিয়ে মানুষের মন কিন্তু উন্মুক্ত করা যায় না। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। এরা মেয়েদেরকে এতো এগিয়ে যেতে দেখেছে, কিন্তু মন থেকে পুরোপুরি মেনে নিতে পারছিল না যে মানুষ হিসেবে একটি মেয়ে এবং ছেলে সমান। রাষ্ট্রশাসনের মতো কঠিন কাজ নারী দ্বারা সম্ভব। এতো বড় গুরু দায়িত্ব কোন মহিলার হাতে দেওয়ার মতো আস্থা তাদের মনে গড়ে উঠেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রধান সমস্যা ছিল বর্ণবাদ। ছিল না বলে বরং এখনও আছে বলা ভালো, তবে সেই সমস্যাও অনেক সংগ্রাম ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে আগের তুলনায় কমে এসেছে। আফ্রিকান আমেরিকানরা ১৮৭০ সালে প্রথম ভোটাধিকার পায়। তার আগে তাদের ভোট দেওয়ার মতো ন্যূনতম নাগরিক অধিকার ছিল না। ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। যেটা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক বিরাট অধ্যায়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে মহিলারা ভোটাধিকার পায় আফ্রিকান আমেরিকানদেরও অনেক পরে, ১৯২০ সালে। তারপরে পুরো একশ' বছর লাগলো যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মনের আঁধার দূর করতে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলো এবারের নির্বাচনে। কামালা হ্যারিস শুধু প্রথম নারীই নন, তিনি একাধারে ভারতীয় এবং আফ্রিকান আমেরিকান বংশোদ্ভূত। এর আগে ২০১৬ সালের নির্বাচনে যখন হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে অংশ নেন, তাঁর একটা কথা আমার এখনো কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ মহিলা পদপ্রার্থীদেরকে দেখে পুরুষের লেন্স দিয়ে, অর্থাৎ পুরুষদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কত।
হিলারি যদিও শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান তার পরেও নারী রাষ্ট্রপ্রধানকে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি সংখ্যা গরিষ্ঠ আমেরিকানরা, যার মধ্যে অনেক নারী ভোটারও ছিল। তবে, বিগত চার বছরে আমেরিকানদের মন মানসিকতার উন্নতি হয়েছে দেখা যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেন যখন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করলেন মহিলা সিনেটর কামালা হ্যারিসকে তখন ডেমোক্র্যাট দলের অনেকেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়, এইবারও হয়তো যোগ্যতা থাকা স্বত্ত্বেও এই জুটি হেরে যাবে মহিলা প্রার্থীর কারণে। যেমনটি হেরে গিয়েছিলেন রিপাবলিকান দলের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জন ম্যাককেইন তার সাথের মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সারাহ পালিনের কারণে। কিন্তু অবশেষে আমেরিকান জনগণ কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি দিয়েছে নারী পুরুষ ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে।
এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে অনেক ধন্যবাদ। সিনেটর কামালা হ্যারিসের মা শ্যামালা গোপালান হ্যারিসের জন্ম ভারতের চেন্নাইয়ে। তিনি ঊনিশ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। কামালা হ্যারিসের বাবাও জামাইকান। ইমিগ্র্যান্ট বাবা, মায়ের সন্তান সিনেটর হ্যারিস বলেছেন তাঁর সমস্ত সাফল্যের পেছনে আছে তাঁর মায়ের অবদান। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর এই বিজয় আমেরিকার ইতিহাসে এক বিরাট মাইল ফলক। আজকের এই দিনটি আমেরিকার নারীদের জন্য এক স্বপ্নের দ্বার খুলে দিল। আশা জ্বালালো অসংখ্য ইমিগ্র্যান্ট বাবা, মায়ের সন্তানদের মনে। বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন নাম হয়ে দেখা দিল, 'সম্ভাবনা'। যেমনটি বলেছেন নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, নির্বিশেষে সব মানুষের মনে আশা জাগানোর জন্য স্যালুট সেনেটর কামালা হ্যারিস, ওমেন অফ কালার।
এইচআর/এমএস