ব্যাটারিচালিত রিকশামুক্ত সড়কের জন্য
সম্প্রতি বিপজ্জনকহারে বেড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। ফাঁকা রাস্তায় এসব রিকশার গতি প্যাডেলচালিত রিকশার চেয়ে অন্তত চারগুণ বেশি হয়। অর্থাৎ যাত্রীসহ একটি প্যাডেলচালিত রিকশার গতি যেখানে সর্বোচ্চ ওঠে ১০-১২ কিলোমিটার, সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশার গতি ওঠে ৪০ কিলোমিটারেরও বেশি। এই প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত গতিই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটলে অন্য কোনো বাহন বা বাহনের যাত্রীর তেমন ক্ষতি না হলেও, দ্রুতগামী ব্যাটারিচালিত রিকশার যাত্রী ও চালক—উভয়ই আহত হন।
ব্যাটারিচালিত রিকশায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্যাডেলচালিত রিকশার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তবু এই ব্যাপারে দেশের সুশীল সমাজ নীরব। প্রশাসনেরও নজরদারি নেই এদিকে। এই নীরবতা-নজরদারিহীনতার পেছনে অনৈতিক লেনদেনের সম্পর্ক যেমন আছে, তেমনি আছে ‘অনবধানতাবশত’ মানবিক হওয়ার ভানও। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বাহনটিকে রাজধানীতে চলার অনুমতি দেন বখশিসের বিনিময়ে। এই ধরনের অনুমতির ক্ষেত্রে মাসোহারা হিসাবে পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা যে অবৈধ অর্থের লেনদেন করেন, তার পরিমাণও বিস্ময়কর। এলাকা ও সময় ভেদে এই অর্থের পরিমাণ ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত গড়ায়। অর্থাৎ প্রতিবছর ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশার চালক-মালিকরা চাঁদা হিসেবে সাড়ে তিনশ কোটি টাকা পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের দেন। এই কারণে প্রশাসন জেনে-শুনে-বুঝেও না দেখার ভান করে।
আর সুশীল সমাজ এই বাহনের ভয়াবহতার দিকটি উপেক্ষা করে চালকদের প্রতি কৃত্রিম দরদ দেখায়। তাদের যুক্তি, প্যাডেলচালিত রিকশায় চালকের কষ্ট বেশি। ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের সেই কষ্ট থেকে রেহাই দেয়। তাই এই যুক্তিতে রাজপথে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের পক্ষে অভিমত তাদের। এই মহলের এমন অভিমতের পেছনে কিঞ্চিৎ দরদ থাকলেও থাকতে পারে। তবে, বাস্তবতা উপলব্ধির লেশমাত্রও সেখানে নেই। অথচ প্রশাসন ও সুশীল সমাজ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারলে, বুঝতে পারতো বাহনটি সমাজের জন্য কোনোভাবেই উপকারী তো নয়ই, উপরন্তু কখনো কখনো প্রাণঘাতী। মানুষের পঙ্গুত্বের জন্য দায়ীও। ব্যাটারিচালিত রিকশা যে কারণে বিপদ ডেকে আনে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
১. চাকার আকার ও গতি
২. সিট
৩. চেইন ও ফ্রি হুইল
৪. ফ্রেম ও বডি
৫. হ্যান্ডলবার ও ব্রেক
৬. রিং-টায়ার-টিউব ও স্পোক
একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই—যেকোনো যানবাহনের আকৃতির সঙ্গে চাকার আকৃতি ও গতির সম্পর্ক সুনিবিড়। আকৃতি অনুযায়ী এর চাকার পরিমাপ নির্ধারণ করেন প্রস্তুতকারকরা। বাহন যত ছোট, তার চাকাও তত ছোট। এ কারণে অপেক্ষাকৃত বড় যানবাহনের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট যানবাহনের চাকা ছোট হয়ে থাকে। গতিও তাই কম হয়। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান-লরি কিংবা বাসের জন্য যে ধরনের চাকা ব্যবহার করা হয়, প্রাইভেটকার বা সিএনজির জন্য সে আকারের নয়। প্রথমোক্ত গাড়িগুলো আকারে বড় ও ভারি। তাই এগুলোর চাকাও বড়। চাকা বড় হলে গতিও বেশি। গতি বেশি হলেও এসব বাহনের ভারের কারণে কখনো ভারসাম্য হারান না চালকরা। তেমনি প্রাইভেটকার কিংবা সিএনজি অপেক্ষাকৃত হালকা বাহন। এগুলোর চাকাও ছোট। চাকা ছোট বলে গতিও অপেক্ষাকৃত কম।
বিপরীতে রিকশা হলো সবচেয়ে হালকা শ্রেণির অযান্ত্রিক বাহন। অযান্ত্রিক হওয়ার কারণে এর গতি কম। গতি কম বলেই চাকা বড় হয়েছে, ব্যাপার তেমন নয়। প্রকৃত কারণ হলো, চাকার আকারের সঙ্গে চালকের বসার সিটের নির্দিষ্ট দূরত্ব রক্ষা করা। যেটুকু দূরত্ব রক্ষা করলে চালকের প্যাডেল চালাতে বেগ পেতে হবে না, ততটুকুই দূরত্বের স্বার্থেই ওই পরিমাণ চাকার আকারও নির্ধারণ করা হয়েছে। রিকশার মতো বাইসাইকেলেরও একই নিয়ম।
প্যাডেলচালিত রিকশায় চালকের কষ্ট হয়—এমন অজুহাতে ব্যাটারিচালিত মোটর যুক্ত করা হয়েছে কিছু রিকশায়। কিন্তু যারা রিকশায় ব্যাটারিসহ মোটর যুক্ত করেছেন, তারা ভাবেননি, গতি অনুযায়ীই চাকার আকার ও বাহনের ফ্রেমের পুরুত্ব নির্ধারণ করা হয়। গতির সঙ্গে মিল রেখেই প্যাডেলচালিত রিকশারও চাকার পরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে। এই চাকার যে আয়তন, তাতে প্যাডেল দিয়ে চালালে সর্বোচ্চ গতি ১০-১২ কিলোমিটার হবে। এই গতিতে রিকশা চালালে চালক তার শরীর ও বাহনের ভারসাম্য বজায় রাখেন। কিন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশার গতি যখন ২৫-৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ওঠে, তখন চালক নিজের ও বাহনের ভারসাম্যক রক্ষা করতে পারেন না। এই না পারার জন্য চাকার আকারের কারণে বাহনের উচ্চতা দায়ী।
ভূমি থেকে বাহনের উচ্চতার সঙ্গে এর মধ্যাকর্ষণশক্তির সম্পর্ক রয়েছে। স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে বেশি উচ্চতায় উঠে অতিরিক্ত গতিতে চললে মধ্যাকর্ষণশক্তির কারণেও চালক তার শরীর ও বাহনের ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হন। এরফলে প্রয়োজনে হঠাৎ ব্রেক কষতে গেলেই বিপত্তি ঘটে। টাল সামলাতে না পেরে রিকশা উল্টে যেতে পারে, পড়ে যেতে পারে কাত হয়েও। এই ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে।
এদিকে, রিকশার চেইন ও ফ্রি হুইল যেমন, সরু তেমনি হালকাও। এই চেইন ও ফ্রি হুইল বাহনটির আকার, ভার ও গতির সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে। রিকশা প্যাডেলচালিত হওয়ায় এই সরু-হালকা চেইন ফ্রি-হুইলের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। কিন্তু মোটর লাগানোর ফলে এর গতি বেড়ে চেইন হয়ে ওঠে বিপজ্জনক। স্বাভাবিক সামর্থ্যের চেয়ে অতিরিক্ত-অনিয়ন্ত্রিত গতির ঘূর্ণনের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য উপযুক্ত নয় এই ধরনের চেইন। এজন্য কেউ কেউ মোটরসাইকেলের চেইন রিকশায় মোটর ও ফ্রি-হুইলের সঙ্গে সেট করে দেন। এতে চেইন কিছুটা তাল সামলাতে সক্ষম হলেও এর ফ্রেম ও বডি মোটরের কম্পনে সঙ্গতি রক্ষা করে চলতে পারে না। এছাড়া গতি ও কম্পনের সঙ্গে হ্যান্ডলবার ও ব্রেকও তাল মেলাতে বাধার সৃষ্টি করে।
ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত গতি ও মোটরের কম্পনের কারণে দ্রুত স্পোক ছিঁড়ে যেতে পারে। স্পোক ছিঁড়ে গেলে রিং টাল হয়ে যায়। এছাড়া, স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুণ বেশি গতিতে চলায় চাকার টায়ার দ্রুত ক্ষয় হতে থাকে। এই বাহনের ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার জন্য বিদ্যুতের অপচয়ও হয়। বাদ যায় না পরিবেশদূষণও।
প্রকৌশলজ্ঞান বিবর্জিত অপরিণামদর্শী মেকানিকের পক্ষে এমন উদ্ভট বাহনের পক্ষে কথা বলা সহজ। কিন্তু গতিবিজ্ঞান-মধ্যাকর্ষণশক্তি ও যানবাহন বিষয়ে ন্যূনতম ‘বৈজ্ঞানিক-কার্যকারণ সম্পর্ক’ জানা মানুষের পক্ষে এই বাহনকে সমর্থন করা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ তারা জানেন, ভাষার গোঁজামিল দিয়ে বক ও কচ্ছপের মিলনে ‘বকচ্ছপ’; হাতি ও তিমির মিলনে ‘হাতিমি’ নামে কোনো প্রাণির ‘নামকরণ’ সম্ভবও হতে পারে, কিন্তু সৃষ্টিজগৎ এমন বিদঘুটে প্রাণির অস্তিত্ব স্বীকার করে না। অর্থাৎ বিজ্ঞানের চোখে রিকশায় ব্যাটারিসহ মোটর লাগানো আর গরুর গাড়িতে রেলের ইঞ্জিন বসানোর চেষ্টা একই অর্থ বহন করে। এই সত্য প্রশাসন-সুশীল সমাজ যত দ্রুত বুঝবে, ততই মঙ্গল।
লেখক : কবি-প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম