রায়ে শাস্তি, জনমনে স্বস্তি
খুলনায় একটি মাদক মামলায় একজনকে এক বছর সাজা দেয়ার বিষয়টি স্বস্তিদায়ক। মাদকের বিস্তার রোধ করতে হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
আরও আশাব্যঞ্জক খবর যে, মাত্র তিন কার্যদিবসে রায় ঘোষণা করেছেন আদালত। দেশের বিচার ব্যবস্থাপনায় এত দ্রুত রায় ঘোষণার ঘটনা এটিই প্রথম। গতকাল মঙ্গলবার (২৭ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খুলনা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (আদালত নং-৪) ড. মো. আতিকুস সামাদ এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মামলার একমাত্র আসামি মো. সম্রাটকে (২৬) গাঁজা রাখার অপরাধে ছয় মাস এবং ইয়াবা রাখার অপরাধে আরও ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। এছাড়া আসামিকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। রায় ঘোষণার সময় আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর মহানগরীর লবণচোরা থানা এলাকা থেকে মো. সম্রাটকে পুলিশ আটক করে। এ সময় তার কাছ থেকে ৩০ গ্রাম গাঁজা ও ৬ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সম্রাটকে আসামি করে লবণচোরা থানায় মাদকদ্রব্য আইনে মামলা হয়। চলতি বছরের ২১ অক্টোবর আদালত চার্জ গঠন করেন। ২২ অক্টোবর ৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ২৫ অক্টোবর যুক্তিতর্ক ও আসামি শনাক্ত শেষে আদালত এই রায় ঘোষণা করেন।
নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভবান ব্যবসা। বিশেষ করে ফেনসিডিল ও ইয়াবা সহজলভ্য ও বহনযোগ্য বলে এর বিস্তার দেশজুড়ে। সত্যি বলতে কি দেশের এমন কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে মাদকের থাবা নেই। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজন মাদককারবারের সাথে জড়িত। তারা বিভিন্ন কলাকৌশলের আশ্রয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে। সত্যি বলতে কি দেশজুড়ে এক বিশাল জাল বিস্তার করে আছে এই মরণ নেশার ভয়াবহ সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র মাফিয়াদের সঙ্গে রয়েছে এদের শক্ত ও গভীর যোগাযোগ। মাদকের রয়েছে বিভিন্ন রুট।
বিমানবন্দর থেকে শুরু করে স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, সীমান্ত এলাকায় মাদকের ছড়াছড়ি। এর কিছু ধরা পড়ে। বাকিটা চলে যায় মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের কাছে। রাজধানীতেও মাদকব্যবসা রমরমা। মাদকের জগতে এক সময় ‘হেরোইন’ নামক মরণ নেশা ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। এ পদার্থটি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ করে অবধারিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এটি খুব দামি বলে পরবর্তী সময়ে এর স্থান দখল করে নেয় ফেনসিডিল ও ইয়াবা। বর্তমান নেশাসক্ত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ দুটি নেশাদ্রব্য বেশি জনপ্রিয়। একে ঘিরে দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে বিশাল নেটওয়ার্ক। ফেনসিডিলের চেয়ে ইয়াবাই বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। তার বিষাক্ত ছোবল শেষ করে দিচ্ছে তারুণ্যের শক্তি ও অমিত সম্ভাবনা। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের অবক্ষয়, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির অসামঞ্জস্যতা, হতাশা এবং মূল্যবোধের অভাবের সুযোগ নিয়ে মাদক তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তরুণ সমাজের প্রতি। বেকারত্বও মাদকের বিস্তারে সহায়ক-এমন কথাও বলছেন বিশ্লেষকরা। এই মরণ নেশার বিস্তারে সমাজে একদিকে যেমন অপরাধ বাড়ছে, তেমনিভাবে নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা। এই অবস্থা চলতে থাকলে একটি সমাজের অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে হলে মাদকদ্রব্যের প্রাপ্তি সহজলভ্য যাতে না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে মাদকের অনুপ্রবেশ। দেশেও যাতে মাদকদ্রব্য উৎপাদন হতে না পারে সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে হবে। দুঃখজনক হচ্ছে, মাঝে-মধ্যে ছোটখাট মাদক কারবারী ও মাদকের চালান ধরা পড়লেও তাদের মূল কুশীলবরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, সমাজের প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তিবর্গ এসব সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত থাকায় তাদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারে না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি।
মাদকের সর্বনাশা দিক নিয়ে আমরা সম্পাদকীয় স্তম্ভে অনেকবারই লিখেছি। কিন্তু অবস্থার কোনো হেরফের হয়নি। মাদকের ভয়াল থাবা থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে মাদক সিন্ডিকেট যতই শক্তিশালী হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতারও কোনো বিকল্প নেই। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিকতার উন্মেষ ঘটাতে হবে।
এইচআর/জেআইএম