অবহেলিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত রেমিট্যান্স যোদ্ধা!
মানুষ স্বভাবগতভাবে শিকড়মুখী। তারা শিকড়েই থাকতে চায়, শিকড়েই ফিরতে চায়। তারপরও মানুষ পরিযায়ী পাথির মতো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। কখনো ইচ্ছায়, কখনো অনিচ্ছায়। অতি অল্পকিছু মানুষ কিছু হুমকি, হামলা, মামলা ম্যানেজ করে নিরাপত্তার অজুহাতে বিদেশে পাড়ি জমায় উন্নত জীবনের আশায়। তথাকথিত উন্নত জীবনের দেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার পর তাদের অনেককে আবার দেশের জন্য মায়াকান্না কাঁদতেও দেখা যায়। তবে সব রাজনৈতিক আশ্রয় একরকম নয়। কিছু কিছু মানুষের জীবন সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ। আর কিছু মানুষ অনেক চেষ্টা করে নিজেদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলেন রাজনৈতিক আশ্রয়ের আশায়। যে মুক্তচিন্তা বা মতপ্রকাশ স্বাধীনতার ধোয়া তুলে তারা রাজনৈতিক আশ্রয় চান, বিদেশে গিয়ে সেই মতপ্রকাশের বিষয়টি ভুলে গিয়ে তারা নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। অল্পকিছু মানুষ আছেন যারা ঘুরতে যান। তবে বেশিরভাগ মানুষই বিদেশে যান ভাগ্য বদলাতে, পরিবারকে ভালো রাখতে। শেষভাগের এই মানুষগুলো বিদেশে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেন, নিজেকে এবং পরিবারকে ভালো রাখতে।
যারা বিদেশে চলে যান, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি দেশ থেকে দূরে গেলে দেশের প্রতি ভালোবাসা আরও বাড়ে। আপনি দেশে বসে যতটা দেশের খবর রাখেন, তারা দেশের বাইরে বসে তার চেয়ে বেশি রাখেন। সারাক্ষণই তারা দেশের খুঁটিনাটি নিয়ে ভাবেন। দেশের বাইরে গিয়ে আন্তর্জাতিক হতে পারেন খুব কম মানুষ। দেশের জন্য কাঁদা, শিকড়ের টান অনুভব করা মানুষই বেশি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি তিনটি। কৃষি, রফতানি মানে গার্মেন্টস আর রেমিট্যান্স। আমাদের অর্থনীতির রহস্যটাই হলো সস্তা শ্রমে। কৃষিতে শ্রমের দাম তো অনেক সময় গোনায়ই ধরা হয় না। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের সাফল্যের পুরোটাই সস্তা শ্রমনির্ভর। রেমিট্যান্সটাই আসেন মূলত এই সস্তা শ্রম থেকেই। আমি হিসাবটা পুরো জানি না, কিন্তু রেমিট্যান্সের বড় অংশটা আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। যারা আমেরিকা বা ইউরোপে গিয়ে সেটেল করেন, দেশের সাথে তাদের যোগাযোগ একটু কমই থাকে। তারা ধীরে ধীরে পরিবার নিয়ে যান এবং একেবারে সেটেল করেন। তাই তাদের দেশে টাকা পাঠানোর তাগিদ থাকে না।
কিন্তু যারা মধ্যপ্রাচ্যে যান, তারা আয়ের প্রায় পুরো টাকাটাই দেশে পাঠিয়ে দেন। তাদের পাঠানো টাকাতেই আমাদের রিজার্ভ ফুলে ফেঁপে ওঠে। বর্তমানে বাংলাদেশে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ চার হাজার কোটি ডলার, যা পাকিস্তানের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি। কিন্তু নিজের ঘামকে রক্তে পরিণত করে যারা দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করে, তাদের অবস্থা কী?
পরিবারে যিনি বা যারা আয় করেন তাদের সম্মানই সবচেয়ে বেশি হয়। দেশের ক্ষেত্রেও তাই হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে হয় উল্টো। কৃষকদের তো কোনো দামই নেই। গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রায়ই নিজেদের দাবি আদায়ে রাস্তায় নামতে হয়। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা প্রবাসীদের। সম্মান, মর্যাদা তো অনেক পরের কথা; পদে পদে তাদের মেলে শুধু লাঞ্ছনা আর অপমান। করোনার শুরুর দিকে ইতালি থেকে আসা এক ব্যক্তি বাংলাদেশকে গালি দিয়েছিল বলে আমাদের অনেকে বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। অনেকে তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাকে পাল্টা গালাগালও করেছেন। কিন্তু আমার একটুও মন খারাপ হয়নি। বরং মনে হচ্ছিল, আমি তার জায়গায় থাকলে কতটা সংযত থাকতে পারতাম।
একটি পরিবার ইতালিতে মোটামুটি উন্নত জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তীব্র আবেগ আর ভালোবাসা নিয়ে দেশে ফেরার পর দাগী আসামির মতো তাদের নিয়ে যাওয়া হয় হজক্যাম্পে। তাদের সামনে রেখেই হজক্যাম্প ঝাড়ু দেয়া হচ্ছিল। সেখানে সবাইকে ফ্লোরে থাকতে হবে। কোন অপরাধে তাদের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এমন একটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হবে? একটি মানসম্পন্ন কোয়ারেন্টাইন সেন্টার না বানিয়েই আমরা বিদেশ থেকে আসা মানুষদের অপরাধীর মতো ঠেলে দিয়েছিল অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার জন্য। বিমানবন্দরে কঠোর মনিটরিং করতে পারিনি, একটা ভালো কোয়ারেন্টাইন সেন্টার বানাতে পারিনি। অথচ পরে স্থানীয় প্রশাসন বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রবাসীদের খুঁজে বেরিয়েছে। প্রবাসীদের বাড়ির সামনে লাল পতাকা ঝুলিয়ে দিয়েছে। করোনা লকডাউনে গ্রামের অনেক দোকানের সামনে লেখা থাকতো ‘এখানে প্রবাসীদের প্রবেশ নিষেধ’। কী ভয়ঙ্কর অপমান! আমি ভেবেছিলাম বিমানবন্দরে এই অব্যবস্থাপনা এবং বাড়ি বাড়ি খুঁজে অপমান করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কেউ দুঃখ প্রকাশ করবে। কিন্তু ঘটেছে উল্টো ঘটনা। স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রবাসীদের ‘জমিদার’ বলে গালি দিয়েছেন।
দেশে ফেরার সময় তো পদে পদে অপমানিত হতেই হলো, কর্মক্ষেত্রে ফেরার সময় অপমান রূপ নিলো ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তায়। ফলাফল বিক্ষোভ আর লাঠিচার্জে। চরম অনিশ্চয়তার মুখে সৌদি আরব আর ইতালি প্রবাসীদের রাস্তায় নেমে আসতে হয়েছিল।
আকামা (কাজের অনুমতি), ভিসা, টিকিট নিয়ে অনিশ্চয়তায় পরতে হয়েছিল তাদের। সৌদি এয়ারলাইন্সের অফিস রাজধানীর অভিজাত প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল ক্যাম্পাসে। পয়সা দিয়ে কেনা টিকিট পেতে তাদের সেখানে দিনের পর দিন ধর্না
দিতে হয়েছে। সোনারগাঁওয়ের সামনের রাস্তা অবরোধ করে তারা বিক্ষোভ করেছেন।
প্রবাসীকল্যাণ নামে আমাদের একটা মন্ত্রণালয় আছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, এই মন্ত্রণালয় প্রবাসীদের কল্যাণের জন্য আসলে কী করে? সৌদি কর্তৃপক্ষ যে শর্ত দিয়েছিল, তা কখনোই একজন ব্যক্তির পক্ষে পূরণ করা সম্ভব ছিল না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়পরে অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেন তারা আগে থেকে প্রস্তুতি নেননি? কেন প্রবাসীদের রাস্তায় নেমে তাদের ঘুম ভাঙাতে হয়েছে? একদিন বিক্ষুব্ধ প্রবাসীরা সোনারগাঁওয়ের সামনের গেট টপকে মূল গেটের কাছে চলে গিয়েছিল। সেদিন তাদের ঠেকাতে পুলিশকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ছবিটি দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। যাদের ঘামে অর্জিত অর্থে আমাদের অর্থনীতি বেগবান হয়, সেই অর্থে আমরা সোনারগাঁওয়ের লবিতে বসে হাজার হাজার টাকা উড়িয়ে দেই; সেই লবিতে তাদের প্রবেশাধিকারই নেই। হায় অকৃতজ্ঞ জাতি।
কেউ কেউ বলতে পারেন, এই হয়রানি তো করোনার কারণে, বিশেষ পরিস্থিতিতে। তারা কি কখনো আসা-যাওয়ার পথে বিমানবন্দরে প্রবাসীদের ভোগান্তির চিত্র দেখেছেন? আমি বলতে পারি, আমাদের সরকার, কর্তৃপক্ষ এই প্রবাসীদের মানুষই
মনে করে না। তারা সবাই আদম। প্রবাসী শ্রমিকদের অনেকেই দক্ষ নয়, শিক্ষিত নয়। বিমানবন্দরে নানা ফরম পূরণ করতে তাদের কষ্ট হয়। এই জন্য পদে পদে তাদের তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়। ন্যায্য দামে টিকিট কেনেই তারা বিমানে ওঠেন। কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমিক শুনলেই বিমানের ক্রু থেকে শুরু করে সবাই তাদের অবহেলা করে। যেন তারা ভুল করে বিমানে উঠে পড়েছে বা বিনা টিকিটের যাত্রী। পারলে তাদের দাঁড় করিয়ে নিয়ে যায়। এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের কথা বাদ দিন, বিদেশে তারা কোনো বিপদে আপদে পড়লে আমাদের দূতাবাসও ঠিকমতো তাদের পাশে দাঁড়ায় না। সারাক্ষণ ধুরছাই করে। প্রবাসী শ্রমিকদের দেখলে আমার এখনও কেন যেন দাসপ্রথার কথা মনে হয়। প্রবাসীরা আসলে সরকারের বিরুদ্ধে, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে, এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে পারে।
প্রবাসীদের যে আমরা পদে পদে হেয় করি, অপমান করি, লাঞ্ছিত করি; সেটা কিন্তু তাদের প্রাপ্য নয়। তারা নিজেদের পয়সায় বিদেশে যায়, সরকারের সঠিক মনিটরিঙের অভাবে বিদেশে যেতে গিয়ে অনেকে প্রতারিত হয়, বিদেশে গিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। এতকিছুর পরও তাদের দেশেপ্রেমে কোনো ঘাটতি নেই। বহু পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ তারা বিদেশে উড়ায় না। পাই পাই করে দেশে পাঠায়। নিজের, পরিবারের, সন্তানের ভবিষ্যত গড়ে; দেশের রিজার্ভ ফুলিয়ে তোলে।
সরকারের কাছে আমার চাওয়া খুব সামান্য। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় যেন সত্যি সত্যি প্রবাসীদের কণ্যাণে কাজ করে। তার চেয়ে বড় কথা শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধা বলে হাওয়াই গালভরা অভিধা না দিয়ে প্রবাসীদের যেন আমরা সবাই একটু মর্যাদা দেই, অন্তত যেন মানুষ মনে করি।
এইচআর/বিএ/জেআইএম