শমীর তৃতীয় বিয়ে ও ধর্ষক মনোবৃত্তি
ক’দিন ধরে অনেকেই টেক্সট করছেন, কেউ কেউ ফোনও করেছেন আমাকে। বলেছেন, এত এত ধর্ষণ হচ্ছে- মেয়ে, মহিলা, শিশু, বৃদ্ধা কেউ বাদ যাচ্ছে না। অথচ আপনি কিছুই লিখছেন না, বলছেন না, প্রতিবাদও করছেন না। আমি টেক্সট পড়ি, ফোন শুনি, বলি না কিছু। ঘুম থেকে ওঠে ধর্ষণের খবর, ঘুমাতে যাওয়ার আগে শেষ খবরটিও ধর্ষণের। যে যাকে পারছে, যেভাবে পারছে, যেখানে পারছে ধর্ষণ করছে।
ধর্ষণের সঙ্গে যৌনতার চেয়ে বিকৃতির সম্পর্ক বেশি। বিকৃতির কারণেই লোকে ধর্ষণ করে, যৌনতার কারণে নয় কিন্তু। আমার অনেকটা সময় কেটেছে মনস্তত্ত্ব আর বিকৃতি নিয়ে লেখাপড়ায়। ইউনিভার্সিটি অব ট্রান্সবুর্গ এর মনোবিদ আকটার এর কাছে আমি যার পর নাই কৃতজ্ঞ। বিকৃতি বুঝতে তিনি আমাকে সহযোগিতা করেছেন উদারভাবে। ফ্রয়েড আর লাঁকান এখনও আমার পাঠ্য।
চারপাশে ধর্ষণ বাড়ছে। ধর্ষণে থৈ থৈ করছে। মাঠ, ঘাট, ঘরবাড়ি, অফিস, রেস্টুরেন্ট, মার্কেট, উপচে পড়ছে ধর্ষণে। তার মানে বিকৃতিতে ভরে গেছে চারপাশ। বিকৃতির এক ঠাসবুনটের মাকড়সা জালে বাস করছি আমরা। যতই সরাতে যাই এই জাল আরো জড়িয়ে ধরে, জাপটে ধরে। বিকৃতি আরো গভীরভাবে বুঝতে আমাকে সাহায্য করে ‘শমী কায়সারের আবারো বিয়ে’র খবরটি। খবরটি আমার কাছে একটি স্যাম্পলিং। সামাজিক বিকৃতি বোঝার স্যাম্পলিং। ‘শমী কায়সারের আবারো বিয়ে’র খবরটি যেখানেই প্রকাশিত বা শেয়ার হয়েছে তার নিচে কত শত শত কমেন্টস। কমেন্টসগুলো খুবই কুৎসিত, অসুস্থ, বিকারগ্রস্থ। যারা এই বিয়েকে আক্রমণ করেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকই ভেতরে ভেতরে একেক জন ধর্ষক, বিকৃত।
এদেশে ধর্ষণ হবে না তো হবে কোন দেশে? যে দেশে নারীর প্রতি ন্যূনতম সম্মান নেই, মানুষের প্রতি ন্যূনতম মানবিকতা নেই, জুলুম ও অরাজকতা যেখানে প্রায় নিয়ম, অন্যায় অনিয়ম সেখানে বেশির ভাগ লোকের কাম্য সেখানে ধর্ষণের এই সংখ্যা বরং নগণ্য। অন্যায় আর অসভ্যতার চাষাবাদ যেখানে কথিত বড় বড় মানুষদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়, দুধ কলা পায়, সেখানে রাজনৈতিক অরাজনৈতিক জুলুম বাড়বে, বিকৃতির চারাগাছ বটগাছে পরিণত হবে- এতো খুবই স্বাভাবিক।
শমী কায়সার একজন সাবেক অভিনেত্রী এবং উদ্যোক্তা। তিনি আবারো বিয়ে করেছেন। এর আগেও তিনি বিয়ে করেছিলেন। ডিভোর্স হয়েছে। বিয়ে যেমন হতে পারে, ডিভোর্সও হতে পারে। বিয়ে যেমন অন্যায় নয়, ডিভোর্সও অন্যায় নয়। ববং যে কোনভাবে, ‘অ্যাডজাস্ট’ না হলে দুজন মানুষের জোর করে একত্রবাস অন্যায়। মনে রাখতে হবে, কখনও কখনও একত্রবাস দুঃসহবাসও হতে পারে।
বরং অ্যান্টি ডিভোর্স সোসাইটিতে লোকে সামাজিক কারণে ডিভোর্সকে ভয় পায়। জোড়াতালি দিয়ে থাকে। বেড়ে যায় গৃহনির্যাতন, নিপীড়ন। জীবন হয়ে ওঠে দূর্বিসহ। নির্যাতিত হয় পুরুষ ও নারী উভয়ই। চুলোচুলি হয়, মারামারি হয়, ধস্তাধস্তি হয়, হত্যা হয়, খুন হয়। হয় আত্মহত্যা।
যে সমাজে আমাদের বসবাস, তা বড় ভানভনিতায় ঠাসা। ভেতরে সম্পর্ক নেই, কিন্তু ফেসবুকে ‘কাপল সেল্ফি’ আছে। জোর করে বোঝাতে হবে, ‘ভাল আছি, ভাল আছি’। লোক দেখাতে হবে। কিন্তু জীবনতো যার যার। কেউ এসে আমার জীবনটি যাপন করে দেবে না। আমার জীবনটি শেষাবধি আমারই। আমার জীবনটি আমাকেই যাপন করতে হবে।
শমীর জীবনটিও শমীরই। তার জীবনের সকল সিদ্ধান্ত তারই। জীবন এক বহতা নদীর মতো। সেই নদীর কোথায় কোন বাক, কোথায় এসে কাকে কখন দাঁড়াতে হবে তা কেউ জানে না। কেউ জানে না কার জীবনের গতি প্রকৃতি কী, পরিণতি কী? তার জীবনটি তাকেই বহন ও যাপন করতে দিন।
মনে হতে পারে, আমি শমীর পক্ষ নিচ্ছি। মোটেও তা নয় কিন্তু। আমি অন্যের সমালোচনা, অন্যকে অসম্মান আর অসভ্যতার প্রতিবাদ করছি। এই আমিই প্রতিবাদ করে লিখেছিলাম যখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আসিফ নজরুলের সঙ্গে শীলার বিয়েকে নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন, সুমাইয়া শিমুর কুচকুচে কালো স্বামী নিয়ে তামাশা করেছিলেন কেউ কেউ।
মহান আল্লাহতায়ালা সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। জীবন ও জীবিকা সব কিছুর মালিক একমাত্র তিনি। তা হলে কেন আমরা অন্যকে নিয়ে, অন্যের জীবন নিয়ে তামাশা করছি? তার কোন অধিকার কি আমরা কেউ রাখি? এ নেহাত অন্যায় আর অসভ্য ভিন্ন আর কিছু নয়। নয় তো নিজের প্রতি অহংকার, যার আরও অন্যায়।
অন্যের নিন্দা না করে, তামাশা না করে, সমালোচনা না করে, টিটকারি- ইতরামি না করে আসুন মানবিক হই, সম্মান করতে শিখি মানুষকে।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/পিআর