বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের বিগ পিকচার

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৮:৩৩ এএম, ১০ অক্টোবর ২০২০

‘বিগ পিকচার, উই নিড টু লুক এট বিগ পিকচার’। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিক্রম দোরাইসোয়ামী এভাবেই দেখতে চান তার দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ককে। পাশাপাশি দুটি দেশ যদি দ্রুত উন্নয়নের পথে এগুতে চায়, তাহলে পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই। সম্পর্কের উষ্ণতায় নিজেদের বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটিকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে না পারলে কারও উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ও ভারত এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়।

আগেরদিন গুলশানের ইন্ডিয়া হাউজে এক মিডিয়া ব্রিফিং-এ তিনি বলেছেন, “আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই বাংলাদেশ সবসময় ভারতের অত্যন্ত বিশেষ অংশীদার ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে”।

বিক্রম দোরাইসোয়ামী এমন এক সময় এলেন যখন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর উদযাপন চলছে এবং এদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এবং মনে রাখা দরকার যে, আগামী বছরটি ভারত বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কেরও ৫০ বছর।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একে অপরের দেশ সফর করছেন। প্রতিটি যোগাযোগেই অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের প্রসঙ্গটি বার বার আলোচনায় এসেছে। ভারত এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির আয়তনের কোন তুলনা হয় না। কিন্তু সম্পর্ক যদি অর্থনীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠে, তার স্বার্থে দুই দেশ সমান পথে না হলেও ন্যায্যতার পথে হাঁটবে, এমন প্রত্যাশাও সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আর্থিক সম্পর্ক গত কয়েক বছরে অতি দ্রুত হারে বাড়ছে। তবুও বাণিজ্যের পাল্লা ভারতের দিকে অনেক বেশি ঝুঁকে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আমদানির পরিমাণ বাড়লে এই বাণিজ্য অনেক বেশি সুস্থায়ী হবে বলে মনে করছে সবাই। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়লেও এই প্রক্রিয়া গতি পাবে।

প্রতিবেশি দুটি দেশ আন্তরিকতার সাথে নিজেদের মধ্যকার নানা অমীমাংসিত ইস্যু সমাধান করেছে এবং করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তিস্তার পানি চুক্তি কিংবা সীমান্তে হত্যা– এমন দুটি ইস্যু যা দু’দেশের সম্পর্কে বারবার কাঁটার বিছানা বিছিয়ে দিচ্ছে। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে এখনও কোনো অগ্রগতি না হওয়াকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। তেমনি ভারতের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে বাংলাদেশের যে উদ্বেগ রয়েছে, সে বিষয়টিও ভারতীয় সরকারের উপেক্ষা করা কঠিন।

বাংলাদেশের বিপদের বন্ধু ভারত। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুর ভূমিকায় ছিল ভারত। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ ভারতের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদোশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি তাঁর সরকারের পূর্ণ সমর্থন দেন। পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে বাঙালিদের জন্য খুলে দেয়া হয় ভারতের সীমান্ত। নভেম্বরে গঠন করা হয় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড যার পথ ধরে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের মুক্তির জন্য এদেশের মাটিতে ঝরেছে ভারতীয় সেনার রক্ত।

এ মুহূর্তে রোহিঙ্গা ইস্যুতে শক্তভাবে পাশে দরকার ভারতকে। আগে যেমনটা বলেছি, আবারও উল্লেখ করছি তিস্তার প্রসঙ্গ। ১৯৮৭ সালের পর থেকে তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের সাথে কোনো চুক্তি নেই বাংলাদেশের৷ একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে দেশটি৷ ফলে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় পানিসংকট চলছে৷ ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরে তিস্তা পানি চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তখন ঢাকায় আসার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আসেননি, তিস্তা চুক্তিও তাই হয়নি৷ এরপর ২০১৫ সালে ঢাকা সফরকালে তিস্তার পানি দেয়া যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন মমতা৷ পরিবর্তে তিনি তোর্সা নদীর পানিবণ্টনের প্রস্তাব দেন৷ সেই থেকে বিষয়টির আর কোন সমাধান হয়নি।

বাংলাদেশের কাছে ভারত যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। ঢাকার সাংবাদিকদের সামনে বিক্রম দোরাইসোয়ামী যেমনটা বলেছেন, “আমি স্বীকার করি যে, নিকটতম সম্পর্কেরও পরিচর্যা করা প্রয়োজন’। দুই দেশের দিক থেকে সেই প্রচেষ্টা আছেও। গত কয়েক বছর ধরেই সম্পর্ক আরও মজবুত করতে দুই দেশ উদ্যোগী। রেল-সড়ক-নদীপথে যোগাযোগ আজ অনেক বেশি, পণ্য পরিবহন ও ভিসার সংখ্যাও বেড়েছে। প্রায় ৭০ বছর ধরে ঝুলে থাকা ছিটমহল হস্তান্তর চুক্তি হয়েছে। ভারতের ইন্ডিয়ান অয়েল বাংলাদেশের গ্রামীণ স্তর পর্যন্ত জ্বালানি গ্যাস সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে ও দেশের একটি বড় বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ করেছে। বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের জন্য ভারতের যে আর্থিক সহায়তার তহবিল, তাতে মোট ৩০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৮ বিলিয়ন শুধু বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ। বাংলাদেশ ভারতকে দেয়া প্রতিটি প্রতিশ্রুতি আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন করেছে।

অস্বস্তির জায়গা আগেই উল্লেখ করেছি। ভারতের নাগরিকত্ব আইনের প্রস্তাবে বা ধর্মীয় মেরুকরণে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ যেভাবে উঠে এসেছে, তা আমাদের দেশের পক্ষে অস্বস্তিকর। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ভারতের নীতিতেও দু’দেশের টানাপড়েন স্পষ্ট যেটা সাম্প্রতিককালে ভারতের দিক থেকে মেটানোর নানা উদ্যোগ লক্ষ্যণীয়।

তবে মনে রাখা দরকার বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের ব্যঞ্জনা শুধু দ্বিপাক্ষিক নয়, বহুমাত্রিক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের হাত ধরে যে সুসম্পর্কের শুরু, তার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবর্ষে দু’দেশের সম্পর্কের চেহারা নিশ্চয়ই এমন একটা জায়গায় দাঁড়াবে যা নির্ধারণ করবে এই উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।