কুকুরের সাথে মানুষের আচরণ করুন
এই ক’দিন ঢাকা শহরের পথের কুকুরের সাথে মানুষ যা করছে, তাকে মানুষের আচরণ বলা যায় না। কিছুতেই না। পশুপাখির অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছে মানুষ। কেননা, মানুষের বিচার-বুদ্ধি আছে। আর তাই কোন প্রাণির সাথে খারাপ আচরণ করার অর্থ হচ্ছে মানুষের ঘাড়ে স্বয়ং আল্লাহ্ পাক যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তাকে অস্বীকার করা। আল্লাহর দেয়া দায়িত্বকে অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহকে অমান্য করা, যা খুব বড় গোনাহের কাজ। মুসলিম বিশ্বাস করেন, সৃষ্টির সব কিছু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, পশুপাখিও। মুসলিম এ-ও বিশ্বাস করেন, মানুষকে তা-ই করতে হয়, যা করলে আল্লাহ্ পাক মানুষের উপর খুশি থাকেন। খ্রিস্ট ধর্ম এবং ইহুদি ধর্মের মতোই ইসলাম ধর্মেও নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া প্রাণী হত্যা করা, প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া পাপ বা গোনাহ্। মুসলিমদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পশুপাখির প্রতি সদয় হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
কুকুরের সাথে মানুষের আচরণ আসলে কী রকমের?
মানুষের ইতিহাস পথ চলেছে কুকুরের সাথে। আদিম সময় থেকেই মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু কুকুর। কুকুর কখনো খেলার সাথী, কখনো পাহারাদার, কখনো অন্ধকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় গন্তব্যে ৷ কুকুর মানুষের সবচেয়ে বিশ্বাসী বন্ধু৷ পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, কুকুর মানুষের আচরণ লক্ষ্য করে তার প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে৷ মানুষের শরীরের অঙ্গভঙ্গী এবং চোখ দেখে বুঝতে পারে মানুষ কি চায়৷আর সেজন্যই গাইড কুকুররা অন্ধ মালিকদের গন্তব্য বুঝতে পেরে তাদের সেখানে পৌঁছে দেয়।
প্রাচীন কাল থেকে মানুষ বিশ্বাস করে, কুকুরের ডাকের অর্থ বুঝতে হবে। তাহলে টের পাওয়া যাবে আগাম বিপদ। কুকুর আত্মাকে পরপারে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়, এই বিশ্বাস নেপালিদের আছে দেখেছি। চাকরি সূত্রে নেপাল যাওয়ার পর বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম নেপালি নেওয়ার ব্রাক্ষণ রাজন শ্রেষ্ঠার কাছ থেকে। বিশাল লনের এক পাশে আমার ডুপ্লেক্স বাড়ি, আরেক পাশে রাজনের প্রাসাদ। অনেক কুকুর ছিল বাড়িতে, ভাবতাম ভদ্রলোকের নিশ্চয় কুকুর পোষার শখ আছে। বাংলাদেশ আর কোলকাতায় যখন দুর্গা পূজার উৎসব শুরু হয়, সেই সময় নেপালে শুরু হ’ল তিহার উৎসব। তখন টের পেলাম, নেপালিদের বিশ্বাসে কুকুর কতটা পূজনীয়, শ্রদ্ধেয়। ভারতের অনেক অংশেও নাকি এমন বিশ্বাস অটুট, শুনেছি।
তিহার উৎসব পাঁচ দিনের। এর একদিন কুকুর পূজার জন্য নির্ধারিত। রাজন আমাকে বললেন, কুকুর হচ্ছে যমদেবতার বার্তাবাহক। রাজনের বাবা মারা যাওয়ার আগে বাড়ির কুকুর লিলি আর ফুচ্চি সারা রাত কেঁদেছিল। কেন? ওরা যে যমদেবতার আসার খবর টের পেয়েছিল। আবার বাবার মৃত্যুর পর বাবার আত্মাকে স্বর্গের পথ দেখিয়ে দিয়েছিল কুকুরই। এর বাইরে গৃহকর্তার বিশ্বাসের অমর্যাদা না করা, বাড়িঘর পাহারা দেওয়ার কাজটা পোষা কুকুরই তো করে।
মনে পড়ে, বাড়ির কোন জানালায় গ্রিল ছিল না, বারান্দায় ছিল না ঘিরে দেওয়া রেলিং। বাংলাদেশে আমরা তো এরকম খাঁচাবন্দী থাকতেই অভ্যস্ত। আমি খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। কেন যেন মনে হ’ত, এই গ্রিল না থাকাটা নিরাপত্তার অনুভূতি দিচ্ছে না আমাকে। রাজেনকে বললাম, দয়া করে গ্রিলের ব্যবস্থা করে দিন।
রাজেন খুব বিস্ময় নিয়ে শুনলেন আমি কেন গ্রিল চাইছি। তারপর এক গাল হেসে দ্বিগুণ বিশ্বাসের সাথে বললেন, লিলি আর ফুচ্চি থাকতে চোরডাকাত কোন দিন ঢুকতে পারবে না বাড়ির ভেতর। আমি যেন নিশ্চিন্তে বাস করতে থাকি। এরপর রাজন আমাকে উল্টো প্রশ্ন করল, গ্রিল দিলে বাড়িটা খাঁচা হয়ে যায়, দেখতে কি আমার কাছে বাজে লাগে না?
আমি কি কিছু বলেছিলাম উত্তরে? মনে পড়ছে না।
স্বর্গে কুকুরকে প্রবেশ করতে কোন বাধা দেওয়া হয় না। তাই রাজন চান, লিলি আর ফুচ্চি স্বর্গে গিয়ে তার বাবার আত্মার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে আসুক। আর তাই কুকুর-পূজার আয়োজন হয়, নেপালিরা এই পূজাকে বলে কুকুর-তিহার। এই দিনে কুকুরের কপালে মন্ত্র পড়তে পড়তে সিঁদুরের টিকা লাগানো হয়, গাদা ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়া হয় গলায়। লিলি আর ফুচ্চিকে কুকুর-তিহারের দিন টিকা আর মালা দিয়ে সেজে আমার কন্যাদের সাথে খেলতে দেখতাম। সেজেছে বলে লিলি আর ফুচ্চি আনন্দ পেত নাকি শিশুদের সঙ্গ ওদের আনন্দ দিত, আমি এখনো বুঝতে পারি না।
মানুষ বিশ্বাস করে, কুকুর মৃত্যুর খবর আগাম পেয়ে যায়। কুকুর নাকি কোন্ মানুষ ভাল না মন্দ, সেটাও টের পেতে পারে। কোনো কোনো কুকুরকে কখনো কখনো কারোর সামনে দাঁড়িয়ে গর্জন করতে দেখেছি, দেখেই মনে হয়েছে কুকুরটা মানুষটাকে পছন্দ করছে না। মানুষেরও এমন হয়। ছোট বাচ্চারাও দেখা যায়, সবার বেলায় সমান পছন্দের ভাব দেখাচ্ছে না। পছন্দ-অপছন্দের অনুভ‚তি এই ভাবে টের পাওয়াটা সত্যিই রহস্য বটে।
যারা পথের কুকুরদের তেড়ে আসতে দেখে কুকুর হঠাও বলে চিৎকার করছেন, তাদের ভেতরকার মানুষ সত্তার ভালত্ব নিয়ে পরীক্ষা হওয়া দরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুরি-বিশেষজ্ঞ ড্রাইভার ‘স্যার’ কুকুরদের কাছে সমাদর পাবেন না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। অথচ খোঁজ না নিয়েই আমরা জেনে গেছি, এই চোরকে সমাদরের সাথে সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষের সম্মান দিয়েছে আর সব মানুষরাই। চোর নিয়ে, চোরদের তোষণকারীদের নিয়ে হৈ চৈ করতে তথাকথিত পথচারীদের ইচ্ছের অভাব কেনো, বলুন তো? শিশু ধর্ষণকারী, শিশু হত্যাকারী, দেশের টাকা লুটপাটকারী, খুনি-জালিয়াত-চোর বাটপার দেশে থাকছে, এদেরকে হঠাতে হবে না। কুকুর হঠাতে হবে।
কুকুরের লালা রোগ-বালাই সারিয়ে তুলতে পারে, এমন বিশ্বাস ছিল প্রাচীন গ্রিক এবং রোমানদের মাঝে। সাইনোথেরাপিস্ট নামে পরিচিত ছিল মন্দিরের কুকুর, যারা লালা সংগ্রহ করত বিপদগ্রস্ত মানুষরা। কুকুর গন্ধ শুঁকতে পারে। তাই বলে, কারোর শরীরে ক্যান্সার রোগ বাসা বেঁধেছে কি না, তা কি গন্ধ শুঁকে টের পেতে পারে? অনেকেই মনে করে, পারে। শুধু ক্যান্সার কেন? রক্তে অতিমাত্রায় চিনির উপস্থিতিসহ আরো নানা ধরনের অসুস্থতার খবর কুকুর নাকি গন্ধ শুঁকেই আগে ভাগে টের পেয়ে যায়। সে না হয় হ’ল, কিন্তু কুকুরের লালা নিয়ে এরকম লালায়িত মনোভাব দেখানোর কোন মানে হয়? বিজ্ঞান বলছে, কিছুটা হলেও মানে হয়। কুকুরের লালার রাসায়নিক বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, এতে কিছু ব্যাক্টেরিয়া প্রতিরোধক উপাদান আছে। হতে পারে। কিন্তু এই লালা রোগ সারিয়ে তুলতে পারবে, এমন বিশ্বাস করাটা কিন্তু বাড়াবাড়ি।
পৃথিবীতে এখন সব মিলিয়ে ৪০০ প্রজাতির কুকুর বাস করে। এদের সবার পূর্বপুরুষ এক। নেকড়ে। ১২,০০০ বছর আগে কুকুর গৃহপালিত পশু হতে পেরেছে বলে গবেষকদের ধারণা। এর পেছনে কাজ করেছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ করার ক্ষমতা। কুকুরই একমাত্র পশু, যে কিনা ঘেউ ঘেউ করে রাতের বেলায় অজানা আগন্তুককে তাড়িয়ে দিতে পারে, ঘেউ ঘেউ করে শিকার তাড়া করতে পারে।
কুকুরকে কাজে লাগে, যদিও কুকুরের সম্মান কম। কুকুরকে পেটানো যায়। আর তাই মানুষ আরেকজন মানুষকে নিচু বলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চাইলে তাকে কুকুর বলে সম্বোধন করে আরাম পায়। একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে অধিকারহীন ‘পেটানোর বস্তু’ মনে করলে তাকে ‘কুকুর’ ভাবাটাই দারুণ উপায়, তাই না?
এইচআর/পিআর