পাঁচ আসনের উপনির্বাচন ও নিরুত্তাপ রাজনীতির মাঠ
জাতীয় সংসদের পাঁচটি আসনে উপনির্বাচন সামনে। তিনটি আসনের নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। দুইটির তারিখ ঘোষিত না হলেও খুব শিগগিরই হবে বলে আশা করা যায়। ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা, ঢাকা-১৮ আসনের সাহারা খাতুন , পাবনা-৪ আসনের শামসুর রহমান শরিফ ডিলু, নওগাঁ-৬ আসনের ইসরাফিল আলম এবং সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর কারণে এই আসনগুলো শূন্য হয়। এরা সবাই ছিলেন সরকারি দল আওয়ামী লীগের সদস্য। এর মধ্যে পাবনা-৪ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৬ সেপ্টেম্বর এবং ঢাকা-৫ ও নওগাঁ-৬ আসনে নির্বাচন হবে ১৭ অক্টোবর। ঢাকা-১৮ এবং সিরাজগঞ্জ-১ আসনের নির্বাচনের তফসিল এখনও ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন। তবে যেকোনো দিনই তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে।
উপনির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কিনা তা নিয়ে সংশয় থাকলেও শেষপর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। বিএনপি মনে করে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই জেনেও তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এটা আবারও প্রমাণ করার জন্যই যে বর্তমান সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। বিএনপি আসলে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সীমিত পরিসরে হলেও মানুষের কাছে যেতে চায় এবং দলের বক্তব্য তুলে ধরতে চায়। দলের মধ্যে যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে তা কাটিয়ে নেতাকর্মীদের কিছুটা চাঙ্গা করতে চায়।
গণতন্ত্রে বিশ্বাসী যেকোনো দলের জন্যই নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি বিগত সময়ে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের চেষ্টা করে সন্ত্রাস-সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছিল। তাতে সরকারের পতন না হলেও রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে বিএনপি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিএনপি এখন একেবারেই বেহাল অবস্থায় আছে। দলটির জনসমর্থন নেই, সে কথা বলা যাবে না। তবে একের পর এক ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কৌশল নিয়ে সমর্থকদেরও হতাশ করেছে বিএনপি। দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে দুই বছর জেল খেটে সরকারি অনুকম্পায় এখন জামিনে আছেন। তার আত্মীয়দের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দণ্ড স্থগিত করে জামিন দেওয়া হয়েছে।
প্রথম দফায় ছয় মাস এবং দ্বিতীয় দফায় আরও ছয় মাসের জামিন পেলেও খালেদা জিয়া এই সময় কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন না। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা তার আত্মীয়দের থাকলেও জামিনের শর্ত অনুযায়ী তাকে দেশেই চিকিৎসা নিতে হবে। খালেদা জিয়ার এমন ‘মুক্তি' তার সমর্থকদের হতাশ করলেও তাদের সব মেনে নিতে হচ্ছে মুখ বুজে। আত্মীয়দের তৎপরতা সম্পর্কে দলের শীর্ষ নেতারাও খুব বেশি অবহিত বলে মনে হয় না।
খালেদা জিয়াকে শাস্তি দিলে কিংবা তাকে কারাগারে নিলে দেশে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে উঠবে বলে বিএনপি মনে করলেও বাস্তবে তা হয়নি। খালেদা জিয়াকে সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত শাস্তি দিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে রাখছে বলে বিএনপি অভিযোগ করলেও এনিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন সংক্ষুব্ধ হওয়ার ঘটনা লক্ষ করা যায়নি। কেন এমন হলো? খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে এবং ক্ষমতার বাইরে এসেও জনপ্রিয়তার যে শক্তি তার ছিল, সেই শক্তির ক্রমাগত অপব্যহার এবং অপচয় করে নিজেকে খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়ে এখন অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে বসবাস করছেন।
বেগম জিয়া যদি পুত্র তারেক রহমানকে দলের নেতৃত্বে আনার জন্য মরিয়া হয়ে না উঠতেন, তিনি যদি ক্ষমতায় থাকতে হাওয়া ভবনের অপকীর্তি চালাতে না দিতেন, জামায়াতের মতো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ না করতেন, জঙ্গিদের আস্কারা না দিতেন, যেনতেন উপায়ে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার উদ্ভট নেশায় মেতে না উঠতেন, ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসমাবেশে যদি তার শাসনকালে গ্রেনেড হামলার ঘটনা না ঘটতো, তাহলে তার নিজের এবং দলের হয়তো বর্তমান পরিণতি না-ও হতে পারতো।
বেগম জিয়া চেয়েছিলেন তার অবর্তমানে তার ছেলে তারেক রহমান বিএনপির হাল ধরবেন। কিন্তু তার অবর্তমানে তারেক রহমানও বাস্তবে দলের হাল ধরতে পারছেন না। তিনি লণ্ডনে আছেন। তার দেশে ফেরা অনিশ্চিত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে অন্তত সেটা সম্ভব নয়। জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়ার সন্তান হিসেবে বিএনপির মধ্যে তারেকের একধরনের গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও রাজনীতির ব্যাপক পরিসরে তারেক অপাঙক্তেয়। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে তার ইমেজ ভালো নয়। তাকে নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতারাও যেমন স্বস্তি বোধ করেন না, তেমনি তার নানা ধরনের কানেকশনের জন্য সুস্থ ধারার রাজনীতিতে বিশ্বাসী অন্য রাজনীতিকেরাও তার মধ্যে রাজনীতির কোনো অপার সম্ভাবনা দেখেন না।
খালেদা জিয়া এবং তারেককে নিয়ে বিএনপি আর খুব বেশিদূর যেতে পারবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করেন না। রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াতে হলে বিএনপিকে তার অতীত রাজনীতির যেমন পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে, তেমনি নতুন পথ এবং নীতি-কৌশলও গ্রহণ করতে হবে। পুরনো বন্ধু ও সহযোগীদের নিয়ে রাজনীতির মাঠে দাপিয়ে বেড়ানোর অবস্থা বিএনপির আর হবে বলে মনে হয় না। দেশের রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তার জন্য বহলাংশে দায়ী বিএনপির ভুল রাজনীতি। গণতন্ত্র এবং সন্ত্রাস-সহিংসতা যে একসঙ্গে চলে না– এটা বিএনপি নেতৃত্ব না বোঝার জন্যই রাজনীতিতে বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে।
পাঁচটি আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত দলটিকে বড় কোনো লাভ হয়তো এখনই এনে দেবে না। তবে ভবিষ্যতের পুঁজি সংগ্রহে এটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা হারবেন– এটা কেউ মনে করেন না। রাজনীতির মাঠের অবস্থাও বিএনপি বা অন্য কোনো দলের অনুকূল বলে মনে হয় না। মাঠে আওয়ামী লীগের যতটুকু তৎপরতা আছে, অন্যদের তা-নেই। মানুষ নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে ভোট নিতে পারবে, সেটাও এখন আশা করা যায় না। উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পরাজিত হলে সরকার বদল হবে না। কিন্তু যারা ক্ষমতায় থাকে তারা সহজে হারতে চায় না। আওয়ামী লীগ হারলে বিরোধীদের পক্ষ থেকে বলা হবে সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই। এমনকি একটি আসনে যদি বিএনপি জেতে সেটাও হবে তাদের জন্য বড় নৈতিক জয়। এই জয়ের সুযোগ নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ দেবে না। তাই তারা চেষ্টা করবে যেকোনো উপায়ে তাদের আসন ধরে রাখতে। এই ‘যোকোনো উপায়ে' নির্বাচনে জেতার ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মজবুত হবে না। তবে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোটের গণতন্ত্র নিয়ে বড় আগ্রহ বা হাপিত্যেশ আছে বলেও কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। মানুষ ভোট দিতে পারছে না বা ভোট দিতে যাচ্ছে না, তারপরও নির্বাচন হচ্ছে, প্রতিনিধিও নির্বাচিত হচ্ছেন। মানুষ কিন্তু এটা মেনে নিচ্ছেন। ওপরতলার কিছু মানুষ এই বিনাভোটের নির্বাচনের নিন্দা-সমালোচনা করলেও একেবারে তৃণমূলের অবস্থা একেবারেই নিরুত্তাপ। নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন কেউ কেউ তুললেও নীতিহীহতার রাজনীতির দাপটের কাছে তা হালে পানি পাচ্ছে না।
প্রশ্ন হলো, এই অবস্থাই কি চলতে থাকবে? রাজনীতি কি আর কখনও সুস্থ-স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসবে না? গণাতন্ত্রিক ব্যবস্থা কি অধরাই থাকবে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা আমরা অনেকেই এখনও বলি। কিন্তু ‘জোর যার মুল্লুক তার' নীতি কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? কথা ও কাজের পর্বতপ্রমাণ অসঙ্গতি নিয়েই কি আমাদের বসবাস করতে হবে? আমাদের দেশের মানুষ ভোটের অধিকারের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। জীবনও দিয়েছে। ‘আমার ভোট আমি দেবো যাকে খুশি তাকে দেবো' এটা একসময় জনপ্রিয় রাজনৈতিক স্লোগান হয়েছিল। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিয়েছেন। অথচ এখন নির্বাচন নিয়ে কত বিতর্ক। ভোট নিয়ে এই হেলাফেলা কীভাবে এবং কেন তৈরি হলো? মানুষই বা কেন এমন নির্বিকার?
সব সমস্যারই সমাধান আছে। তাহলে আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র কেন সমাধানহীন সমস্যা হয়ে উঠছে? সব ধরনের বিতর্ক থেকে বেরিয়ে এসে দেশে আবার কীভাবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে, সেটা ভাবার সময় কি এখনও আসেনি? পাঁচটি উপনির্বাচন কি রাজনীতিতে নতুন আলো ফেলতে সক্ষম হবে? কোনো পক্ষই যদি জবরদস্তি না করেন, ভোটারদের ওপরই যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে ক্ষমতার পালাবদল হবে না কিন্তু রাজনীতিতে সুবাতাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আস্থা-বিশ্বাসের পরিবেশ ফিরে না এলে রাজনীতি বৃত্তবন্দি হয়েই থাকবে। বৃত্ত ভাঙতে এগিয়ে আসার দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনি বিরোধী দলেরও।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/জেআইএম