যত দোষ, বিএনপি-জামায়াত ঘোষ!

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ১২:২১ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০

আত্মনির্ভরশীল চাকরিজীবী এক নারী সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বিয়ে করবেন না। গুরুর কাছে গেলেন। গুরু সব শুনে বললেন, ঠিক আছে। তবে তুই সারাদিন পরিশ্রম করে বাসায় ফিরে ক্লান্তির রাগটা কার ওপর ঝাড়বি? ঠিকমত কোনো কাজ করতে না পারলে দায়টা কার ওপর চাপাবি? অফিসে ঝামেলা হলে দোষটা কার ঘাড়ে যাবে? এরপর গুরু বললেন, আরে পাগলী, এই জন্যই বিয়ে করতে হয়।

এটি একটি কৌতুক, কিন্তু নির্দোষ নয়। আরো অনেক কৌতুকের মত এটিও একটি নারী বিদ্বেষী কৌতুক। আমার ধারণা, বেশিরভাগ কৌতুকই পুরুষদের বানানো। তারা সংসারে কিছু বলতে না পেরে কৌতুকে নারী বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়। তবে কৌতুক শুনে ক্ষেপে না গিয়ে নারীরা কেন পাল্টা কৌতুক বানায় না, এটা একটা নির্দোষ কৌতূহল।

দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। হালকা কৌতুকে সময় নষ্ট করার সময় নেই নারীদের, তারা সব বিষয়ে সিরিয়াস এবং তারা পুরুষদের ভালোবাসে অথবা কৌতুক বানানোর মত যথেষ্ট ক্রিয়েটিভ তারা নন। এইরে নারীকূল আবার আমার ওপর ক্ষেপবেন। তবে এই কৌতুকটিকে চাইলেই লিঙ্গনিরপেক্ষ করা সম্ভব। বিয়ে করতে না চাওয়া নারীর বদলে পুরুষ বসিয়ে দিলেও কৌতুকটির রস খুব একটা কমে না। সংসার আসলে দায় চাপানোর খেলা। দায় চাপানোর জন্যও একজন আপন মানুষ দরকার। আমার সংসারে যদিও একতরফা রাগ ঝাড়াঝাড়ি চলে; তবুও এমনিতে পারস্পরিক দায় চাপানো, রাগ ঝাড়াটা সংসারকে আরো মধুর ও মজবুত করে।

স্বামী-স্ত্রী হলো সংসারের শক অ্যাবজর্ভার। কখনো স্বামী শকটা নেবে, কখনো স্ত্রী। সিরিয়াস প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরেকটা কথা বলে নেই। আমার ধারণা, মিশেল ওবামাও হোয়াইট হাউসে বসে বারাক ওবামাকে বলেছেন, 'খালি আমি দেইখা তোমার মত অথর্বের সংসার করেছি। অন্য কেউ হলে অনেক আগেই ঝাটা মেরে চলে যেতো।' আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রিকশাওয়ালা সবাই স্ত্রীর কাছে অযোগ্য।

সংসারের মত রাজনীতিতেও দায় চাপানো একটা দারুণ কৌশল। কিছু ভুল হলেই প্রতিপক্ষ বা আগের সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়া যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি হলো পারস্পরিক দায় চাপানোর সেই দল। কিন্তু আওয়ামী লীগ গত এক যুগে নিষ্ঠুর নিপীড়নে বিএনপিকে প্রায় হত্যা করে ফেলেছে। তবে দায় চাপানো থেমে নেই। প্রায় মৃত বিএনপি-জামায়াতের ওপরও দায় চাপানো হয়। বাংলাদেশে কেউ কোনো অপকর্ম করলে প্রথমেই তার সাথে বিএনপি-জামায়াতের সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করার চেষ্টা হয়।

সাম্প্রতিক রিজেন্ট হাসপাতাল কেলেঙ্কারির পর আবিষ্কার হলো মো. সাহেদ একসময় হাওয়া ভবনের লোক ছিলেন। গতবছর ক্যাসিনো বিরোধী শুদ্ধি অভিযান শুরু হয় যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভুইয়াকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে। পরে আবিষ্কার হলো, তিনিও একসময় যুবদল করতেন। এটা ঠিক, ক্ষমতার লোভে বিএনপি-জামায়াতের অনেকেই গত একযুগে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। তাদের অনেকে পদ-পদবী নিয়ে বেশ জাকিয়ে বসেছে। তারা নানা অপকর্মও করছে। কোনো অপকর্ম করে ধরা না পড়া পর্যন্ত তারা দলের ত্যাগী নেতা, ধরা পড়লেই তারা অনুপ্রবেশকারী বিএনপি-জামায়াত। তবে আমি তো এই ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত বা ঐ লোকদের কোনো দোষ দেখি না। তারা তো চামড়া বাঁচাতে, টাকা কামাতে আওয়ামী লীগে নয়, সরকারি দলে এসেছে। দোষটা তাদের, যারা তাদের আসতে দিলো, দলে জায়গা দিলো, পদ দিলো। সাহেদের মত লোককে কে আওয়ামী লীগের উপকমিটিতে ঠাঁই করে দিলো, খালিদ মাহমুদ ভুইয়া কীভাবে যুবলীগে পদ পেলেন? এমন হাজারটা উদাহরণ দেয়া যাবে। হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলে তাদের কাউকে কাউকে আইনের কাছে যেতে হয় বটে, কিন্তু দলে যারা তাদের বরণ করে নেয়, তাদের কখনোই কিছু হয় না। এমনকি তাদের নামও কেউ জানে না।

সম্প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল কর্মসূচির আওতায় হাতেকলমে দেখতে এক হাজার কর্মকর্তার বিদেশ যাওয়ার একটি প্রকল্প নেয়া হয়। এটি ফাঁস হয়ে গেলে গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল হইচই। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়। আর এতেই ক্ষেপেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। তার সব ক্ষোভ সাংবাদিকদের ওপর। কারণ সাংবাদিকরা তার মন্ত্রণালয়ের অপকর্ম ফাঁস করে দিয়েছে। তিনি মনে করেন, এটি নিয়ে হইচই করার কিছু নেই। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, 'আপনারা মাইন্ড করবেন না, আপনাদের এই সাংবাদিকতায় কিছু বিএনপি-জামায়াতের লোকজন এখানে আসছেন। তাদের কোনো জ্ঞান গরিমা নেই, একটা হুট করে লিখে দিলেই বোধহয় হয়ে গেল। সরকারের ভাবমূর্তি কোথায় গেলো না গেলো এরা তা দেখে না। আপনাদের অনুরোধ করবো, এই সমস্ত জামায়াত-বিএনপির সাংবাদিক, নতুন নতুন তারা সাংবাদিকতায় আসছে। আমার এলাকায় দেখছি সমস্ত বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদলের ছেলেরা এখন সাংবাদিকতা করে ভ্রান্ত রিপোর্ট করে, এদিক থেকে আপনারা একটু নজর রাখবেন। আমাদের সরকারের যেন বদনাম না হয়।'

কী হাস্যকর বক্তব্য। প্রকাশিত রিপোর্ট ঠিক আছে না ভুল, প্রতিমন্ত্রী সেটা নিয়ে কথা বলতে পারেন, সাংবাদিকদের নিয়ে এভাবে ঢালাও কথা বলার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? মানছি প্রকাশিত প্রতিবেদনে কিছুটা অতিরঞ্জন ছিল। প্রকল্পটি সামগ্রিকভাবে মিড ডে মিল সম্পর্কে হাতেকলমে জ্ঞান অর্জনের জন্য। খিচুরি রান্না সেখানে একটি ছোট্ট উপাদান মাত্র। কিন্তু পত্রিকায় এসেছে, একহাজার সরকারি কর্মকর্তা খিচুরি রান্না শিখতে বিদেশে যাচ্ছেন, যার বাজেট ৫ কোটি টাকা। তারপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রলের বন্যা। মন্ত্রী রিপোর্টের শিরোনাম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন, কিন্তু মিড ডে মিল দেখতে এক হাজার কর্মকর্তার বিদেশ যাওয়ার প্রস্তার তো বায়বীয় নয়। এই প্রস্তাব ছিল এবং বাতিল হয়েছে।

শিরোনাম নিয়ে মন্ত্রী আপত্তি করতে পারেন বটে, কিন্তু বাংলাদরশের প্রায় সকল প্রকল্পে একটা বিদেশ সফর তো মাস্ট। অধিকাংশ ট্যুরই তো আসলে প্লেজার ট্রিপ। পুকুর কাটা শিখতে বিদেশ যাওয়ার রেকর্ডও আছে নদীমাতৃক এই বাংলাদেশেই। এভাবে দলে দলে বিদেশে না গিয়ে কিছু যদি শিখতেই হয়, বিদেশ থেকে দুয়েকজন বিশেষজ্ঞকে বাংলাদেশে এনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিলেই তো হয়। জনগণের করের টাকায় বিদেশে আনন্দ ভ্রমণ চলতে পারে না। দাবি জানাচ্ছি, অতি জরুরি এবং অবশ্যম্ভাবী ছাড়া সব ধরনের বিদেশ সফর বাতিল করা হোক। বরং সময় এসেছে অন্য দেশ থেকে মানুষ বাংলাদেশে এসে শিখবে আমাদের কৃষকদের সাফল্য।

মাননীয় প্রতিমন্ত্রী যে অভিযোগ করেছেন, সেটা যদি সত্যি হয়ও, তাতে তো দোষের কিছু নেই। অতীতে বিএনপি-জামায়াত করলেই তিনি সাংবাদিকতা করতে পারবেন না, এমন তো কোনো কথা নেই। বরং সাংবাদিকদের বেশির ভাগই সচেতন এবং ছাত্রজীবনে কোনো না কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করেছেন, এমন অনেক সাংবাদিকের নাম আমি প্রতিমন্ত্রীকে দিতে পারবো। তাদের ব্যাপারেও কি মন্ত্রী আপত্তি করবেন? অতীতে কে, কী করতেন; অন্তত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সেটা বিবেচ্য নয়। সেই সাংবাদিক তার পেশাগত জীবনে কতটা পেশাদার সেটা হলো প্রধান। তিনি যে রিপোর্ট করেছেন, সেখানে কোনো বিচ্যুতি আছে কিনা সেটা হলো বিবেচ্য।

প্রতিমন্ত্রী এই রিপোর্টের ক্ষেত্রেও সেটা নিয়ে কথা বলতে পারতেন। তা না করে তিনি বিএনপি-জামায়াতের ঘাড়েই দোষ চাপানোর পুরোনো কার্ড খেললেন। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী নিজেদের অপকর্ম বিএনপি-জামায়াতের ঘাড়ে চাপিয়ে পার পাওয়ার দিন শেষ। আপনারা ১২ বছর ক্ষমতায় আছেন, বিএনপি ১৪ বছর আগে ক্ষমতায় ছিল। এখন আর কোনো কিছুর দায় তাদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করলে মানুষ বিশ্বাস করবে না, হাসবে। এখন যাদের বয়স ২০, যাদের ভোট দেয়ার বয়স হয়েছে, তারা বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখেইনি। না দেখা এক জুজুর ভয় দেখালে তারা মানবে কেন?

তবে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী সবচেয়ে হাস্যকর কথা বলেছেন সরকারের ভাবমূর্তি নিয়ে। বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা সাংবাদিকরা নাকি যা ইচ্ছা তাই লিখে দেয়, সরকারের ভাবমূর্তি কোথায় গেলো না গেলো তা দেখে না। তিনি সরকারের যাতে বদনাম না হয় সেটা দেখার জন্য সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, আমি বিনীতভাবে বলতে বাধ্য হচ্ছি, সাংবাদিকতা সম্পর্কে আপনার জ্ঞান-গরিমা শূন্যের কোঠায়। প্রথম কথা হলো, সাংবাদিকতা একটি উন্মুক্ত পেশা। যে কেউ নিয়ম, নীতি-নৈতিকতা মেনে সাংবাদিকতা করতে পারেন।

দ্বিতীয় কথা হলো, সরকারের ভাবমূর্তি দেখার দায়িত্ব সাংবাদিকদের নয়। সাংবাদিকদের কাজ সত্য তুলে ধরে। তাতে কার ভাবমূর্তি কোথায় গেল সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। অকারণে বিদেশে গেলে, লুটপাট করলে, দুর্নীতি করলে আর মিডিয়ার সামনে প্রতিমন্ত্রীরা হাস্যকর কথা বললেই সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়; সাংবাদিকদের সত্য প্রকাশে নয়।
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।