পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি ও অসাধু ব্যবসায়ী
মহামারি করোনা পরিস্থিতিতেও বলা যায় আমরা অনেক দেশ থেকেই স্বাচ্ছন্দ্যে আছি। দীর্ঘ কয়েক মাস সব কিছু বন্ধ থাকার পরেও দেশে খাদ্যের কোন ধরনের ঘাটতি দেখা দেয় নি। বলা যায় ধনী-গরীব সবাই পরিবার নিয়ে দু’মুঠো খাবার খেয়ে ভালোই আছে। করোনার আগে খাদ্য সামগ্রীর মূল্য যেমন ছিল পাঁচ মাস পরেও কিন্তু কোন কিছু অস্বাভাবিক হয় নি। এটি কি আমরা কখনও ভেবে দেখেছি।
নিঃসন্দেহে এটি দেশের বড় অর্জন। কিন্তু দেশে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকায় উঠেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারত রফতানি বন্ধ করলে সেসময় দেশের বাজারে হু হু করে দাম বেড়েছিল পেঁয়াজের। রেকর্ড ৩০০ টাকা পর্যন্ত ওঠে পেঁয়াজের কেজি। যদিও আমাদের দেশে পেঁয়াজের কোন ঘাটতি নেই তারপরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এই অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার বিকল্প নেই।
গত বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত পেঁয়াজের মূল্য নিয়ে সৃষ্ট অস্থিরতা বিষয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি স্পষ্ট করে বলেছেন-‘ভারত সরকারের পেঁয়াজ রফতানি না করার সিদ্ধান্তের সুযোগ নিয়েছে দেশের এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। বছরে দেশে পেঁয়াজের মজুত রয়েছে ছয় লাখ টন। তবে এ মুহূর্তে পেঁয়াজের কোথাও কোনও সংকট নাই।’ সাধারণ ক্রেতাদের পেঁয়াজ নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
ইসলামি আইনশাস্ত্রবিদদের মতে, ইসলামি পরিভাষায় মজুদদারি হচ্ছে, খাদ্যশস্য মজুদ করে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা। অতঃপর মূল্য বৃদ্ধি পেলে তা বিক্রি করে প্রচুর পরিমাণে লাভবান হওয়া। ইসলাম মানবতাকে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রদান করে যা সব বৈষম্য ও অসমতা দূরীভূত করে দিয়ে ইনসাফভিত্তিক এক অনন্য সমতার সমাজ কায়েমের পথ নির্দেশ করে।
এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজের কোন ব্যক্তির ন্যায্য অধিকার ক্ষুণ্ণ করার এবং কারও স্বার্থ বিনষ্ট করার কোন রূপ সুযোগ নেই। এই অর্থনৈতিক মতাদর্শে পরিশ্রম করে সুখী সুন্দর জীবন গড়ার সুযোগ নিশ্চিত করে দেয়, যার ফলে মানবিক মূল্যবোধ সুদৃঢ় বুনিয়াদ লাভ করে। পারস্পরিক সম্পর্ক ও লেনদেনের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার স্বার্থে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইসলাম নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য।
ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্য উৎসাহিত করতে যেমন বিভিন্ন রকম জাগতিক ও পারলৌকিক প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে তদ্রুপ বিভিন্ন ধরনের নৈরাজ্যকর ও অবাঞ্ছনীয় পদক্ষেপ প্রতিরোধে জাগতিক এবং পারলৌকিক শাস্তিও ঘোষণা করেছে। পণ্য সামগ্রী জমা রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সমাজের দুর্ভোগ বৃদ্ধি ও অতি মুনাফা অর্জন করাকে ইসলামে দণ্ডণীয় কাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করছি আবারো পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অধিক মুনফালোভীরা তাদের গুদামে নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু খাদ্য দ্রব্য অবৈধ, অনৈতিকভাবে মওজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। কয়েক মাস আগে দেশের বিভিন্ন স্থানের গুদাম থেকে বস্তার বস্তা পঁচা পেঁয়াজ নদীতে ফেলার চিত্রও মিডিয়াতে প্রচার হতে আমরা দেখেছি। যদিও এদের সংখ্যা কম কিন্তু বাজার ব্যবস্থাকে এই কম সংখ্যক লোকই নিয়ন্ত্রণ করছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যতম সম্মানজনক কাজ এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যকে ইসলাম সব সময় উৎসাহিত করে থাকে। কিন্তু খাদ্য সামগ্রী ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরীর মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। দুনিয়া ও আখিরাতে মজুদদারির ভয়াবহ শাস্তির কথা কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যারা সোনা রূপা (ধন-সম্পদ) জমা করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না তাদের জন্য আপনি যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সংবাদ দিন। সে দিন এসব ধন-সম্পদ আগুনে গরম করা হবে। অতঃপর তা দিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেয়া হবে। (বলা হবে), তোমরা যা কিছু নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে এগুলো তো সেসব ধন-সম্পদ। সুতরাং তোমরা যা কিছু জমা করে রেখেছিলে, এখন তার স্বাদ আস্বাদন করো।’ (সুরা আত তাওবা: আয়াত ৩৪-৩৫) অপর এক স্থানে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যাতে ধন-সম্পদ শুধু বিত্তবানদের মধ্যে পুঞ্জীভূত না হয়।’ (সুরা আল হাশর: আয়াত ৭)
ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখাকে অর্থনৈতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কেননা এতে ধন-সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণ ও বণ্টন হওয়ার পরিবর্তে শ্রেণি ও সম্প্রদায়-বিশেষের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে আর সাধারণ মানুষ হয় নিঃস্ব ও দরিদ্র। লেনদেনেও স্থবিরতা দেখা দেয় এবং উন্নয়ন বাধাগস্ত হয়। অনুরূপভাবে পণ্য সামগ্রী আটকে রাখার ফলেও একই রকম সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং সম্পদ পুঞ্জীভূতকারী এবং পণ্য মজুদকারী সমান অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে অস্বাভাবিক ও অধিক মূল্যে বিক্রি করার জন্য গুদামজাত করে রাখাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘ইহতিকার’ বা মজুদদারি বলা হয়। আল-হিদায়া প্রণেতার ভাষায় ‘ইহতিকার বা মজুদদারি হচ্ছে, খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করে মূল্য বৃদ্ধির আশায় গুদামজাত করা।’
আল্লামা ইমাম ইবনে আবেদীন শামীর বলেন- ‘ইহতিকার হচ্ছে, খাদ্য সামগ্রী বা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী ক্রয় করে উচ্চ মূল্যের জন্য চল্লিশ দিন পর্যন্ত আটক রাখা’। অর্থাৎ যেসব জিনিস আটকিয়ে রাখলে বা মজুদ করলে সর্বসাধারণের সীমাহীন কষ্ট ও ক্ষতি হয়।
মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মজুদদার খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি; যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায় তাহলে চিন্তিত হয়ে পড়ে আর যদি মূল্য বেড়ে যায় তাহলে আনন্দিত হয়।’ (মিশকাত) মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাজারে পণ্যের অভাবের সময় পণ্য মজুদ করে রাখে সে বড় পাপী।’ (মুসলিম)
পণ্যসামগ্রী মজুদ করে দাম বৃদ্ধি অথবা অধিক মুনাফা করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। হাদিস শরিফে মজুদদারকে নিকৃষ্ট, অভিশপ্ত বলে অভিহিত করা হয়েছে। মজুদদার মূলত সেই ব্যক্তি, যে মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করে এর মূল্য বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে গোপনীয় স্থানে আটক করে রাখে। পণ্যসামগ্রী মজুদ করার কারণে জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা ও কষ্ট-দুর্ভোগ বেড়ে যায়, অস্বাভাবিক হারে জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লাভের সুযোগ ঘটে। এজন্য মজুদদার ও অধিক মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে হাদিসে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে এদেরকে পাপী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ব্যবসায়ীদের পণ্য মজুদকরণ সম্পর্কে ঘোষণা করেছিলেন, “আমাদের বাজারে কেউ যেন পণ্য মজুদ করে না রাখে। যাদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ আছে তারা যেন বহিরাগত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সমস্ত খাদ্যশস্য কিনে তা মজুদ করে না রাখে। যে ব্যক্তি শীত-গ্রীষ্মের কষ্ট সহ্য করে আমাদের দেশে খাদ্যশস্য নিয়ে আসে সে উমরের মেহমান। অতএব সে তার আমদানীর খাদ্যশস্য যে পরিমাণে ইচ্ছা বিক্রি করতে পারবে, আর যে পরিমাণে ইচ্ছা রেখে দিতে পারবে।” (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)
ইমাম গাজ্জালির (রহ.) মতে, মজুদদারি হারাম। তিনি এর কারণ উল্লেখ করে বলেন, এতে আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট ও অনিষ্ট সাধিত হয়ে থাকে। কোনো ব্যক্তি সব শস্য ক্রয়পূর্বক আটক করে রাখলে অবশিষ্ট সবাই এ থেকে বঞ্চিত থাকবে। এ উদ্দেশ্যে খাদ্যশস্য খরিদ ও মজুদ করে রাখা পাপ।
মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত হয়, আর মজুদদার হয় অভিশপ্ত।’ আরো বলা হয়েছে, ‘বিভ্রান্ত লোকই শুধু মজুদদারী করে।’ (ইবনে মাজা) মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মজুদদারকে কঠোর শাস্তি প্রদানের কথা ঘোষণা করেছেন, ‘যে মুসলিম সম্প্রদায়ের খাদ্যদ্রব্য চল্লিশ দিন যাবত মজুদ করে রাখবে আল্লাহ তাকে দূরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দিয়ে শাস্তি দিবেন।’ (ইবনে মাজা) তাই দ্রব্যমূল্য মজুদ রেখে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেয়া অত্যন্ত গোনাহের কাজ। এই পাপ কাজ করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।
পেঁয়াজের মূল্য স্বাভাবিকরাখতে বাজারে নজরদারি বাড়ানো এবং সিন্ডিকেটধারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া একটি স্বার্থান্বেষী মহল যারা বিভিন্ন সময় গুজব ছড়িয়ে খাদ্য সামগ্রীর বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত আর এজন্য সরকার-ব্যবসায়ী সব পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে।
এইচআর/এমএস