বরকত, রুবেল, সাহেদ, মিঠু, পাপুল কি আলাদা কেউ?
শিরোনাম দেখে কারো খটকা লাগতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আলাদা এতগুলো মানুষ কীভাবে এক হয়ে গেল? উত্তর হচ্ছে, কাজ এবং কাজের পথে তারা একাত্ম। নামটাই শুধু আলাদা। আমি বরং ইদানীং পত্রপত্রিকা ঘেঁটে, তাদের তালিকায় আরও কয়েকজনের নাম যুক্ত করি। যেমন ধরুন জেকেজির সাবরিনা, আরিফ, ক্যাসিনো সম্রাট, জিকে শামীম। পত্রপত্রিকায় তাদের নানা অপরাধের খতিয়ান এরই মধ্যে ছাপা হয়েছে। আরও নিশ্চয়ই হবে।
নানা অপরাধীর অন্যায়তো আমাদের চেনা। তাহলে এদের কেন এক করা হচ্ছে? প্রশ্ন উঠতেই পারে। কারণ হচ্ছে, আশঙ্কাজনক হারে বরকত, রুবেলের পথে তৈরি হচ্ছে শত শত অনুসারী। প্রথমে তাদের চেনা যায় না। কারণ এদের শুরুটা ধারাবাহিক খুনি রসু খা, কিংবা ডাকাত মকিম গাজীর মতো নয়। একলাইনে এরা আসলে সমাজের মধ্যে বেড়ে ওঠা কৌশলী প্রতারক। অনুশীলন করে খুব দ্রুত এই কৌশল তারা আয়ত্ত করে। হায়েনার মতো খুব ঠাণ্ডা মাথায় খুঁজে বের করে কে তার শিকার? কোথায় শিকারের জীবনযাপন পদ্ধতির দুর্বলতা? শিকারের কাছে যাওয়ার জন্য কার কার ওপর ভর করতে হবে? তবে তাদের মূল মিল হচ্ছে, ক্ষমতার উৎস এবং লক্ষ্যে।
পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করবেন, এদের প্রত্যেকেরেই লক্ষ্য খুব কম সময়ে সর্বোচ্চ সম্পদের মালিক হওয়া। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী মাত্র সাত বছরে বরকত ও রুবেল প্রায় আড়াই হাজার বিঘা জমির মালিক হয়েছে। দুই ভাইয়ের ব্যাংক হিসাব ৪৯টি। সেখানে লেনদেন হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। এ তথ্য তারাই আদালতের জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে। সাহেদ-পাপুলসহ অন্য আর যাদের কথা বলছি, তারা প্রত্যেকেই গত পাঁচ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে। অথচ এদের কারোরই পারিবারিক অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত ছিল না।
এবার আসি তাদের ক্ষমতার উৎসে। তাদের প্রত্যেকেরই ক্ষমতার উৎস রাজনৈতিক। নানা ছলে তারা ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে গেছে। একসময় প্রতারণা করেছে রাষ্ট্রের সঙ্গে। তাদের কাছে দল একটি ছল মাত্র। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা কেউই তৃণমূলের রাজনীতি থেকে আসেনি। আকস্মিক দলে ভিড়ে গেছে। তার পর কৌশল করে বঞ্চিত করেছে দীর্ঘদিন মাঠে থাকা কর্মীদের। যদি পাপুলের কথাই ধরি, দেখা যাবে সে একটি নয়, দুটি দলের কর্মীদের বঞ্চিত করেছে। দুই দুইটি সংসদীয় আসন আটকেছে তার প্রতারণার জালে।
এই প্রতারকরা আসলে একটি শ্রেণিতে রূপান্তর হচ্ছে। কারণ মুহূর্তের চাকচিক্য অনেকের দৃষ্টি কাড়ে। বিশেষ করে তরুণদের। তারা বাছবিচার না করেই এই প্রতারক শ্রেণির দলে ভিড়ে যাচ্ছে। এর সবচেয়ে শক্ত উদাহরণ হচ্ছে সাহেদ। পত্রপত্রিকা বলছে, মাত্র ৩৪/৩৫ বছর বয়সের এই ছেলেটি, প্রতারণায় অভ্যস্ত হয় ১৫/১৬ বছর বয়সে। তার মা তখন একটি জেলার মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তখনকার সরকারি দলের সুবিধা নেয়ার জন্য মা’ই ছিল তার প্রবেশপথ। কারণ দলের কোনো বড় নেতার কাছে গিয়ে যদি কেউ মায়ের পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চায়, তিনি তো তার দলীয় কর্মীর সন্তানের সঙ্গে সস্নেহে কথা বলতে পারেন। ছবি তুললেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেই ছবি তোলা যে পূর্বপরিকল্পিত এবং এটা যে প্রতারণায় ব্যবহার হবে সেটাতো তার জানার কথা নয়।
বছর দশেক আগে মা মারা যান সাহেদের। ততদিনে সে প্রতারণায় বেশ সিদ্ধহস্ত। একবার জেলও খেটে ফেলেছে। এখন সে দেখলো ক্ষমতায় থাকা মানুষের কাছে যাওয়ার আরেকটি পথ গণমাধ্যম। নিজেকে গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করলো। এর জন্য পুরোনো কৌশলে সহায়তা নিল, আরেক নারীর। তিনি আর কেউ নন, তার স্ত্রীর মা। এবার তার পুত্র হয়ে সে গণমাধ্যমের মহলে ঢোকার রাস্তা তৈরি করলো। সেখানেও ওই ছবি এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রচারের কৌশলে গেল। কারণ সে জানতো, কোনো অনুষ্ঠানে ছবি তোলার অনুমতি চাইলে, না বলার চেয়ে তুলে ফেলাই সহজ মনে করে মানুষ।
স্বাস্থ্য মিঠু দেশের বাইরে। পাপুল দেশের বাইরের জেলে। আটক রয়েছে সাবরিনা, আরিফ, সম্রাট, শামীম। প্রভাবের কারণে, আইনের আওতায় না আসা পর্যন্ত তাদের কথা মানুষ জানতে পারে না। কিন্তু গ্রামগঞ্জ শহরে ঘুরলে যে কেউ বুঝবেন, এরকম হাজারো প্রতারক চারদিকে ঘুরছে, যারা আইনের আওতায় আসেনি। তাদের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার মতো সূত্রও তৈরি হয়নি। কিন্তু চোখ খোলা রাখলেই দেখবেন, রাস্তার মোড়ে দেয়ালে পোস্টারে কত কত ছবি ঝুলছে। চেহারা দেখলেই বুঝবেন, ছাত্রত্বই কাটেনি অথচ এখনই দেশসেবা করতে চাওয়ার বাসনা কতটা প্রকট। রাজনৈতিক ক্ষমতা অপব্যবহার করে, এলাকার বাজার হাট ও নির্মাণ কাজের দখলদারিত্ব, নিয়োগ বাণিজ্য, সবকিছুর মধ্যে এই শ্রেণির সরব অস্তিত্ব টের পাবেন।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, আমি বোধহয় বেশি বেশি বলছি। কিন্তু সত্য হচ্ছে, ক্ষমতা অপব্যবহারের রাজনীতি যারা করে, তাদের মধ্য থেকে যেকোনো সময় একজন বরকত বা রুবেল বের হয়ে আসবে, এটাই স্বাভাবিক।
অসুস্থ এই প্রতারক শ্রেণি, গত ১৫ বছরের আগে বাংলাদেশের মানুষ দেখেনি। তখন যে অপরাধ ছিল না তা নয়। চাঁদাবাজি, খুনাখুনি, টেন্ডারবাজি সবই ছিল। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি থাকা লাখ লাখ মানুষের প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টের মতো জরুরি বিষয়ের নমুনা ফেলে দিয়ে, মিথ্যা তথ্য দেয়ার কথা শোনা যায়নি। একজন অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীর শেষ সঞ্চয়টুকু কেড়ে নিতে দেখা যায়নি। ক্ষমতাবান মানুষের সঙ্গে ছবি তুলে, সেই ছবি দেখিয়ে অন্যদের ভয় দেখানোর কৌশল করতেও দেখা যায়নি।
অপরাধের ধরন দেখে বলতে চাই, এরা মানসিকভাবে ভয়ঙ্কর অসুস্থ। এদের চিন্তার মধ্যেই অপরাধের বসবাস। এরা অভাবে অপরাধ করে না করে স্বভাবে। কেন এরকম অপরাধীচক্রের সৃষ্টি হলো? সেটা ভিন্ন আলোচনা। আপাতত এই শ্রেণির চক্র থেকে জাতির মুক্তি দরকার।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
[email protected]
এইচআর/পিআর