ব্রিফিং গেলেও করোনা কিন্তু যায়নি!

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ২৪ আগস্ট ২০২০

ছয় মাসেরও বেশি সময় চলার পর গত ১২ আগস্ট থেকে বন্ধ হয়ে গেছে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির আপডেট নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্রিফিং। শেষ দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা নিয়মিত ব্রিফিং করলেও করোনা ব্রিফিং তারকা বানিয়েছে আইইডিসিআর’এর সাবেক পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরাকে। তার শাড়ি নিয়েও ফেসবুকে গবেষণা কম হয়নি। শুরুর দিকে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ব্রিফিং হতো, থাকতো সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরের ব্যবস্থাও। করোনার বিস্তার বাড়ার পর অনলাইন ব্রিফিং আয়োজন করা হয়। অনলাইন ব্রিফিঙের শুরুর দিকে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল। তবে এক পর্যায়ে তা একতরফা ব্রিফিঙে পরিণত হয়। সেই একতরফা ব্রিফিংও চলে গেল। তবে করোনা কিন্তু যায়নি এখনও। প্রেস ব্রিফিং পরিণত হয়েছে প্রেস রিলিজে। কিন্তু সংক্রমণ বা মৃত্যু হার কমেনি।

শুরুর দিকে তিনটায় হলেও শেষ দিকে করোনা ব্রিফিং হতো দুপুর আড়াইটায়। বাংলাদেশে দুপুর আড়াইটা মানেই ছিল আতঙ্ক। ক্রিকেট স্কোরের মত প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা আপডেট করা বড় বেদনার। তারপরও করোনা পরিস্থিতির আপডেট নিয়ে এই ব্রিফিংটি ছিল সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি দর্শকপ্রিয় টিভি সময়। যারা নিয়মিত টিভি দেখেন না, তারাও দুপুর আড়াইটায় টিভি খুলে বসে থাকতেন। করোনার ব্রিফিং নিয়ে কারো কারো ভিন্নমতও ছিল। এভাবে প্রতিদিন মৃতুর খবর জানিয়ে গোটা জাতিকে ট্রমাটাইজ করার বিপক্ষে ছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আতঙ্ক হোক আর যাই হোক, সত্য এবং তথ্য গোপন করে কোনো লাভ নেই। বরং এটা বারবার প্রমাণিত তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা গেলে যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলা সহজ হয়। আর সত্য সামনে থাকলে গুজব ছড়াতে পারে না।

তাই যত নিষ্ঠুরই শোনাক, প্রতিদিন দুপুর আড়াইটার ব্রিফিঙে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল মানুষ। যতদিন করোনা থাকবে, ততদিন ব্রিফিং থাকাটাও প্রয়োজনীয় ও প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু হুট করে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বন্ধ করে দেয়া হলো ব্রিফিংটি। অথচ সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার বিবেচনায় বাংলাদেশে করোনার বিস্তার এখনও উর্ধ্বমুখী। বিশেষজ্ঞরাও এই ব্রিফিংটি অব্যাহত রাখার পক্ষে, প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে একদিন বা দুইদিনই হলেও করতে বলেছেন কেউ কেউ। এসনকি সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও ব্রিফিং অব্যাহত রাখার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু এখনও প্রেস রিলিজেই আছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। করোনা মোকাবেলায় কাগজে-কলমে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ভালো। ঘনবসতির দেশ, সচেতনতার অভাব, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা ইত্যাদি কারণে শুরুর দিকে আশঙ্কা করা হয়েছিল করোনায় বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসা পাবে না, রাস্তাঘাটে লাশ পড়ে থাকবে।

শুরুর দিকে চিকিৎসা নিয়ে নানান অব্যবস্থাপনা থাকলেও সে আশঙ্কা সত্যি হয়নি। উন্নত অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুহার অনেক কম। এখন তো চিকিৎসা ব্যবস্থাও অনেক গোছানো। কোভিড হাসপাতালগুলোর ৭০ ভাগ আসনই খালি। কিন্তু করোনা লড়াইয়ে সবচেয়ে ঘাটতি ছিল সমন্বয়ে। কার কী দায়িত্ব, কেউ কিছু জানে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রী অনেকবার প্রকাশ্যে নিজের অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করেছেন। করোনার তীব্রতার সময় এপ্রিলের মাঝামাঝি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু ব্রিফিং বন্ধের আগে তাদের পরামর্শ নেয়া হয়নি। আসলে তারা জানতেনও না। এর আগে সাধারণ ছুটি শেষ করার ব্যাপারেও এই পরামর্শক কমিটির পরামর্শ নেয়া হয়নি। পরাশমর্শক কমিটির পরামর্শ ছাড়া তবে কার পরামর্শে ব্রিফিং বন্ধ করা হলো?

ব্রিফিং বন্ধ করার সিদ্ধান্তটি আসলে অনেক বড়। কারণ এর মাধ্যমে করোনা আতঙ্ক থেকে উঠে আসার, করোনা উত্তর যুগে প্রবেশের চেষ্টা লক্ষণীয়। কিন্তু করোনা শেষ না হলে তো আপনি খালি ব্রিফিং বন্ধ করে করোনা উত্তর যুগে প্রবেশ করতে পারবেন না। ব্রিফিং বন্ধের কারণ হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন-‘চার মাস, পাঁচ মাস তো হলোই, এখন একটু কন্ট্রোল হচ্ছে বলে আমরা মনে করি, একটু কমে আসছে। রেগুলার ওইভাবে একজন ব্যক্তি দিয়ে প্রেস ব্রিফিং না করে প্রেস রিলিজ দেওয়া হবে।’ কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী যাই বলুন, করোনা কিন্তু কন্ট্রোল হয়নি। কবে হবে সেটাও কেউ জানে না। দুপুর আড়াইটার ব্রিফিং শুধু যে মৃত্যু আর সংক্রমণের সংখ্যা আপডেট করতো তাই নয়; সেখানে করোনা সচেতনতায় অনেকগুলো বার্তা থাকতো। এই ব্রিফিংটি আসলে ছিল সরকারের অবস্থান। ব্রিফিং বন্ধ মানে করোনাকে পাত্তা না দেয়া। কিন্তু সমস্যা হলো, করোনা এমন এক ভাইরাস যার টিকা নেই, সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাও নেই। তাই একে পাত্তা না দিয়ে এখনও উপায় নেই।

পুরোপুরি আতঙ্ক না হলেও বাঁচতে হলে করোনাকে একটু ভয় পেতেই হবে। একটু ভয় না পেলে মানুষ সতর্ক থাকবে না। কিন্তু করোনার গ্রাফ যখন উর্ধ্বমুখী, সচেতনতার গ্রাফ তখন হাওয়া। জীবন আর জীবিকার লড়াইয়ে জীবিকার জয় হয়েছে। আমাদের জীবন এখন একেবারেই স্বাভাবিক। ‘নিউ নরমাল’এর যে ধারণা তাও নেই বাংলাদেশে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর সবকিছুই খোলা। সবকিছুই এখন চলছে, রাখে আল্লাহ মারে কে স্টাইলে। আল্লাহ যতদিন হায়াত দিয়েছেন, ততদিনই বাঁচবো, এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সবাই জীবিকাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে সফল হলেও সে সাফল্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোনো অবদান নেই বললেই চলে। বরং উনি মাঝে মাঝে উল্টাপাল্টা কথা বলে জাতিকে বিনোদন দিয়েছেন। তিনি একজন ব্যবসায়ী, বিশেষজ্ঞ নন। কিন্তু তিনি কথা বলেন বিশেষজ্ঞ স্টাইলে। সর্বশেষ তিনি বলেছেন, ‘ভ্যাকসিন আসুক না আসুক করোনা ভাইরাস বাংলাদেশ থেকে এমনিতেই চলে যাবে।‘ তার এই মন্তব্য নিয়ে তোলপাড় গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বিশেষজ্ঞদের সবাই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই ধারণার বিরোধিতা করেছেন। এমনি এমনি করোনা চলে যাওয়ার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। থাকলে কেউ আর করোনা নিয়ে এত আতঙ্কে থাকতেন না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যাই বলুন, টিকা না আসা পর্যন্ত করোনা নিয়ে স্বস্তিতে থাকার সুযোগ নেই।

তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথায় ভরসা করে আপনি স্ব্যাস্থবিধির হাল ছেড়ে দেবেন না। ব্রিফিং নেই বলে ভাববেন না, করোনাও নেই। বরং করোনার জন্য যা যা স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলুন। করোনাকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বা স্বজন হারিয়েছেন; তারা জানেন করোনা কতটা ভয়ঙ্কর। করোনা থেকে বাঁচতে কী কী করতে হবে, তা আপনারা সবাই জানেন। তবুও আরেকবার মনে করিয়ে দেই। সম্ভব হলে বাসায় থাকুন। বাইরে বের হতে হলে, একটি পরিষ্কার মাস্কে মুখ ও নাক ঢাকুন, চশমায় চোখ ঢাকুন। সম্ভব হলে হাতে গ্লাভস পড়ুন। বাইরে বা অফিসে কোনো জনসমাগমে যাবেন না। আপনার তিন ফুটের মধ্যে যাতে কেউ আসতে না পারে, তা নিশ্চিত করুন।

বাসায় ফিরে গোসল করুন এবং পরণের সব কাপড় ধুয়ে ফেলুন। অফিসে বা বাসায় হাত সবসময় পরিষ্কার রাখুন। ভুলেও নাকে, মুখে বা চোখে হাত দেবেন না। মনে রাখবেন, আপসার সবচেয়ে বড় শত্রু আপনার নিজের হাত। কারণ কোনো করোনা বহনকারী আপনার মুখের ওপর হাঁচি কাশি না দিলে করোনা আপনার শরীরে ঢুকতে পারে শুধু আপনার হাতের মাধ্যমে। করোনা মোকাবেলায় গরম পানি খান, মশলা চা খান, ভিটামিন সি খান, পুষ্টিকর খাবার খান। ভুলেও ঠাণ্ডা পানি, বরফ, ফ্রিজের খাবার বা আইসক্রিম খাবেন না।

পরিমিত খাবারের সাথে পরিমিত ঘুমও দরকার। সম্ভব হলে হালকা ব্যায়াম করবেন, বিশেষ করে ফুসফুসের ব্যায়াম। এত সাবধানতার পরও আপনি আক্রান্ত হতে পারেন। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। পরিচিত কোনো ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখুন। চেষ্টা করুন, বাসায় বসে থেকেই সুস্থ হয়ে যেতে। হাসপাতালে যদি যেতেই হয়, তাহলে কোন হাসপাতালে যাবেন, ঠিক করে রাখুন। এখন করোনার চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। খালি সাবধান থাকতে হবে। আর সময়মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জীবিকাও চলবে, জীবনও বাঁচাতে হবে। আরেকটা কথা, বাসার বয়স্ক এবং অসুস্থ মানুষদের সাবধানে বিচ্ছিন্ন রাখুন।

সরকার ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি তুলে নেয়ার পর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সেটি দিয়েই শেষ করছি লেখাটি- 'সরকার যতই লকডাউন তুলে দিক, আপনি ততই কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। মনে রাখবেন আপনি সরকারের কাছে শুধুমাত্র একটি সংখ্যা, কিন্তু আপনার প্রিয়জনদের কাছে আপনিই পুরো পৃথিবী।'

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।