ইয়াবা ও ‘ইয়াবাই’ উভয়কে তাড়াই

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ১১ আগস্ট ২০২০

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

অনেক নেশাদ্রব্যের ভিড়ে ইয়াবা একটি পুরোনো পরিচিত নাম। এর উৎপাদন, ব্যবসা, বিপণন ও ব্যবহার বিশ্বব্যাপী। জীবন ধ্বংসকারী নিষিদ্ধ এই মাদক সারা বিশ্বে অজানা কারণে খুবই সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। ইয়াবা নিয়ে উৎকণ্ঠার কমতি নেই।

একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকে ২২.৭.২০১৮ তারিখে ‘ইয়াবা ও ইয়াবাই সতর্ক হোক সবাই’ শিরোনামে আমার একটি লেখা প্রচারিত হয়েছিল। সেখানে ইয়াবার সাথে ‘ইয়াবাই’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছি। বেশ কিছুদিন ধরে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের ফলে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার নিয়ে তেমন উদ্বেগ চোখ না পড়লেও হঠাৎ করে মেজর সিনহা হত্যা ও পরবর্তী সংবাদগুলোর সাথে দেশের ইয়াবা প্রবেশের সিংহদ্বার কক্সবাজার জেলার টেকনাফ আলোচনায় ওঠে আসায় লেখাটির প্রেরণা পেয়েছি।

ইয়াবা একটি ‘ক্রেজি ড্রাগ’। এ মাদকদ্রব্যটি সেবন করলে মানুষের মতিভ্রম ঘটে ও চরম মাতলামি শুরু হয়। যতদূর জানা যায়, এর উৎপত্তি হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। এর প্রথম নাম ‘নাৎজী স্পিড’ বা হিটলারের নাৎজী বাহিনীর মতো গতি। হিটলার তার সৈন্যদের দীর্ঘ সময় যুদ্ধক্ষেত্রে সবল রাখার উপায় হিসেবে সে সময়কার নজরবন্দি বিজ্ঞানী ও রসায়নবিদদের এই ওষুধ আবিষ্কার করতে বাধ্য করেন। কালক্রমে এটা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

দেশে দেশে ইয়াবার নামডাক নানাভাবে করা হচ্ছে। থাইল্যান্ডে ইয়াবাকে ‘ম্যাডনেস ড্রাগ’ বা পাগলামি ওষুধ বলে। মিয়ানমারে এটাকে ‘ইয়ামা’ বা ‘হর্স ড্রাগ’ বলে। ভারতে এর নাম ‘ভুলভুলিয়া’, ফিলিপিনস্ ও ইন্দোনেশিয়ায় এর নাম ‘সাবু’। জাপানে ইয়াবাকে বলে ‘কাকুসেইজাই’ সংক্ষেপে ডাকে ‘কাকু’। চীনে ইয়াবাকে বলে ‘মাগো মাগে’। বাংলাদেশে ইয়াবাকে ‘বাবা’ বলা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশে এলাকাভেদে এর নানা ছদ্মনাম রয়েছে। পাগলপারা এ ওষুধটির আসল-নকল রয়েছে। একশ ভাগ আসলটি সেবন করলে মানুষের মধ্যে চরম মাতলামি শুরু হয়।

ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছে লাল, গোলাপী, সবুজ, ক্রিস্টাল নানা রঙের ইয়াবা বড়ি কিনতে পাওয়া যায়। এগুলোর দেশভেদে ভিন্ন নাম থাকলেও আমাদের দেশে মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করার সুবিধার্থে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়। এদের নানা ব্র্যান্ড আছে। তার মধ্যে- জনপ্রিয় চারটি ব্র্যান্ড ০০৭, ডব্লিউ ওয়াউ, চম্পা, নীলা। এই চারটি ব্র্যান্ড-ই ভারতের চব্বিশ পরগণায় উৎপন্ন হয়ে যশোর ও সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান হয়ে আমাদের দেশে আসে। ভারতের মাদক ব্যবসায়ী যারা পূর্বে ফেনসিডিলের চোরাচালান করতো তারা এখন ইয়াবার ফ্যাক্টরি দিয়েছেন। একজন সাংবাদিক তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলেন, সীমান্তের কিছু ওপারেই পাঁচটি কারখানায় ইয়াবা তৈরি হচ্ছে! পূর্বে মিয়ানমার, পশ্চিমে ভারত বাংলাদেশকে ইয়াবা দিয়ে আপ্যায়ন করে চলেছে। আমরা বাংলাদেশিরা বোকার মতো সেগুলো কিনে খেয়ে বুঁদ হয়ে ইহকাল-পরকাল হারিয়ে চলেছি!

শুধু তাই নয়, ইয়াবা সেবনের প্রভাবে যেসব ভয়াবহ সমস্যা হয় তা হলো-প্যারানইয়া, সাইকোসিস ও ভায়োলেন্ট আচরণ করা। ইয়াবার ধোঁয়া মানুষের শ্বসনযন্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। স্ট্রোক, হার্টফেইলিওর, ডিপ্রেশন হতে পারে। পারিবারিক ও সামাজিক ভাঙন (তালাক, একঘরে করা, উক্ত পরিবারে বিয়ে না দেয়া) সূচিত হয় এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

প্রবন্ধটির শিরোনামে উল্লেখিত ‘ইয়াবাই’ কথাটি জাপানি গালি জাতীয় নেতিবাচক শব্দ। জাপানে মাদকদ্রব্যকে বলে ‘মায়াকু’ যেখানে ‘মা’ অর্থ ‘প্যারালাইসিস’ ও ইয়াকু অর্থ ওষুধ। এ ছাড়া জাপানে ইয়াবাকে বলে ‘কাকুসেইজাই’ সংক্ষেপে ডাকে ‘কাকু’। আর ‘ইয়াবাই’ অর্থ বাজেকিছু বা ‘বিপদ ভয়ঙ্কর’। এই শব্দটি হাল্কা মন্দ থেকে চরম নেতিবাচক সব পরিস্থিতিতে ব্যবহৃত হয়। যেমন, বাংলায়- চুপ কর! বেয়াদব কোথাকার। বাক্যটিকে এককথায় ‘ইয়াবাই’ শব্দ দিয়ে বোঝানো যায়। আবার- অন্যায়, অবিচার, কঠিনকাজ, ভয়ঙ্কর, সামনে মহাবিপদ, ইত্যাদিও ক্ষেত্রেও ‘ইয়াবাই’ শব্দ দিয়ে বুঝানো হয়।

যেমন একটি খবরে দেখলাম, দেশ স্বাধীন হবার পূর্বেকার সময়ের আর্থিক-পুঁজিতন্ত্রের ক্ষমতাধারীরা ২২ পরিবার থেকে এখন দেশে ২২ হাজার পরিবার হয়েছে। গণ-অর্থতন্ত্রের ক্ষমতা পারিবারিক পুঁজিতন্ত্রের মধ্যে কুক্ষিগত করার এ প্রক্রিয়াকে ‘ইয়াবাই’ শব্দ দিয়ে বুঝানো যায়। ইয়াবা ব্যবসায়ী ও পাচারকারীচক্র ভাই ভাই। এরা সিংহভাগ ধনীক গোষ্ঠী ও রাজনীতিক শ্রেণির মানুষ। এরা সব সময় আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদেরকে মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে নিজেদের ব্যবসা জিইয়ে রাখে ও স্বাভাবিক চলার পথ পরিষ্কার করে রাখে। এদের অর্থ ও ক্ষমতার দাপট খুব ভয়ংকর।

এদের অর্থ ও বিত্ত কি না করতে পারে? ইয়াবা সম্রাট আমিন হুদার ‘ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগে তার ৭৯ বছর জেল হয়েছে। তিনি ১৮ মাস ধরে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে ছিলেন দু’টি রুম নিয়ে। এসি কক্ষে ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন সবই আছে বডিগার্ড, সহকারী সবই ছিল। যার জেলে থাকার কথা, তিনি মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে বাইরে ঘুরতে যেতেন, শাস্তি হলেও তিনি আরাম আয়েসে থাকতেন!’ আসলে এরাই আমাদের সমাজের ইয়াবাই বা আশ্চর্যজনকভাবে ভয়ঙ্কর শ্রেণি! এদের রুখবে কে?

আরেক ইয়াবাই সম্পর্কে এখন সংবাদে জানা যাচ্ছে- যিনি টেকনাফের সাবেক ওসি। নিরীহ আসামীকে ইয়াবা ধরিয়ে ছবি তুলে মাদক মামলায় জড়িয়ে দিতেন। জানা গেল, “টেকনাফ থানায় ওসি পদে পোস্টিং নিতে এক কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়” (ইত্তেফাক, ৭ জুলাই ২০২০)। কারণ, মাদকের হটস্পট রুট টেকনাফ। “এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ থানায় পোস্টিং ৫০ লক্ষ থেকে এক কোটি টাকা! ইয়াবা ব্যবসায়ীদের থেকে তারা টাকা পান। সেই টাকা ঊর্ধ্বতন কর্তাদের দিয়ে থাকেন।” নিষিদ্ধ ইয়াবা যাতে সীমান্ত পথে চোরাচালান হয়ে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য যাদেরকে সরকারি দায়িত্ব দিয়ে পাহারায় বসানো হয়েছে তারা যদি ঘুষ নিয়ে অন্যায়ভাবে এই দুষ্কর্ম করতে সহায়তা করে নিজে লাভবান হন এবং সেই সঙ্গে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের ম্যানেজ করেন তাহলে একাজে জড়িত সবাইকে ‘ইয়াবাই’ বলা যাবে।

এদেশে কোন কোন সাংসদ, নেতা, মাদক ব্যবসা করে অভিযুক্ত হয়েও মন্ত্রীর পিছনে সদর্পে ঘুরে বেড়ান। আমরা দেখলাম, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা রাঘব বোয়াল অপরাধীদের পাহারা দেন! অথচ, তারা রমনা পার্কের ইয়াবার পুড়িয়া বিক্রিওয়ালীকে সকালে-বিকেলে ধরে নিয়ে সহজে ছেড়ে দেন না! আমরা এটাও জানি যে, বর্তমানে দেশে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর মধ্যে অনেক মেধাবী গবেষক, অভিজ্ঞ নীতি-নির্ধারক রয়েছেন। তারা সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে গবেষণালব্ধ অনেক আধুনিক কথা বলেন। শুধু তারা জানলে ও বললেই চলবে না- বাহিনীগুলোর নিন্মপদে মাঠপর্যায়ে কর্মরত সদস্যদেও জন্য বেশি বেশি প্রশিক্ষণ ও মটিভেশনাল ওয়ার্কশপ করা প্রয়োজন। কারণ, মাদকদ্রব্য অনুপ্রবেশ, পাচার, বিক্রি, ব্যবহার বন্ধ করতে হলে সর্বাগ্রে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সকল পর্যায়ে কর্মরত সদস্যদের কঠিন প্রতিজ্ঞা (কমিটমেন্ট) করা দরকার। তারা সবাই একটু মনোযোগী হলেই এদেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন কাজ নয়। আর যারা এ কঠিন প্রতিজ্ঞা করতে চান না তারা বাংলাদেশের ক্ষতি করার জন্য ‘ইয়াবাই’।

একটা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ না করলে আরেকটা অপরাধের জন্ম হয়। একটি মিথ্যাকথা আরো সাতটি মিথ্যাকথার জন্ম দেয়। পাপ বেশি হলে সেটা কোন ঢাকনা দিয়ে চেপে রাখা যায় না। মানুষের অপরাধ করার অন্যতম উৎস হলো নেশা সেবন করে মাতাল বা জ্ঞানশূন্য হওয়া। কিছু মানুষ মাতাল হওয়াটাকে ধ্যান-জ্ঞান মনে করে বড় অপরাধ ঘটায়। একসময় নেশা তাদেরকে অতি আপন করে নেয়, তারা ছাড়তে চাইলেও নেশা তাদেরকে ছাড়ে না। ফলে অপরাধের ক্ষেত্র হয় বহুধা-বিস্তৃত, সমাজ হয় কলঙ্কিত। তাই এ মুহূর্তে আমাদের দেশের মাদক ও মাদক সঞ্জাত অপরাধ নির্মূলে ‘ইয়াবা’ ও ‘ইয়াবাই’ উভয়কে তাড়ানোর কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাঠে নামার জন্য সৎ-সাহসী মানুষ প্রয়োজন।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।