দেশটাতো কাউয়াদের নয়!
রিজেন্ট-জিকেজি'র (শাহেদ-সাবরিনা) পর নতুন আলোচিত নাম হয়ে উঠে এসেছিল সাহাবউদ্দিন মেডিকেল হল। শাহেদ-সাবরিনার মধ্য দিয়ে সারাদেশের চিকিৎসা খাত আলোচনায় উঠে এসেছে। কিন্তু এরকম আলোচনা নতুন কোন বিষয় নয়। এর আগেও ক্যাসিনো জিকে শামিম, পাপিয়া, বালিশ-পর্দাকাণ্ডসহ অনেকে অনেক ব্যাপার উঠে এসেছে গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শুধু এ আমলে নয়, সব আমলেই যেমন মামুন, মীর্জা, বাবর কিংবা খাম্বা-হাওয়া-জাহাজ প্রভৃতি অনেক অনেক নাম-ভবন-বাণিজ্য লোকালয়ে কিংবা জনসমক্ষে এসেছে, আমরা দেখেছি শত-সহস্র কোটি টাকা লোপাটের কথাগুলো এর আগেও।
শুধু তো এই দুজন নর-নারী নন, ভিন্ন খাতেও আছে সাগর মন্থন করা দুর্নীতির চিত্র। ওই নর-নারীর সাথেই তো আরেক নারীকে দেখেছে বিশ্ব। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নূরজাহান আক্তার। কিন্তু বছর চারেকের মধ্যে তিনি যত সম্পদের মালিক হয়েছেন, এক কথায় তা গল্পকেও হার মানায়। ঢাকার মিরপুর ও আশুলিয়ায় তিনটি বাড়ি, বেইলি রোড, চামেলীবাগ, মীরবাগ ও কাকরাইলে চারটি আলিশান ফ্ল্যাট, আফতাবনগরে দুটি প্লট, আশুলিয়া ও কুমিল্লার বাঙ্গরা বাজারে কোটি কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে নূরজাহান-সাত্তার দম্পতির। এক কোটি ২৫ লাখ টাকার প্রাডো এবং ২৬ লাখ টাকার এলিয়ন গাড়িতে চলাফেরা করেন এই পরিবারের সদস্যরা। অথচ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে অস্থায়ী কর্মচারী হিসেবে নূরজাহানের সর্বসাকুল্যে বেতন ২৮ হাজার টাকা।
ফরিদপুরের বরকত-রুবেল দুই ভাইয়ের হাতে ছিল আলাদিনের প্রদীপ। কি নেই তাদের। বরকতের ছিল আওয়ামী লীগের শহর কমিটির সম্পাদকের পদ, আরেক ভাই পত্রিকা খুলে হয়েছিলেন সম্পাদক, আওয়ামী লীগের পরিচয়ে দুজনই হয়ে উঠেছিলেন ফরিদপুরের সম্রাট। কত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন তারা, তা কেউ জানতো না। শুধু তাদের দাপট দেখতো আর দেখতো তাদের বাড়ি-গাড়ি-বাস-ট্রাক-ট্রাক্টর-ভবন-রেস্টহাউস-চরের-বসতের জমি আর ক্ষমতা। যেদিন দু'ভাই গ্রেফতার হলো ফরিদপুরের মানুষ না-কি বিশ্বাসই করতে পারেনি তা।
সারাদেশেই এরকমের ভাইদের রাজত্ব, এমনকি উপজেলা পর্যায়ে এদের দাপটে-সন্ত্রাসে এরা পেয়ে গেছে টাকার খনি। হুট করে হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার মালিক। কেন জানি বাংলাদেশে দুর্নীতিটা এভাবেই অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে বসে থাকা কর্তাব্যক্তিরা এসব দুর্নীতির সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছেন। স্বাস্থ্য-শিক্ষা-শ্রম-পরিবহন-যোগাযোগ কিংবা জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রধান প্রধান অনেক মানুষের নগদ অর্থ, ফ্ল্যাট-গাড়ি-বাড়ি-ভ্রমণ প্রভৃতিতে বিস্ময় জড়ানো অর্থ বিনিয়োগ কিংবা ব্যয় করা দেখছে বাংলাদেশ। শত শত কোটি টাকা মানুষের বাসার ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
সরকারি চাকরিতে থেকে মাত্র কয়েক হাজার টাকা বেতনের চাকরি করা মানুষের লেটেস্ট মডেলের গাড়ি আর বাড়ির জৌলুস চোখ ধাঁধাচ্ছে। সরকারি দলের ছাত্রনেতার পরিচয়ে টেন্ডার কিংবা দালালি করে কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যাংক আর ব্যবসায় ফুলেফেপে ওঠার ঘটনা একটা দুটো নয়। শত শত, সহস্র। বাস্তবতা হলো, এদের সবাই-ই কোন না কোনোভাবে সরকারি দলের ছায়ায় বেড়ে ওঠা। দেশজুড়ে যে অসংখ্য নাম উঠে আসছে, তাদের দু-একজন ছাড়া সবাই তো দলটির সাথে সংশ্লিষ্ট। এদের অনেকেই কেন্দ্রীয় কমিটিতেও জায়গা করে নেয়া। কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা করে নিলে কাউকে কি অনুপ্রবেশকারী বলা যাবে? কারণ মূল নেতৃত্বের সমর্থনেই এরা পদ-পদবি বাগিয়ে নেন।
বাংলাদেশেসহ তৃতীয় বিশ্বে যে এরকম দুর্নীতি হচ্ছে তা নয়। উন্নত দেশগুলোতেও বড় বড় দুর্নীতি হয়, হয়েছে। কিন্তু পার্থক্যটা হলো, এরকম দুর্নীতি-অনিয়মে রাষ্ট্রের তথা ক্ষমতায় থাকা কারো কোন সংযুক্তি প্রমাণ হলে তাকেও বিদায় নিতে হয় অর্থাৎ রাষ্ট্রের আনুকল্য থাকে না দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষটির প্রতি। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান এবং বেয়াড়া রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত আইনের বাইরে যেতে পারছেন না। করোনাকালীন সময়ে নিউ ইয়র্কের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে নিউ ইয়র্কের মেয়র ট্রাম্পের কথায় তার নগরের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি। মাত্র ক'দিন আগেও ট্রাম্প নির্দিষ্ট ধারায়ই চলে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেই সম্ভবত রাজনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় সবকিছু। বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের কর্মী নেতারা হয়ে ওঠেন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়েও সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। এই যে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা থাকার কারণে স্থানীয় মাস্তান থেকে শুরু করে এমনকি শিক্ষিত মানুষগুলোর একটা বড় অংশও চায় যার যার ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করতে। এবং সেজন্যই এরা সরকারি দলেই নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে চায়। সুসংহত করতে গিয়ে নেতার ছবি এরা বুক পকেটে নিয়ে ঘোরে, তাদের হাতের মুঠোয় থাকে বিভিন্ন নেতার সাথে হাস্যোজ্জ্বল ছবি। এই ছবিগুলোই হয় তাদের হাতিয়ার। এই হাতিয়ার দিয়েই কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কিছু অপ্রতিদ্বন্দ্বী দুর্নীতিবাজ মানুষ তৈরি হয়েছে, যারা স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগসাজশ করে নিজেদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে যার যার জায়গায়। সে কারণেই রাজনীতির মাঠে এখন আসল মানুষগুলো উপেক্ষিত।
সুযোগের সন্ধানে থাকে যারা, তাদেরই এখন পোয়াবারো। বাণিজ্যে যাদের লক্ষি, রাজনীতিতে তারাই পাকা খেলোয়াড়। এই খেলোয়াড়দের অনেকেরই রাজনৈতিক ইতিহাস বইয়ের ছেড়াপাতার মতো। বিভিন্ন দল থেকে লাফ দিয়ে নৌকায় উঠা নেতাদের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু অতীতে দেখা গেছে অনেক নেতাই নৌকায় উঠার পর বঙ্গবন্ধুকেই এরা আদর্শের জায়গায় রেখেছেন এবং কাজ করেছেন আওয়ামী লীগের জন্য, জনতার জন্য। সেজন্য কোন দল থেকে অন্য দলে জায়গা করে নেয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু কে আসছে, কারা আসছে, দলের নীতির সাথে এরা কতটুকু মানানসই, তা-ই তো বিচার করাটাই হলো যিনি আমন্ত্রণ করে আনছেন, তার দেখার দায়িত্ব।
বিভিন্ন দল থেকে ক্ষমতাসীন দলে এসে ভিড় করাটা কোনো অলিক বিষয় নয়। অনেক সময় ক্ষমতায় যারা থাকে, তাদের জন্যও এই ভিড় করা মানুষগুলো সার্থকতা বয়ে আনে। উপজেলা-জেলা এমনকি কেন্দ্রেও কিছু নেতা কিংবা কর্মীদের দলে জায়গা দিলে দল বিভিন্নভাবে সফলতা পায়। কিন্তু এখনকার বাংলাদেশের বাস্তবতাটা কি? এদের কারণে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা এরাই অবলীলায় পাঠিয়ে দিচ্ছে, পাচার করছে। রাজনীতি দিয়ে এরা সাধারণ মানুষের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে আর ব্রিটেন-কানাডা-আমেরিকায় আলিশান ব্যবসা আর বাড়ি বানাচ্ছে। বিস্মিত হতে হয়, এদের প্রশ্রয় দেয় একটা গুষ্ঠী, এদের সমর্থন দেয় অবার্চীন কর্মীরা। সে কারণেই রাষ্ট্রের রন্দ্রে রন্দ্রে বসে আছে রক্তপিপাসু রাক্ষস, যারা রাষ্ট্র-সমাজ-রাজনীতিকে নিয়ে যাচ্ছে পঙ্কিলতায়।
কাউয়া কিংবা অনুপ্রবেশকারী এই দুটো শব্দ সরকার দলে বড় বেশি উচ্চারিত। এ উচ্চারণ যে হালেই উচ্চারিত হচ্ছে, তা নয়। গত কয়েক বছর থেকেই এ দুটো শব্দ বিভিন্নভাবেই আলোচনায় আনা হচ্ছে। কিন্তু কথা হলো কে কাউয়া, কে অনুপ্রবেশকারী তার কোন ব্যাখ্যা আসেনি এখনও। কিন্তু আওয়ামী লীগের অভ্যন্তর থেকে এ কথাগুলো উচ্চারিত হয় বেশি। এবং তখনই উচ্চারণ করা হয়, যখন কোন বড় ধরনের দুর্নীতি কিংবা অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে কোন নেতা বা কর্মী লাইম লাইটে আসেন।
বিগত তিন ধাপে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। কার্যত এ সময়ে বাংলাদেশে বিরোধী দলও কোণঠাসা। দেশের রাস্তা-ঘাট, চিকিৎসা-শিক্ষা তথা বাংলাদেশে উন্নয়ন-অগ্রগতিতে অবকাঠামো বিনির্মাণে সরকারের বিনিয়োগ কিংবা অর্থসহায়তা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশি। স্বাভাবিকভাবেই দেশের অবকাঠামো নির্মাণে কন্ট্রাক্ট-পার্সেন্টেজ কিংবা সুযোগ-সুবিধা এগুলো সরকারি দলই ভোগ করে। সেজন্যই বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশে বেড়েছে শত সহস্র কোটিপতির সংখ্যা। শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন অনেকেই। দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা ছাড়া হুট করে অনেকে নিয়ে এসেছেন এই ফরচুন কিংবা ভাগ্য।
সাহেদ-সাবরিনা-জিকে শামিম-সম্রাট-পাপিয়া-নূরজাহানদের গডফাদাররা বসে আছে বিভিন্ন জায়গায়, বড় শক্ত এদের ভীত। কিন্তু এ ভিত তো আর মজবুত হতে দেয়া যায় না। কথায় কথায় অনেকের সাথেই কথা হয়, কীভাবে মুক্তি আসবে? একটা মাত্র উত্তর দেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা-প্রধানমন্ত্রী একা কত দেখবেন। অথচ এখন বাংলাদেশ মানেই যেন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের কর্মী-নেতারা বলেন আওয়ামী লীগ একটা অনুভূতির নাম। অথচ এই অনুভূতি নিয়ে এই বিশাল দলে নেতা-কর্মী তথা মানুষের তো অভাব নেই। এত মানুষের মাঝে কাউয়া হওয়ার কথা তো এক দুটো, অনুপ্রবেশকারীই বা কজন? সেজন্যই বলি, একজন শেখ হাসিনা কেন একা সামলাবেন এসব। পরিষদের কাজটাইবা কি?
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস