কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং গ্রামীণ অর্থনীতি বাঁচাতে হবে
প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী
সংকট-দুর্যোগের মধ্যদিয়ে ঈদুল আজহা আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। বিগত এক শতকে দেশে এমন পরিস্থিতিতে ঈদ উদযাপিত হওয়ার নজির নেই। একদিকে করোনা সংকটে দিশেহারা মানুষ। আতঙ্কিত দেশবাসী। বিপর্যন্ত জনজীবন। অর্থনীতির চাকা মন্থর। ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে লিপ্ত দেশের শিল্প-বাণিজ্যখাত। দিনদিন কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ঈদের পশুরহাট আক্রান্ত ও মৃত্যুর শঙ্কা বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, অদক্ষতা আর সীমাহীন দুর্নীতি চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশুহাটের অনুমতি দেয়া হলেও হাটবাজারে তা মানার কোনো গরজ তেমন একটা চোখে পড়ছে না। গ্রামের মৌসুমী পশুহাটের অবস্থা তো আরও নাজুক। ক্রেতা বা বিক্রেতা কারও মাঝেই স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এদিকে সংক্রমণরোধে ঈদের আগে-পিছে গণপরিবহন বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও তা আর হচ্ছে না। ফলে শুধু রাজধানী ঢাকা থেকেই প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ মানুষ ঈদ উদযাপনে গ্রামে ফিরে যাবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন ব্যবহার হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ঈদুল ফিতরের ঈদের অভিজ্ঞতা কিন্তু মোটেই সুখকর ছিল না। অন্যদিকে করোনাকালের মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও সাম্প্রতিক বন্যা গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে লণ্ডভণ্ড দেশের উপকূলবর্তী দক্ষিণাঞ্চল। বাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত। বহুমানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। সঙ্গত কারণেই তাদের জন্য এবারের ঈদ নিরানন্দ হবে তা বলাই যায়।
এদিকে দেশের বহু জেলার নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। ক্ষেতের ফসল নষ্ট। কৃষক দিশেহারা। সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে গবাদি পশুর খামারিরা। গো-খাদ্যের সংকট তীব্র হয়েছে। এবার হাটবাজারে গরুর দাম তুলনামূলক কম। খামারিরা লোকসানের শঙ্কায় উদ্বিগ্ন। যখন দেশের খামারিও কৃষক পশুবিক্রি করা নিয়ে চিন্তিত, লোকসানের শঙ্কায় শঙ্কিত, তখন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চোরাইপথে ভারত ও মিয়ানমার থেকে বিনা বাধায় গরু নিয়ে আসছে বলে অভিযোগ আছে। সীমান্ত লাগোয়া হাটবাজারে বিক্রি হচ্ছে চোরাই ভারতীয় গরু। সংকটে ও লোকসানের ঝুঁকিতে দেশের খামারি ও কৃষক। সংকটকালীন দেশীয় খামারিদের বাঁচাতে পশু চোরাচালান কঠোর হস্তে বন্ধ করা দরকার। এবারের বন্যা যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতির সংকট আরও প্রকট হবে।
আমরা কমবেশি সবাই জানি যে, দেশে বহুমানুষ চাকরি হারিয়ে এখন গ্রামে। তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এমনিতেই করোনার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি চাপে রয়েছে। এর মধ্যেই নতুন করে যোগ হয়েছে বন্যা। দিশেহারা গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা জরুরি। কর্মসংস্থানের নতুন নতুন খাত খুঁজে বের করা অত্যাবশ্যক। কৃষির পাশাপাশি গুরুত্ব দিতে হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে সহযোগীকরণ করার মধ্যদিয়ে গ্রামীণ জনপদে অর্থপ্রবাহের গতিকে সচল রাখতে হবে। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর খুব একটি ভালো অবস্থায় নেই। তাই তারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কৃষিঋণ ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এমন প্রেক্ষাপটে মাইক্রো-ক্রেডিড ও এসএমই খাতই হতে পারে গ্রামীণ অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখা বা সচল রাখার অন্যতম হাতিয়ার।
করোনাকালে দেশের মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার সবচেয়ে বেশি কষ্টের মধ্যদিয়ে দিনাতিপাত করছে। বহুমানুষ গরিব হয়ে গেছে। আয় কমে গেলেও ব্যয়ের পরিমাণ একই রয়ে গেছে। সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ ও শ্রমজীবী মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যকে। চলমান বন্যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের কষ্টকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিবছর বন্যা জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। বলতে গেলে এসবের সাথেই আমাদের বসবাস। তাই বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি টেকসই কর্মপন্থা গ্রহণ সময়ের দাবি। বন্যাকালীন সরকারি-বেসরকারি সাহায্য অপ্রতুল। বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন পরিকল্পনা সঠিকভাবে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা না গেলে গ্রামীণ জনপদের অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্রতর হবে।
এমনিতেই করোনার সামাজিক সংক্রমণ নগরজীবনের কোলাহলকে অনেকটাই স্তব্ধ করে দিয়েছে। তার ওপর কোরবানির পশুহাট সংক্রমণের ঝুঁকিকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিভাগের অসুস্থতা জনমনে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে। রিজেন্ট, জেকেজি, সাহাবউদ্দিন হাসপাতালের করোনা কেলেঙ্কারির আলোচনা ও সমালোচনা সমাজে তুঙ্গে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিএসএমএমইউয়ের চিকিৎসকদের জন্য নিম্নমানের মাস্ক সরবাহের ঘটনা জাতিকে হতাশ করেছে।
মানুষ খুব অসহায় হলে সেবা নিতে চিকিৎসা কেন্দ্রে যায়। ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। প্রান্তিক জনপদের অধিকাংশ মানুষ সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে থাকে। করোনাকালে হাসপাতালগুলোর ভঙ্গুর স্বাস্থ্যসেবা জনসস্মুখে চলে আসায় ভবিষ্যতে সেবাপ্রাপ্তি নিয়ে একপ্রকার অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে।
যাক সেসব কথা, বলছিলাম যেকোনো ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহর দেয়া নিয়ম-নীতি ও পন্থা অনুসরণ করে তা প্রতিপালন করে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন করা। একই কাজ অথচ পদ্ধতি ভিন্ন হলে ইবাদত কুফরিতেও পরিণত হতে পারে। যেমন অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থে কোরবানি দিলে তা কবুল হবে না। অর্থাৎ শুধু আনুষ্ঠানিকতাই ইবাদত নয়, হতে পারে না। বরং ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য হলো দুটি। প্রথমত যেকোনো কাজ ইসলাম নির্দেশিত পথে পালন করা, দ্বিতীয়ত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
তাই সংকট ও দুর্যোগের মধ্যে হতে যাওয়া কোরবানি যেন শুধু গোসত খাবারের উৎসবে পরিণত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যে কথা বলছিলাম, করোনাকালে আমাদের দেশের কিছু কিছু মানুষের মধ্যে অতি মুনাফা অর্জনের লোভ খুব নির্লজ্জভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ভুয়া করোনা টেস্টের ফলে জাতি হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
গত বছর এতিমের হক কোরবানির পশুচামড়া নিয়ে যা হয়েছে তার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এখন থেকেই প্রস্ততি নিতে হবে। কোনোভাবেই যেন দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা এতিমের হক পশুচামড়ার টাকায় ভাগ বসাতে না পারে সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। দেশের কওমি মাদরাসা, লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানার ব্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পশুরচামড়া থেকে অর্জিত হয়ে থাকে।
তাই আসুন সংকট ও দুর্যোগকালীন শতাব্দীর ব্যতিক্রমী পরিবেশের ঈদে সবাই ত্যাগের মহান শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে দেশগঠনে আত্মনিয়োগ করি। দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে সকল প্রকার অনিয়ম, দুর্নীতি থেকে নিজেদের বিরত রাখি।
লেখক: আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম