মালয়েশিয়ার অমানবিক আচরণ এবং অভিবাসী সংকটে মুসলিম বিশ্বের দায়
সহীহ মুসলিম শরীফের হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘মুসলিমরা একটি দেহের ন্যায়। যখন ওই দেহের চোখ আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন পুরো দেহ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আর যখন ওই দেহের মাথা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন পুরো দেহ আঘাত প্রাপ্ত হয়।’ সম্প্রতি মালয়েশিয়ার অভিবাসী সংকটে ইসলামের এই দর্শন উপেক্ষিত হয়েছে মালয়েশিয়ার মুসলিম নেতাদের কাছে।
করোনার লগডাউনে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের সাথে মালয়েশিয়ার সরকার অমানবিক আচরণ করেছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ওই সংবাদে বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিক সাক্ষাৎকার দেয়ায় মালয়েশিয়ার পুলিশ সাক্ষাৎকার প্রদানকারীকে হয়রানি করছেন এমন সংবাদ বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়কে মর্মাহত করেছে। মুসলিম দেশ হওয়ায় মালয়েশিয়ায় অভিবাসী হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশী মুসলিমদের অতি আগ্রহ থাকে। তারা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় শ্রমিক হিসেবে মালয়েশিয়ায় কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকরা মালয়েশিয়ায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ থেকে ভবিষ্যতে অভিবাসী শ্রমিক পাওয়ার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়াকে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে।
শুধু বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে নয়, বিভিন্ন সময়ে মুসলিম অভিবাসীরা থাইল্যান্ডের উপকূলে আন্দামান সাগরে খাদ্য ও পানি ছাড়া দিনের পর পর দিন অতিবাহিত করলেও মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া তাদের আশ্রয় প্রদান করে নি। উপকূলে আশ্রয় লাভের জন্য মুসলিম অভিবাসীদের নৌকাগুলো বারবার ভিড়তে চাইলেও মুসলিম উপকূল রক্ষীরাই তাদের সাগরে কূলহীন জলরাশিতে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে। যদিও শেষপর্যন্ত আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সরকার মুসলিম রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী অভিবাসীদের আশ্রয় প্রদান করে।
তবে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার উপকূল রক্ষী ও পুলিশের মুসলিম অভিবাসীদের প্রতি আরো সদয় হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের উপকূল রক্ষী, বিজিবি ও পুলিশের রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতার উদাহরণ অনুসরণ করতে পারেন। বাংলাদেশ চাইলে খুব সহজেই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সংকটকে অত্যন্ত মানবিক বিবেচনা করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছে।
দুই.
শিয়া-সুন্নি মতবাদে বিভক্ত মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর হীন রাজনৈতিক স্বার্থই বর্তমান মুসলিম অভিবাসী সংকটের জন্ম দিয়েছে। পেট্টো ডলারের অধিকারী ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী মধ্যপ্রাচ্যের ওই রাষ্ট্রগুলো পরোক্ষভাবে হলেও মুসলিম অভিবাসীদের বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়স্থল ছিল। ওই রাষ্ট্রগুলোয় এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্রপীড়িত মুসলিম রাষ্ট্রের এবং অমুসলিম রাষ্ট্র থেকে আশ্রয়চ্যুত মুসলিমরা নানা কাজের সুযোগ পেত। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মুসলিম রাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার সম্ভবনা তৈরি হওয়ায় কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে। দারিদ্রের কষাঘাত থেকে নিজেকে এবং নিজ পরিবারকে মুক্ত করে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে যে সব মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসী হয়েছিলেন, আজ তারাই আবারও প্রাণ বাঁচাতেই অন্যদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
যে মধ্যপ্রাচ্য একদা মুসলিম অভিবাসীদের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল সেই মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধস্ত অনেক দেশের অধিবাসীরাই আজ অভিবাসী হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে বেড়াচ্ছেন। সংখ্যায় কম হলেও থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়ার উপকূলে অথবা আন্দমান সাগরের ভাসমান নৌকাগুলোয় বাঙালি ও রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক থেকে পালিয়ে আসা মানুষরাও আছেন। তারাও মানব পাচারের ওই রুট ব্যবহার করে ইউরোপের কোনো দেশে পাড়ি জমাতেই দেশান্তরী হয়েছেন। স্বদেশ ত্যাগ করে অভিবাসী হওয়ার জন্য অবৈধ পথে সাগর পাড়ি দেওয়াদের দলে ভিড়েছেন।
মুসলিমদের দেশান্তরী হওয়ার ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট অন্যতম কারণ হলেও অমুসলিম প্রধান রাষ্ট্রগুলোয় মুসলিম অভিবাসীদের উপর নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনার দায়ও কম নয়। রোহিঙ্গা মুসলিমরা এক সঙ্গে হাজার হাজার দেশান্তরী হওয়ায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর দৃষ্টি সেদিকে পড়েছে। কিন্তু এর বাইরেও ভারতের কাশ্মীর, রাশিয়ার চেচনিয়া, চীনের উইঘুরসহ ফিলিস্তিনের মুসলিমরা প্রায় প্রতিদিনই দেশান্তরী হচ্ছে। আর তাদের এই দেশান্তরী হওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনীতির চেয়ে রাজনীতির দায় বেশি।
তিন.
রোহিঙ্গা থেকে উইঘুর তথা বিশ্বের নানা প্রান্তে নির্যাতিত-নিপীড়িত অমুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলিমদের অভিবাসী হওয়ার দায় মুসলিম নেতারা এড়াতে পারেন না। ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়ার মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো চাইলে ওই সব অভিবাসী মুসলিমদের অর্থনৈতিক সংকট দূরকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। সৌদি আরবের মতো পেট্টো ডলারের অধিকারী আরব রাষ্ট্রগুলোও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য মুসলিম অভিবাসীদের তাদের ভাগ্যের উন্নয়ণে মুসলিম নেতারা সব সময়ই উদাসীন থেকেছেন। আন্দামান সাগরে ভাসমান মুসলিম অভিবাসীদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়লেও সৌদি আরব বা কুয়েতের মতো পেট্টো ডলারের অধিকারী কোনো মুসলিম রাষ্ট্রকে তাদের উদ্ধারে বা পুনর্বাসনে এগিয় আসতে দেখা যায়নি।
মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী এই রাষ্ট্রগুলোর নিরাবতায় বলে দিচ্ছে যে, মুসলিম অভিবাসীদের প্রতি আমেরিকা ও ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ওই সব মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গির খুব বেশি পার্থক্য নেই। যদিও বিভেদ ভুলে সৌদি আরব, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তানের মতো আন্তর্জাতিক বিশ্বের উপর প্রভাব বিস্তারকারী ও অর্থণৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী মুসলিম দেশগুলো মুসলিম অভিবাসী সংকট সামাধানে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসত; তবে এই সংকট সমাধান কঠিন হবে না। এক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সংগঠন ওআইসির দায় এড়িয়ে যাওয়াটাও আমাদের চোখে পড়েছে। বিভিন্ন সময়ে মুসলিম অভিবাসী সংকট নিয়ে যখন জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অভিবাসীদের আশ্রয় প্রদান করতে ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়াকে চাপ প্রয়োগ করেছে। তখন ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী ওআইসি ঘুম ভাঙ্গেনি।
পরিশেষে, মুসলিম অভিবাসী সংকটের মুল কারণ রাজনীতি। মুসলিম ও অমুসলিম রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অস্থিরতায়ই মুসিলমদেরকে অভিবাসী হতে বাধ্য করছে। সামরিক ক্ষেত্রে দুর্বল মুসলিম নেতাদের পক্ষে মুসলিম অভিবাসী সংকট সমাধানে অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে রাজণৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা কঠিন হবে। তবে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো তথা আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, বৃটেনের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকায় মুসলিম নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলিম অভিবাসী সংকটের রাজনৈতিক সমাধান করতে ওই সব রাষ্ট্রগুলোকে প্রভাবিত করা কঠিন হবে না।
স্বপ্রণোদিত হয়ে যদি সব মুসলিম নেতারা এগিয়ে আসতেন তাহলে অচিরেই রোহিঙ্গা সংকটসহ অভিবাসী সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেত। কিন্তু দুভার্গ্য মুসলিম বিশ্বের নেতারা মুসলিম অভিবাসীদের রক্ষায় এগিয়ে আসেন নি। আর একটি কথা না বললেই নয়, মুসলিম অভিবাসী সংকট সমাধানে সবার আগে বিভেদ ভুলে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে চলমান যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটিয়ে মুসলিম বিনা এক দেহ এক প্রাণ হয়ে উঠতে হবে। তবেই মুসলিম অভিবাসী সংকট সহ মুসলিম বিশ্বের অনেক সংকটের সমাধান করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
এইচআর/এমএস