মানুষ মানুষের জন্য
সময়ের পরিক্রমায় একদিন আমরাও বৃদ্ধ হব। মাথার কালো চুলগুলো হয়ে যাবে সাদা । দেহের শক্ত হাড়গুলো হয়ে পড়বে দুর্বল। কপাল আর গালের মাংসপেশিতে ফুটে উঠবে বলিরেখা। আজ আমাদের নানা-নানি, দাদা-দাদি যে অবস্থায় আছেন, একদিন আমাদেরও সেই অবস্থা হবে।
আমাদের উচিত বয়স্কদের সম্মান করা। আমাদের কারো আচরণে তাঁরা যেন কষ্ট না পান, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। কিশোর-তরুণ তোমরা যারা রাজধানীতে লেখাপড়া করছ, তোমরা অনেকেই ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া করবে বা করছ। তোমাদের দাদা-দাদি, নানা-নানি বা পরিবারের বয়স্ক যাঁরা আছেন, তাঁরা তোমাদের মতো সুন্দরভাবে ইংরেজি বলতে পারেন না। তোমাদের মতো আধুনিকতার সঙ্গে বিভিন্ন দিবস উদযাপন করতে পারেন না। কারণ, তোমাদের স্কুল–কলেজগুলোতে বিশেষ বিশেষ দিবসে নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হয়।
যেমন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, পয়লা বৈশাখ, মাতৃভাষা দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস ইত্যাদি। কিন্তু আমরা বা বয়স্ক যাঁরা আছেন, বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, তাঁরা যখন ছাত্র বা ছাত্রী ছিলেন, তখন তাঁরা এই আনুষ্ঠানিকতাগুলো পালন করার সুযোগ পাননি। কারণ, তখন এসব রীতি ছিল না। তাই তোমাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বৃদ্ধ যাঁরা আছেন, তাঁরা এই আয়োজনগুলো পছন্দ না–ও করতে পারেন বা তাঁদেরকে তোমাদের ব্যাকডেটেড মনে হতে পারে। কিন্তু তোমাদের এই মন-মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তোমরা ডিজিটাল যুগের ছেলেমেয়ে হলেও তোমাদের মন-মানসিকতা, চিন্তাচেতনা হতে হবে উদার।
পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি বা আত্মীয়স্বজনের প্রতি তোমাদের ব্যবহার, চিন্তাচেতনা এমন হতে হবে, যেন তোমাদের দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারে তোমার ছোট ভাই বা বোন। তোমার দাদি বা দাদা হয়তো লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন। তুমি তাঁর পাশে দিয়েই যাচ্ছ, এই সময় তুমি বা তোমরা যদি তাঁর হাত ধরে একটু সহযোগিতা করো, তাহলে তাঁর খুব ভালো লাগবে। আজকে আমাদের লাঠিতে ভর দিতে হাঁটতে হচ্ছে না, কিন্তু জীবনে এমন একটা দিন আমাদের আসতেও পারে, যখন আমরা লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটব। আমাদের মেরুদণ্ডের হাড়টা বেঁকে দুর্বল হয়ে যাবে। আমরা সোজাভাবে চলাফেরা করতে পারব না।
আমরা যদি বাসার বৃদ্ধদের সঙ্গে ভালো আচরণ করি, তাঁদেরকে একটু সময় দিই, তাহলে তাঁরা খুশি হবেন। আমাদের সবারই একটা নিজস্ব জগৎ আছে। বাসার মা যিনি, তিনি রান্নাঘর, বাসার যাবতীয় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাবা সাধারণত চাকরি বা ব্যবসা করেন বা পরিবারের খরচ চালানোর জন্য তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়। তোমাদেরকে স্কুল বা কলেজের ক্লাস, কোচিং, সৃজনশীল কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। কিন্তু বাসার বয়স্ক সদস্যটির কোনো কর্মক্ষেত্র থাকে না। তাই তিনি একাকিত্ব বোধ করেন। আমরা সবাই নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তাই তোমাদের সেভাবে সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু আমাদের একটু সহযোগিতা, বন্ধুত্ব, একটু সময় এই মানুষগুলোর জন্য হয়ে ওঠে স্বর্গীয় উপহার।
আর পরিবারের প্রিয় একজন সদস্যের জন্য ভালো কাজ করতে পারার আনন্দ আমাদের করবে মহান। বিশেষ বিশেষ দিবস ছাড়াও আমাদের কাছ থেকে পাওয়া একটি ছোট্ট উপহার পরিবারের নানা-নানি, দাদা-দাদিকে দেবে অনেক আনন্দ। তাঁরা একাকিত্বে ভোগেন খুব বেশি। তাঁদের পছন্দের কিছু উপহার দেওয়া বা ছুটির দিনে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, যদি তাঁদের সামর্থ্য থাকে। এতে তাঁদের মানসিক প্রশান্তি মিলবে। তাঁরা দীর্ঘ সময় গৃহবন্দী থাকেন, তাই আমাদের একটু মনোযোগ, একটু ভালোবাসা আমাদের পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে বাড়িয়ে তুলবে আরও বেশি মধুর সম্পর্ক। জীবন হবে শান্তিময়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে বয়স্কদের বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খেতে হয়। ওষুধ খাওয়ার সময় তোমারা যদি তাঁদের ওষুধের বক্সটা বা এক গ্লাস পানি এগিয়ে দাও, তাহলে তাঁরা ভীষণ খুশি হন। নাতি-নাতনির কাছে ভালোবাসা পেতে সবার ভালো লাগে।
তোমারা যখন বাসায় থাকো, সে সময়ে যদি দাদা বা দাদির সঙ্গে গল্প করো বা কিছু সময় তাঁদের সঙ্গে বসে লুডু বা ক্যারম খেলো, তাহলে তাঁদের সময়টা ভালোভাবে কাটবে। কিছুটা সময় ভীষণ উপভোগ করবেন।
বাসাতে যদি লিফট থাকে, তাহলে তাঁকে লিফটে করে অল্প সময়ের জন্য ছাদে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। তোমাদের এই ধরনের ছোট ছোট ভালো কাজ পরিবারের মধ্যে গড়ে তুলবে বড় ধরনের ভালোলাগা।
লেখক : চিকিৎসক।
এইচআর/পিআর