সবুজ জোন, লকডাউন, কোরবানির ঈদ এবং করণীয়
এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে চলেছে আমাদের প্রিয় পৃথিবী। কোনোদিকেই কোনো সুসংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। গত ২৪ ঘণ্টায় গোটা বিশ্বে নতুন করে সংক্রমিত হয়েছে আরও দুই লক্ষাধিক মানুষ। কার্যকরী তেমন সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা এখনো মেলেনি। বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার চেয়ে সামাজিক চিকিৎসাই বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু মানুষ তো জন্মগতভাবেই পরাধীনতা মানতে চায় না। কতদিন আর ঘরবন্দি হয়ে থাকবে? প্রয়োজনের কাছে মানুষ চিরকাল পরাজিত হয়েছে। নিম্নআয়ের মানুষের হাতে অর্থ আর কতদিন থাকে, কতদিন থাকে খাবার-শিশুর পথ্য? পেটের দায়ের কাছে তো মানুষ হার মানবেই।
রাষ্ট্রকে জীবন-জীবিকা দুটোই দেখতে হয়, সবদিক বিবেচনায় বাস্তব কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হয়। সামনে আসছে পবিত্র ঈদুল আজহা- মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। বাংলাদেশেও বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশ্বে ৭ জুলাই পর্যন্ত সংক্রমণের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ১৮ লাখ ৪২ হাজার আর মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ ৪৪ হাজার। একই সময়ে বাংলাদেশে সংক্রমণের সংখ্যা এক লাখ ৬৮ হাজার ৬৪৫ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা দুই হাজার ১৫২ জন।
করোনাযুদ্ধে নতুন নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, নতুন নতুন কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমান সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি এবং পবিত্র ঈদকে ঘিরে নতুন কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে।
বর্তমানে করণীয় লক্ষ্যগুলো-
১. পরিস্থিতি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
২. চিকিৎসাব্যবস্থা (কোভিড ও নন-কোভিড) দ্রুত সম্প্রসারণ করতে হবে।
৩. স্বাস্থ্যবিধি বলবৎ রেখে জীবিকার সর্বোচ্চ সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
৪. পবিত্র ঈদ ঘিরে কোনোক্রমেই স্বাস্থ্যবিধি শিথিল করা যাবে না।
৫. খামারি/কৃষকের কোরবানির পশু বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. আগ্রহী মুসলমানদের কোরবানির ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রস্তাবসমূহ-
১. সবুজ জোন বা করোনামুক্ত জোন :
বর্তমানে তিনটি জোনের প্রস্তাব রয়েছে- স্থানভেদে প্রতি লাখে (মহানগর/অন্যত্র) ক. রেড জোন- ৬০/১০ এর ওপরে খ. ইয়েলো জোন- ৩-৫৯/৩-৯ গ. গ্রিন জোন- ০/পুরাতন রোগী
বিশেষ লক্ষ্য : আমাদের করোনা প্রতিরোধের সব পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সুস্থ মানুষকে সুস্থ রাখা। আমার প্রস্তাব অনুযায়ী চারটি জোন : ক. সবুজ জোন অথবা করোনামুক্ত জোন খ. ইয়েলো জোন- ১-১০/১-৫ গ. ব্লু জোন- ১০-৫৯/৬-৯ ঘ. রেড জোন- ৬০/১০-এর ওপরে।
হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭০/৮০ ভাগ এলাকা এখনো করোনামুক্ত। আমাদের এসব এলাকাকে করোনামুক্ত রাখতে হবে। ৪৬০টি উপজেলাকে কম পরিশ্রমে, কম কর্মীবাহিনী দিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহযোগিতায় দ্রুত করোনামুক্ত করা সম্ভব। পাশাপাশি জেলা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করতে হবে। প্রয়োজনে স্কুল-কলেজ, উন্মুক্ত স্থান ব্যবহার করতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে নতুন রোগী শনাক্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যেতে হবে।
জনপ্রতিনিধি, স্বাস্থ্যকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সমন্বয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। জনগণকে অবশ্যই উদ্বুদ্ধ ও সম্পৃক্ত করতে হবে। তরুণ স্বেচ্ছাসেবকরা ভালো ভূমিকা রাখে- রাখছে। গোটা দেশে তৃণমূল পর্যন্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থার রয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এছাড়া প্রয়োজনীয় এলাকাগুলো যেমন কলকারখানা বা অফিস-আদালত সবসময় করোনামুক্ত রাখতে হবে। নতুন শনাক্ত রোগী দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। করোনামুক্ত এলাকায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক জীবনযাপন ও কর্মকাণ্ড চলবে।
২. লকডাউন হচ্ছে করোনা প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা। যেসব দেশ এ কর্মসূচি সঠিকভাবেই কার্যকর করেছে তারাই করোনা প্রতিরোধে সফল হয়েছে। বাংলাদেশে মিরপুরের টোলারবাগ একটি অনুকরণীয় উদাহরণ। সেখানে সফলতার প্রধান কারণ ছিল স্থানীয় অধিবাসীদের আন্তরিক সক্রিয় অংশগ্রহণ। লকডাউনের কার্যক্রম সব জায়গায় একযোগে কার্যকর করতে হবে, পাশাপাশি করোনামুক্ত সবুজ জোন সম্প্রসারিত করার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে।
৩. কোরবানির ঈদ : আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহার ঈদ সচেতন সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে। গত ঈদের অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো নয়। বর্তমান সময়ের করোনা সংক্রমণের অনেকটাই গত ঈদে ঘরমুখো মানুষের স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে যাওয়া-আসা। এ পর্যায়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতির মর্যাদা দিতে হবে যেমন, অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু রোধ করতে হবে।
সৌদি আরবে পবিত্র হজের সময় কোরবানির জন্য ব্যাংকে টাকা জমা দিতে হয়- বাকি দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। সব বিবেচনায় কোরবানির সময়ে প্রস্তাবসমূহ:
১. কোরবানির সব কার্যক্রম ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নেতৃত্বে হতে হবে। তাদের রয়েছে দেশব্যাপী শক্তিশালী নেটওয়ার্ক।
২. সব আর্থিক লেনদেন বাংক/মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হতে হবে। যেসব ব্যক্তি কোরবানি দিতে আগ্রহী তারা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নির্ধারিত অ্যাকাউন্টে নির্ধারিত টাকা জমা দেবেন।
৩. মহানগর/জেলা/উপজেলা/ইউনিয়ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসনের সহযোগিতায় ছোট ছোট কমিটি করতে হবে, যার নেতৃত্বে থাকবে মসজিদের স্থানীয় ফাউন্ডেশনের নিযুক্ত ইমাম। অন্য আলেম-উলামাদের কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।
৪. কমিটি পশু ক্রয়, কোরবানি করা, মাংস বিতরণ, চামড়া সংরক্ষণ এবং বিক্রি করা সব ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে। ক্রয়-বিক্রয়ের পুরো প্রক্রিয়াটা হতে হবে অনলাইনে। যতটা জেনেছি, খামারিরা অনলাইনে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে।
৫. বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামে এখনো সমাজে পশু কোরবানি-বিতরণ অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে হয়। প্রতিটি গ্রামে তাদের ৫-৭ জনকে যুক্ত করতে হবে, যাদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি পৌঁছানোসহ কোরবানির সব কার্যক্রম অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব। তারা গ্রামের মানুষদের, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের তালিকা সংরক্ষণ করা। সঙ্গে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন তো থাকবে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস গ্রামের সমাজ নেতাদের দায়িত্ব দিলে তারা উৎসাহভরে আন্তরিকতার সঙ্গে সফল করে দেবে। কোথাও লোক সমাগম বা ভিড় করতে দেয়া যাবে না।
৬. প্রধান শর্ত হচ্ছে- প্রতি ধাপে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। যারা কোরবানির জন্য টাকা জমা দেবে তারা যেন নিশ্চিত হয় যে, টাকাটা যথাযথ ব্যবহার হয়েছে।
৭. প্রস্তাবিত কর্মপদ্ধতিটি বাস্তবায়ন সম্ভব। প্রয়োজন হবে ব্যাপক প্রচার ও যোগাযোগ যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ চাইলে রাতদিন পরিশ্রম করে সাত দিনে প্রস্তুত করতে পারবে। সে সক্ষমতা তাদের রয়েছে। বিশ্বের/দেশের এক দুর্যোগময় মুহূর্তে দেশকে রক্ষা করার জন্য, দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য আমাদের সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে যার যেখানে দায়িত্ব রয়েছে।
৮. যে কৃষকটি সারাবছর ২-১টি পশুপালন করেছে তার বছরের জীবিকা নির্বাহ করার জন্য তারা যেন বিক্রির সুযোগ পায়- তাদের নেটওয়ার্কের আওতায় আনার বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এতে তারা ন্যায্যমূল্য পাবে।
অনেকের ধারণা, এবার পশুর হাটে বেচাকেনা খুব সুবিধার হবে না। মাঝখান থেকে করোনা সংক্রমণের বড় সুযোগ সৃষ্টি হবে।
পবিত্র ঈদকে ঘিরে কোনোক্রমেই স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করার সুযোগ দেয়া যাবে না। বাংলাদেশের করোনা যে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার রয়েছে তাতে আমরা সবাই মিলে সমন্বিতভাবে, সুপরিকল্পিতভাবে, আন্তরিকভাবে কাজ করতে পারলে এ পরিস্থিতি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অযোগ্য, অসহযোগী, অসৎলোক দিয়ে কোনো সংকটই মোকাবিলা করা যায় না, সফল হওয়া যায় না। প্রয়োজনে তাদের সরিয়ে দিতে হবে।
আমার প্রস্তাবগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন- এটি আমার প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে অনেক গৌরবের ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এখানেও আরেকটি ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে, যেখানে নেতৃত্বে রয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা, যিনি বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছেন বিশ্বের দরবারে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/বিএ/জেআইএম