সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘অসামাজিক’ মন্তব্য

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৪২ এএম, ০৬ জুলাই ২০২০

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন

বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি অবদানের ভালো-মন্দ দুইটি দিকই রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের দেশে গত এক দশক ধরে যোগাযোগের ধারণাই পাল্টে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, এটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগ। বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যাকাণ্ড, সিলেটের শিশু রাজন হত্যাকাণ্ড, ঢাকার আলোচিত যুবক জোনায়েদের বন্ধুকে মারধরসহ অনেক অপরাধকাণ্ডের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

তবে এর বিপরীতে অন্ধকারও রয়েছে। কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ মন্দির ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া হিন্দু মন্দিরে হামলা করা হয় ফেসবুকের কথিত ধর্ম অবমাননার গুজবকে কেন্দ্র করে।

বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফেসবুক ও ইউটিউব। সাম্প্রতিককালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে করে আপত্তিকর মন্তব্য ও ‘সাইবার বুলিং’য়ের শিকার হচ্ছেন অনেকে। আলোচিত ব্যক্তিত্বের পাবলিক পোস্ট, গণমাধ্যমের পাবলিক পেজের পোস্টে এক ধরনের ফেসবুক ব্যবহারকারী ‘যাচ্ছে তাই’ মন্তব্য জুড়ে দিচ্ছেন। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের স্ত্রীকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের পর সাইবার বুলিং ব্যাপকভাবে আমাদের নজরে আসে।

সমসাময়িক আরেক ক্রিকেটার তাসকিন আহমেদের বিয়ের ছবি ও ব্যক্তিগত ছবিতেও আপত্তিকর মন্তব্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এই কথিত মন্তব্যকারী ফেসবুকাররা। পরিস্থিতি বর্তমানে এমন কেউ নিজের বোনের সাথে ছবি শেয়ার করতেও সাইবার বুলিংয়ের ভয় করেন।

সম্প্রতি বিশ্ববরেণ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার করোনা আক্রান্তের খবরে ফেসবুকে আবার সে আপত্তিকর মন্তব্য নিয়ে হাজির হয়েছে এই কথিত মন্তব্যকারী ফেসবুকাররা। একজন বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী করোনা আক্রান্ত ঘটনায় তার ব্যক্তিগত সাজসজ্জা নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করছে তারা।

এছাড়া দেশের একটি প্রিন্ট পত্রিকায় ‘পড়াশোনা না ছাড়ায় ঢাবি ছাত্রীকে হত্যার অভিযোগ’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি নিউজ পত্রিকার ফেসবুক পেজে শেয়ার হলে আপত্তিকর এমন মন্তব্য করেছেন অনেকে। ‘স্বামীর পায়ের নিচে সন্তানের স্ত্রীর বেহেশত, মেয়েদের অতিরিক্ত লেখাপড়া দরকার নেই’ সম্মিলিত মন্তব্য করে মূলত হত্যাকে সমর্থন করছে তারা।

এছাড়া অপছন্দের ব্যক্তির মৃত্যু, ক্রসফায়ারে মৃত্যু নিয়ে উল্লাস করতে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সম্প্রতি বুয়েটের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক সত্যপ্রসাদ মজুমদার। সে খবরের মন্তব্যেও তার ধর্মপরিচয় নিয়ে আক্রমণ করেছে কথিত কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী। এ যেন একটি অসহিঞ্চ ও অসুস্থ সমাজের চিত্র।

এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ধরনের আপত্তিকর মন্তব্যের স্বীকার হন নারীরা। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব মন্তব্যকারী হন পুরুষ। এটা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিত্রায়ণ। পুরুষ ঠিক তার চিন্তাটা নারীর ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন। পুরুষ ঘরে যেভাবে সে তার স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করতে আগ্রহী ঠিক বাইরের মেয়ে জগৎকেও সে উড়তে দিতে চায় না। আর একজন নারীর টিপপরা নিয়ে যাদের আপত্তি তাদের পুরুষের হাফপ্যান্ট পরা নিয়ে আপত্তি থাকে না।

আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় এসব মন্তব্যকারী আইডি সাধারণত ফেক হয় অথবা সঠিক হলেও তারা হয় খুব সাধারণ জ্ঞানের অধিকারী। যারা ফেসবুকের গুজব আমলে নিয়ে বাঁশগাছের পানিকে সর্বরোগের ওষুধ মনে করে আর ধর্ম অবমাননার গুজব শুনে অন্যের উপসানালয় ভাঙতে যায়। এদের বেশির ভাগই কট্টরপন্থী এবং সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান তাদের কাছে নেই।

‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত’ এই ধরনের কোনো আদেশ ইসলাম ধর্মে নেই। কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে তৈরি এই আলাপ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ধর্মের আদেশ বলে চাপিয়ে দিয়েছে। আর সে আলাপকে গ্রহণ করেছে এই কথিত ফেসবুকাররা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই শ্রেণির লোক নানা গুজবকে যাচাই না করে শেয়ার করে। আর এই শ্রেণির লোকের জন্য ইউটিউবে নানা ‘উত্তেজনাকর’ ক্যাপশন দিয়ে ভিডিও তৈরি করে এক ধরনের ইউটিউবাররা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার আগে আমরা সীমিত একটি জগতের সাথে মিশতাম। মানুষের অন্দরমহলের চিন্তা সম্পর্কে আমরা অবগত ছিলাম না। মানুষের সচেতন ও অসচেতন মস্তিষ্কের চিন্তা সম্পর্কে জানা ছিল না এতদিন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের সমাজের চিত্র উন্মোচন করেছে। সমাজের গোঁড়ামি ও অসুস্থতা চিন্তাকে প্রকাশ করেছে। যারা মন্তব্য করছে তারা অন্যগ্রহের কেউ না। তারা আমাদের দেশের আমাদের সাথে বসবাস করা মানুষ। এছাড়া সংখ্যায় একদম নগণ্য তাও না। তবে কি সমাজে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা, চিন্তা ও শিক্ষাকে আমরা প্রসারিত করতে পারিনি! সমাজের মানসিক অসুস্থতার রোগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা!

আইন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হয় না। শক্ত আইন সত্ত্বেও ইভটিজিং, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুকপ্রথা, বাল্যবিবাহ নির্মূল করা যায়নি। তবে যখনই সামাজিক সচেতনতা ও শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তখনই সাফল্য এসেছে। সামাজিক সমস্যা সমাধানে সামাজিক উদ্যোগ দরকার। এই অসুস্থ সমাজের চিকিৎসা দরকার। জ্ঞানের বিস্তার দরকার। সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার দরকার। মননশীলতার বিকাশ দরকার। কিন্তু কে নেবে এই দায়িত্ব! আমরা তো একে অপরকে ‘ভুল/অন্যায়’ বলে দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ভুলকে শুধরানোর দায়িত্ব তো নিতে হবে। যখন সমাজের পচন সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে তখন আমরা কেউ নিরাপদ থাকব না।

লেখক : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক।

এইচআর/বিএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।