বাংলাদেশে করোনা টেস্টের চালচিত্র

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:২৩ পিএম, ০৪ জুলাই ২০২০

ডা. শামীম তালুকদার

বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর ছয়টি মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এই কয়েক মাসের মধ্যে ভাইরাসটি সারাবিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ভাইরাসটি কেড়ে নিয়েছে প্রায় পাঁচ লাখের অধিক মানুষের জীবন। সারাবিশ্বে ভাইরাসটি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এক কোটিরও অধিক মানুষ। বর্তমানে বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চলে করোনা ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশেও এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে।

গত ৮ মার্চ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা এক লাখ ৪৫ হাজার ৪৮৩। জুন মাসে বাংলাদেশে করোনা রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বলে জানা যায় গণমাধ্যমের তথ্য থেকে। সরকারের রোগতত্ত্ব , রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলাসহ দেশের ৩১টি জেলায় গত ৩১ মে পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০০-এর নিচে ছিল। ৩০ জুন পর্যন্ত শুধু লালমনিরহাট, মাগুরা, মেহেরপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ— এই চার জেলায় করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০০-এর নিচে ছিল। বাকি ২৭ জেলায় ব্যাপকসংখ্যক রোগী বেড়েছে। (১)

আমরা যদি বাংলাদেশে করোনা টেস্টের সংখ্যার দিকে তাকাই তাহলে দেখা যায়, গত ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে মোট করোনা টেস্টের সংখ্যা সাত লাখ ৬৬ হাজার ৪০৭টি এবং দেশে মোট ল্যাব বা পরীক্ষাগার চালু আছে ৬৮টি। আমরা যদি দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ধরে নেই তাহলে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪.৪ শতাংশের কিছু বেশি টেস্ট করা সম্ভব হয়েছে বিগত চার মাসে। যার অর্থ দাঁড়ায়, প্রতি মাসে দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.১ শতাংশকে টেস্ট করা সম্ভব হয়েছে। যেটি করোনা মহামারির মতো বড় একটি দুর্যোগ মোকাবিলায় অত্যন্ত নগণ্য।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ৩১ মে পর্যন্ত বাংলাদেশের ৫২টি ল্যাবে পরীক্ষা করা মোট নমুনার সংখ্যা ছিল তিন লাখ আট হাজার ৯৩০টি। করোনা আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজার ১৫৩। ৩০ জুন এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ। অর্থাৎ মাত্র এক মাসের ব্যবধানে টেস্টের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে।

jagonews24

দেশে র‌্যাপিড টেস্ট কিট নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যেই গত ২৪ জুন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কোভিড-১৯ এর অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট বা র‌্যাপিড ও ল্যাবরেটরি এলিজা মেথডের এনওসি ইমার্জেন্সি ইউজ অথরাইজেশন রেজিস্ট্রেশন প্রদানের নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। ওই নীতিমালা মোতাবেক, সার্স কভ-২ অ্যান্টিবডি আইজিজি আইজিএম, আইজিজ র‌্যাপিড এবং এলিজা ল্যাব বেইজড টেস্ট কিটসমূহ কোভিড-১৯ এর ডায়াগনসিসের কাজে ব্যবহার করা যাবে না।

দেশে সরকারি পর্যায়ে প্রথম থেকেই করোনা নির্ণয় পরীক্ষা বিনামূল্যে করা হলেও সম্প্রতি সরকারিভাবে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য ফি আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করাতে সরকারিভাবে ২০০ টাকা ফি দিতে হবে। বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করলে দিতে হবে ৫০০ টাকা। সরকারি পর্যায়ে এতদিন বিনামূল্যে টেস্ট করা হলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষার জন্য ৩ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হতো। বেসরকারিভাবে বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য লাগত ৪ হাজার ৫০০ টাকা। (২)

[১. সামছুর রহমান, ‘জুনে রোগী ব্যাপক বেড়েছে, সংক্রমণ কম ২৭ জেলায়’, ২৯ জুন ২০২০, প্রথম আলো
২. ‘করোনায় হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষার জন্য ২০০ টাকা, বাড়িতে থেকে করলে ৫০০’, ২৮ জুন ২০২০, প্রথম আলো]

বাংলাদেশের সাধারণ আয়ের মানুষ এমনিতেই করোনার আক্রমণে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গত ২৮ জুন প্রকাশিত গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, দেশে নতুন করে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন। শহুরে শ্রমিকদের আয় কমেছে ৮০ ভাগ আর গ্রামের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১০ ভাগ। (৩) করোনাকালীন মানুষের আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় টেস্টের জন্য ফি নির্ধারণ করা কতটা যুক্তিসঙ্গত হয়েছে, এই ব্যাপারে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মত রয়েছে। অনেকে বলছেন, ফি নির্ধারিত হওয়ায় অনেক অযাচিত করোনা পরীক্ষা কমে যাবে। সাধারণ ঠান্ডার উপসর্গ নিয়েও যারা করোনা ভেবে টেস্ট করান, সেসব অযাচিত টেস্টের সংখ্যা কমবে। আবার অনেকে বলছেন, বিনামূল্যে টেস্ট করার সুবিধা থাকায় গরিবরা আগে টেস্টের আওতায় আসতে পারতেন। এখন ফি নির্ধারিত হওয়ায় উপসর্গ থাকলেও অনেকে টেস্ট করতে পারবেন না।

[৩. আলতাফ পারভেজ, ‘গবেষকদের কথা শুনতে পাচ্ছি কি আমরা’, ২৮ জুন ২০২০, প্রথম আলো]

সম্প্রতি চট্টগ্রামের সরকারি ল্যাবগুলোতে কোভিড-১৯ রোগ শনাক্তের জন্য একটি কিট দিয়ে দুটি নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। ২৩ জুন মঙ্গলবার থেকে এ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। একই পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে কক্সবাজার ল্যাবেও। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা পাওয়ার পর ল্যাবগুলো এ ব্যবস্থা চালু করেছে। তবে এতে পরীক্ষার ফলাফলে কোনো হেরফের হচ্ছে না। এই প্রক্রিয়ায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ নমুনা পরীক্ষা বেড়ে গেছে। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে আগে গড়ে ৬০০ থেকে ৭৫০টি নমুনা পরীক্ষা হতো। কিন্তু এক কিটে দুটি নমুনা পরীক্ষা করায় গত ২৪ জুন ৯৭১টি নমুনা পরীক্ষা হয়। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ধীরে ধীরে নমুনাজটও কমে আসবে।

আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র চার হাজার ৫৬১ জনের টেস্ট করা হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে এ সংখ্যা অনেক বেশি। ফ্রান্সে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে ২১ হাজার ২১৩ জনকে টেস্ট করা হচ্ছে। ইতালিতে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে ৮৮ হাজার ৩৫১ জনকে টেস্ট করা হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে ২৪ হাজার ৮৪৫ জনকে টেস্ট করা হচ্ছে।

jagonews24

বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে যেখানে সর্বাধিক নজর দেয়া হচ্ছে সেখানে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে উচিত সহজলভ্য যে কয়েকটি মাধ্যম আছে করোনা টেস্ট করার জন্য, তার সবগুলোর প্রয়োগ করা। কারণ বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে এখনও করোনা সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ব্রিটেনে করোনাভাইরাস ছড়ানোর পিক টাইম প্রায় ৪২ দিন স্থায়ী ছিল। বাংলাদেশে এর চাইতেও বেশি সময় ধরে এই পিক টাইম স্থায়ী হতে পারে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশে সংক্রমণ বা আক্রান্তের হার কবে নাগাদ সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাবে সেটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। দেশে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে টেস্টের কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং বাংলাদেশে করোনা টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে র‌্যাপিড টেস্ট সিস্টেমকে ফেলে না রেখে যেভাবেই হোক এটিকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্তের পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত।

গণস্বাস্থ্যের র‌্যাপিড টেস্ট কিট কোভিড-১৯ রোগের ব্যাপ্তি বা সেরোপ্রিভিলেন্স দেখার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই কিটের মাধ্যমে ৭০ শতাংশ রোগী যাদের আগে কোভিড রোগ হয়েছিল তাদের শনাক্তকরণ সম্ভব। এছাড়া কোভিড প্লাজমা বিতরণ, কোয়ারেন্টাইন সমাপ্তির সময় নির্ধারণ এবং লকডাউন উত্তোলনের রূপরেখা তৈরির ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহৃত হতে পারে। দেশে আরটিপিসিআর আর র‌্যাপিড টেস্ট— এই দুটি পদ্ধতিকেই যদি তাদের সক্ষমতা ও কার্যকারিতা অনুযায়ী আনুপাতিক হারে ব্যবহার করা যায় তাহলে অল্প সময়ের মধ্যে অধিকসংখ্যক করোনা টেস্ট করা সম্ভব।

লেখক : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স, বাংলাদেশ; গবেষণা সহকারী আজিজুল হক

আরও পড়ুন…
>> আইসিইউতে বাজেট, জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন
>> কোভিড-১৯ দুর্যোগকালীন বাংলাদেশে খাদ্য ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা

এমএআর/এমএস

আমরা যদি দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ধরে নেই তাহলে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪.৪ শতাংশের কিছু বেশি টেস্ট করা সম্ভব হয়েছে বিগত চার মাসে। যার অর্থ দাঁড়ায়, প্রতি মাসে দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.১ শতাংশকে টেস্ট করা সম্ভব হয়েছে। যেটি করোনা মহামারির ন্যায় বড় একটি দুর্যোগ মোকাবিলায় অত্যন্ত নগণ্য

বাংলাদেশে সংক্রমণ বা আক্রান্তের হার কবে নাগাদ সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাবে সেটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। তাই দেশে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে টেস্টের কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং বাংলাদেশে করোনা টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে র‌্যাপিড টেস্ট সিস্টেমকে ফেলে না রেখে যেভাবেই হোক এটিকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্তের পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।