এত শোক আর সহ্য হয় না

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ০৮:৫৪ এএম, ০১ জুলাই ২০২০

লিখতে বসে হাত অসাড় হয়ে আসে। কিছুই লিখতে ইচ্ছে করে না। মাথা কাজ করে না। হতাশার কথা লিখতে চাই না। আশার কথা ছড়াতে চাই। চারদিকে, বিশ্বজুড়ে ইতিবাচক কী কী ঘটছে তার খোঁজ নিয়ে তা মানুষকে জানাতে চাই। সবাইকে হতাশা ঝেড়ে ফেলে আশাবাদী হয়ে ওঠার তাগিদ দিতে চাই। কিন্তু না, কান খুললে যা শুনি, চোখ মেললে যা দেখি তাতে নিজেই মুষড়ে পড়ি, নিরুৎসাহ বোধ করি। মনে হয়, এ শোকের শেষ নেই। এত কষ্ট, এত দুঃখ এক জীবনে সইবার মতো নয়।

২৯ জুন সকালেই বুড়িগঙ্গায় ভয়াবহ লঞ্চ দুর্ঘটনার খবরে কেমন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি। একটি লঞ্চ আরেকটি লঞ্চকে ধাক্কা দিলে ধাক্কা খাওয়া লঞ্চটি ডুবে যায়। লঞ্চটিতে ৫০ থেকে ৬০ জন যাত্রী ছিল বলা হলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, প্রকৃত যাত্রী সংখ্যা ছিল দ্বিগুণ বা তারও বেশি। এই করোনার সময় সব যানবাহনকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সে হিসাবে, লঞ্চে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী থাকার কথা। কিন্তু ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটিতে উঠলো কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আর কোনোদিন পাওয়া যাবে না।

বিজ্ঞাপন

একটি লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে। অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটে, দুর্ঘটনাস্থলের আকাশ-বাতাস ভারি হয় স্বজন হারানো মানুষের গগনবিদারী কান্নায়। দুর্ঘটনা তদন্তে এক বা একাধিক কমিটি গঠিত হয়, নিহত-আহতদের কিছু ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। তারপর দীর্ঘ শীতঘুম। আর একটি দুর্ঘটনার অপেক্ষা। দুর্ঘটনা ঘটে, কারণ উদ্ঘাটিত হয়, কি হয় না। তবে দোষীর যে শাস্তি হয় না, সেটা নিশ্চিত।

২৯ জুন দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটি কি চলাচল উপযোগী ছিল? ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল? হয়তো ছিল। না হলে চলার কথা নয়। তবে শোনা যাচ্ছে, লঞ্চের অবস্থা ভালো ছিল না। অতিরিক্ত যাত্রীবহনের অবস্থায় তো ছিলই না। তাহলে এই লঞ্চটিকে ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়েছেন কে বা কারা? কীসের বিনিময়ে? এখন এটা খুঁজে বের করা হবে কি? নাকি বিনিময় বাণিজ্যের জোরে কয়দিন পর সব ‘ঠিক' হয়ে যাবে?

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

যারা অনিয়ম করে, যাদের অবহেলা, খামখেয়ালির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে তাদের ভেতর কোনো অপরাধবোধ কাজ করে না। তারা পার পাওয়ার উপায়ও জানে। পার পেয়েও যায়। কিন্তু আহত-নিহতের পরিবারগুলোর দুঃখ-কষ্টের সীমা-পরিসীমা থাকে না।

এখন করোনা নিয়ে আমাদের দেশের সরকারই শুধু নয়, বিশ্ব নেতৃত্বই মহাসংকটে আছেন। অর্থ ও সমরশক্তির জোরে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। করোনা পৃথিবীব্যাপী রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রচলিত জীবনধারা- সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। কোনো কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে না। করোনা যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে মানবসমাজ-সভ্যতার পরিণতি কী হবে, তা কেউ বলতে পারছে না।

মানুষের এযাবৎকালের অধীত জ্ঞান, বিজ্ঞান করোনাজয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি। ভ্যাকসিন অথবা টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। এখন পর্যন্ত এসবের কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে অতীতে অতিমারি নিবারণে মানুষ সফল হয়েছে। এবারও নিশ্চয়ই হবে। হার না মানার এক অদম্য ক্ষমতা মানুষের আছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আমাদের দেশে করোনায়ও মানুষ মরছে। মরছে অন্য রোগ-ব্যাধিতে। আবার সড়ক দুর্ঘটনায়ও প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সড়কে যান চলাচল করলে কি দুর্ঘটনা ঘটতেই হবে? এখন সড়কে যানবাহন তো চলছে সীমিত সংখ্যায়। এখন ওভারটেক করার যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাহলে দুর্ঘটনা ঘটছে কেন? এটা কি চালকের অদক্ষতা, নাকি যানবাহনের ত্রুটির কারণে? দক্ষচালক, ত্রুটিমুক্ত যান কি আমরা কোনোদিন পাব না? ‘নিরাপদ সড়ক' শব্ধযুগল কি আমরা কেবল শুনেই যাব? আমাদের জন্য সড়ক কোনোদিন নিরাপদ হবে না?

করোনা মোকাবিলায়ই বা আমরা কবে সফল হব? করোনা মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত- এই আওয়াজ আমরা শুনেছিলাম মার্চ মাসেই কর্তাব্যক্তিদের মুখে। কিন্তু সেটা ছিল ভূতের ভয় তাড়ানোর আত্মচিৎকার। আসলে আমরা এখনও প্রস্তুতির মধ্যেই আছি। কীভাবে সুফল পাওয়া যাবে তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছেই। মৃত্যুর মিছিলও অব্যাহত। এতদিন বিনাচিকিৎসায় মৃত্যুর কথা শোনা গেলেও এখন চিকিৎসা নিয়েও মারা যাওয়ার কথা জানা যাচ্ছে।

২৯ জুন করোনা কেড়ে নিয়েছে এমন তিনজনকে, যারা চিকিৎসা পেয়েও করোনার ছোবল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেননি। এদের একজন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা, প্রতিরক্ষা সচিব মহসিন চৌধুরী। সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। আরেকজন প্রবীণ সাংবাদিক, সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়ের সম্পাদক খোন্দকার মোজাম্মেল হক। তিনিও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। অন্যজন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের স্ত্রী। তিনিও সিএমএইচে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ পেলেই বেঁচে থাকার গ্যারান্টি নেই। আবার ঘরে চিকিৎসা নিয়েও অনেকে সুস্থ হয়ে উঠছেন। করোনার আচরণ বিচিত্র। তবে এই বিচিত্র আচরণ দীর্ঘস্থায়ী হলে আমরা কি মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হব? এর মধ্যেই কিন্তু আমরা এমন কয়েকজন কৃতি মানুষকে হারিয়েছি, যাদের প্রজ্ঞা জাতি হিসেবে আমাদের ঋদ্ধ করেছে। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধিতে এমনিতেই ঘাটতি আছে। করোনা কি আমাদের আরও নিঃস্ব করার মিশন নিয়ে এসেছে?

না, কিছুই আর লিখতে ইচ্ছে করে না। এমন দহনকাল দূর হোক।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
bibhu54@yahoo.com

বিজ্ঞাপন

এইচআর/বিএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।