ধূসর সময়ে পাটকলে সোনালী ছাঁটাই
বাস্তবতার অনিবার্যতায় গোল্ডেন হ্যান্ডশেক বা সোনালী করমর্দনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর ২৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীকে বিদায়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া কী বিকল্প ছিল সরকারের? তালগোল এভাবে পাকলো কেন? যৌক্তিক এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। সময়টাও খারাপ। জীবনের বিবর্ণ সময়ে এলো জীবিকাবিষয়ক সিদ্ধান্তটি।
করোনাদুর্যোগের কঠিন সময়ে সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাস্তা গরম করছেন পাটশ্রমিকরা। রাস্তায় নামা তাদের নিয়তির মতো। শীত-বসন্ত, ঠাণ্ডা-গরমে মাঝেমধ্যেই বকেয়া বেতন-ভাতাসহ নানান দাবিতে রাজপথে নেমে অভ্যস্ত তারা। এবার নামতে হলো মহামারির কঠিন সময়ে। তফাৎ এদ্দূরই। গেলবারের জাতীয় পাট দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পাট এমন একটি পণ্য, যার কিছুই ফেলনা নয়। অতএব কেন এতে লোকসান হবে? আমি কোনো লোকসানের কথা শুনতে চাই না, বরং পাটশিল্প কীভাবে লাভজনক হবে, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।’
পাটখাতে সরকারের সাম্প্রতিক এ মনোযোগ মানে বন্ধ নয়, কারখানাগুলো চলবে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে। এটা বন্ধের বিকল্প। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো কবে লাভজনক ছিল? কখন থেকে লোকসান টানা শুরু? ক’জন জানেন? ক্রমাগত লোকসানের কথা সবার জানা। কেন এ লোকসান? আমাদের সরকারি খাতের ব্যবস্থাপনার ইতিহাস বড় তিক্ত। দক্ষতা-যোগ্যতার ঘাটতির সঙ্গে চুরি, অপচয়, দুর্নীতির ক্যামেস্ট্রিতে পাটকলগুলো ঝাঁঝরা হয়ে গেছে বহু আগেই।
এগুলো জাতীয়করণের ইতিহাসও ত্রুটিপূর্ণ। দেশ স্বাধীনের পর তড়িঘড়ি করে কল কারখানাগুলো জাতীয়করণ করা হয়। ওই সময় কারখানাগুলো পরিচালনার জন্য সরকারি পর্যায়ে দক্ষ জনবল ছিল না। এগুলোর প্রশাসনিক দেখভালের দায়িত্বে বসানো হয় দলীয় লোকদের। করপোরেশন তৈরি করে সেখানকার কিছু দলবাজ কর্মকর্তাকে ব্যবস্থাপনার গুরুদায়িত্ব দেয়া হয়। তাদের কেউ কেউ দক্ষতা কাজে লাগান মিলগুলোকে লোকসানি অবস্থা স্থায়ীরূপ দিতে।
পরে বিশেষ কেরামতিতে তাদের কেউ কেউ কারখানার মালিকও বনে যান। এসবের জেরে মিলগুলো মুখ থুবড়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। কাঁচাপাট সংগ্রহ থেকে পাটজাত পণ্য বিপণন পর্যন্ত পরতে পরতে চুরি-দুর্নীতি, লুটপাট পাটকলগুলোর ঐতিহ্য। সেইসঙ্গে দলাদলি, স্বজনপ্রীতি, কায়েমি স্বার্থ তো ছিলই। লোকসান মিনিমাইজ করতে প্রতিবছর ভর্তুকি লুটোপুটিও কম ছিল না।
এক হিসাবে জানা গেছে, গত এক দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো সচল রাখতে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ৩৯৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। লোকসানের চক্কর থেকে বের হতে না পারায় পাটকলের শ্রমিকদের আট থেকে ১০ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া পড়েছে। এসবের নেপথ্য ঘটনা কোনো সরকারেরই অজানা নয়। তারা মুখে অনেক কথা বলেন। বিরোধীদলে থাকলে হককথার ঝড় বেশি বেগবান। ক্ষমতায় গেলে একই চেহারা। এই কারখানাগুলোকে বিএমআরই করার প্রস্তাব গ্রহণ করেনি কোনো সরকারই। একদিকে টানা লোকসান, আরেকদিকে চাকরি খেয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার মধ্যে নানা কৌশলে স্থায়ী-অস্থায়ী চাকরি দেয়া থামেনি।
অপ্রয়োজনেও বদলি শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করে শ্রমিক সংখ্যা বারবার বাড়ানো হয়েছে। তাদের বেতনভাতা হয় সরকারি স্কেলে। পাট কেনা থেকে শুরু করে, স্টোর, ক্যারিং, উৎপাদিত পণ্য বিক্রি- সবখানেই নয়ছয় নিয়মে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো সব সরকারের আমলেই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আবদার রক্ষা করে চলতে হয়েছে কারখানাগুলোকে। এ সংস্কৃতির মধ্যে এরশাদ আমল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত অনেক কলকারখানা বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। পানির দামে মুখচেনা মানুষের কাছে বেচে দেয়া হয় কারখানাগুলো। যুক্তি একটাই- সরকারের পক্ষে পুঞ্জিভূত লোকসানের বোঝা বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। অতএব খাস পছন্দের লোকদের কাছে সরকারি কারখানা সস্তা দরে বেচে দেয়াই ফয়সালা।
অনেক ক্ষেত্রে কারখানার দখল নেয়ার পর অল্প ক’দিনের মধ্যেই মেশিনপত্র, দেয়ালের ইট, টিনের চাল আর সবশেষে কারখানার জমিটাও বেচে দেয়া হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিক কর্মচারীদের চাকরি থেকে বিদায় নিতে হয়। এর ব্যতিক্রমও ঘটেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার পর উৎপাদন ও মান বৃদ্ধির ঘটনা রয়েছে।
লোকসানের বদলে লাভের মুখ দেখার রেকর্ডও আছে। দেশের বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল এলাকায় যেসব শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে, সেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে আগের চেয়ে বেশি। এবার বেচাবিক্রিতে কিঞ্চিত রকমফের এসেছে। সরাসরি বিক্রি না করে পাটকলগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রুগ্ন বা লোকসানি খাত ভর্তুকি দিয়ে জ্যান্ত রাখা নিরর্থক। নতুনত্বের পাশাপাশি অনেকের কাছে এটা মন্দের ভালো।
তবে প্রশ্ন থাকছে মহামারির সময়ে কেন জরুরি হলো সিদ্ধান্তটি নেয়ার? এমন একটা সময় সিদ্ধান্তটি জানানো হলো যখন পাটখাতে কিছুটা আশা উঁকি দিচ্ছিল। এর পেছনে বর্তমান সরকারের চেষ্টা ছিল ব্যাপক। এ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাতেই তোষা ও দেশি পাটের জিনোম সিকোয়েন্স বা জীবন-সূত্র উন্মোচন হয়েছে। এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
এইচআর/বিএ/জেআইএম