বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ

ড. মিল্টন বিশ্বাস
ড. মিল্টন বিশ্বাস ড. মিল্টন বিশ্বাস , অধ্যাপক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:৩৬ এএম, ২৩ জুন ২০২০

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এই রাজনৈতিক দলকে তিনি বারবার ‘প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গণতন্ত্র চর্চার কেন্দ্র, স্বাধিকার আদায়ের অন্যতম প্ল্যাটফর্ম, পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার বিরোধী শক্তি, সর্বোপরি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার আস্থাশীল নেতৃত্বের জয়গৌরব প্রতিষ্ঠার জায়গা হিসেবে আওয়ামী লীগ বাঙালি মাত্রেরই প্রিয় হয়ে উঠেছিল। জন্মলগ্ন থেকে তার বিকশিত রূপটির চেহারা বঙ্গবন্ধুর নিজের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে স্মৃতিকথায়।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন যখন দলটি প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এর নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এবং জেলে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান এ দলের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। জুলাই মাসের শেষের দিকে তিনি মুক্তিলাভ করেন। উল্লেখ্য, তিনি রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাতদিন কারাভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা করেছিলেন। অপরদিকে আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা জেলে থাকলে বঙ্গবন্ধুকেই দলের সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে নিতে হয়েছে।

তিনি লিখেছেন- ‘শামসুল হক সাহেব আওয়ামী লীগের অফিস নবাবপুর নিয়ে এসেছেন। এই বাড়ির দুইটা কামরায় মানিক ভাই তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কিছুদিন ছিলেন। মানিক ভাই, আতাউর রহমান সাহেব ও আরও অনেকের সাথে দেখা করলাম। ডাক্তার নন্দীর কাছে যেয়ে নিজেকে দেখলাম। তিনি ঔষধ লিখে দিলেন, আওয়ামী লীগ অফিসে যেয়ে দেখি একখানা টেবিল, দুই তিনখানা চেয়ার, একটা লং টুল। প্রফেসার কামরুজ্জামান অফিসে বসেন। একটা ছেলে রাখা হয়েছে, যাকে অফিস পিয়ন বলা যেতে পারে। শামসুল হক সাহেব জেলে। আমি জয়েন্ট সেক্রেটারি। ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকলাম। তাতে যে বার-তেরজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন তারা আমাকে এ্যাকটিং জেনারেল সেক্রেটারি করে প্রতিষ্ঠানের ভার দিলেন। আতাউর রহমান সাহেব অন্যতম সহ-সভাপতি ছিলেন, তিনি সভাপতিত্ব করলেন।’ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি পাঁচ দিন কারাগারে ছিলেন। একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর আটক হয়ে মুক্তি পান ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি। এ দফায় তিনি ১৩২ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৪৯ সালের ২৯ এপ্রিল আবারও কারাগারে গিয়ে ৮০ দিন কারাভোগ করে মুক্তি পান ১৭ জুলাই। ওই দফায় তিনি আরো ২৭ দিন কারাভোগ করেন। একই বছরের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ দিন অর্থাৎ ১৯৪৯ সালে আরো ৯০ দিন জেলখানায় ছিলেন। ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন। এরপর ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তৎকালীন পূর্ব বাংলার সমস্ত জেলায় দলের কমিটি গঠন করায় তৎপর হন এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, দলের কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। আসলে দলের জন্য কাউন্সিল সভার গুরুত্ব তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন। কারণ জনগণ ও কর্মীদের সঙ্গে নেতাদের যোগাযোগও বৃদ্ধি পায় এতে। তাছাড়া সরকারের জুলুমকে মোকাবেলা করার জন্য ঐক্য খুবই জরুরি ছিল। এ জন্যই বলেছেন- ‘১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন হলেও আজ পর্যন্ত কোন কাউন্সিল সভা হতে পারেও নাই, কারণ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সকলকেই প্রায় কারাগারে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে। আমি সমস্ত জেলা ও মহকুমা আওয়ামী লীগকে নির্দেশ দিলাম তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন শেষ করতে হবে। তারপর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সংগঠনের কর্মকর্তা নির্বাচন করবে এবং গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো গ্রহণ করবে। আমি দিনরাত সমানভাবে পরিশ্রম শুরু করলাম। শহীদ সাহেব যে সমস্ত মহকুমায় যেতে পারেন নাই আমি সেই সকল মহকুমায় সভা করে পার্টি গড়তে সাহায্য করলাম। জনগণ ও কর্মীদের থেকে সাড়া যে পেলাম তা প্রথমে কল্পনা করতে পারি নাই। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়বার কাজে সাহায্য করছিল এই জন্য যে, শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া সরকারের জুলুমকে মোকাবেলা করা কষ্টকর। আওয়ামী লীগ গড়ে উঠবার পূর্ব পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রলীগই সরকারের অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবি দাওয়া তুলে ধরত।’

অন্যত্র লিখেছেন- ‘প্রথম কাউন্সিল সভা ডাকা হল ঢাকায়। হল পাওয়া খুবই কষ্টকর। ইয়ার মোহাম্মদ খানের সাহায্যে মুকুল সিনেমা হল পেতে কষ্ট হল না। কাউন্সিল সদস্যদের থাকার জন্য কোন জায়গা না পেয়ে বড় বড় নৌকা ভাড়া করলাম সদরঘাটে। ঠিক হল সোহরাওয়ার্দী সাহেব কাউন্সিলে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন।

কাউন্সিল সভার দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রবীণ নেতা এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন, যাতে আমাকে জেনারেল সেক্রেটারি না করা হয়। আমি এ সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখতাম না, কারণ প্রতিষ্ঠানের কাজ, টাকা জোগাড়, কাউন্সিলারদের থাকার বন্দোবস্তসহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হত। আবদুস সালাম খান, ময়মনসিংহের হাশিমউদ্দিন আহমদ, রংপুরের খয়রাত হোসেন, নারায়ণগঞ্জের আলমাস আলী ও আবদুল আউয়াল এবং আরও কয়েকজন এই ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিলেন। প্রতিষ্ঠানের জন্য টাকা পয়সা এরা দিতেন না, বা জোগাড় করতেন না। প্রতিষ্ঠানের কাজও ভালভাবে করতেন না। তবে আমি যাতে জেনারেল সেক্রেটারি না হতে পারি তার জন্য অর্থ ব্যয় করতেন। সালাম সাহেবের অসন্তুষ্ট হবার প্রধান কারণ ছিল আমি নাকি তাকে ইমপর্টেন্স না দিয়ে আতাউর রহমান খান সাহেবকে দেই। আমি এ সমস্ত পছন্দ করতাম না, তাই আতাউর রহমান সাহেবকে কাউন্সিল সভার প্রায় পনের দিন পূর্বে একাকী বললাম, “আপনি জেনারেল সেক্রেটারি হতে রাজি হন; আমার পদের দরকার নাই। কাজ তো আমি করছি এবং করব, আপনার কোনো অসুবিধা হবে না।” আতাউর রহমান সাহেব বললেন, “আমি এত সময় কোথায় পাব? সকল কিছু ছেড়ে দিয়ে কাজ করার উপায় আমার নাই। এখন যে জেনারেল সেক্রেটারি হবে তার সর্বক্ষণের জন্য পার্টির কাজ করতে হবে। আপনি ছাড়া কেউ এ কাজ পারবে না, আপনাকেই হতে হবে। আমি বললাম, “কয়েকজন নেতা তলে তলে ষড়যন্ত্র করছে। তারা বলে বেড়ান একজন বয়েসী লোকের জেনারেল সেক্রেটারি হওয়া দরকার। দুঃখের বিষয় এই ভদ্রলোকদের এতটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ নাই যে, আমি জেল থেকে বের হয়ে রাতদিন পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠানের একটা রূপ দিয়েছি।” আতাউর রহমান সাহেব বললেন, “ছেড়ে দেন ওদের কথা, কাজ করবে না শুধু বড় বড় কথা বলতে পারে সভায় এসে।” আমি বললাম, “চিন্তা করে দেখেন; একবার যদি আমি ঘোষণা করে দেই যে, আমি প্রাথী তখন কিন্তু আর কারও কথা শুনব না।” তিনি বললেন, “আপনাকেই হতে হবে।” আতাউর রহমান সাহেব জানতেন, তার জন্যই সালাম সাহেব আমার উপর ক্ষেপে গেছেন। মওলানা সাহেব আমাকে জেনারেল সেক্রেটারি করার পক্ষপাতী। তাকেও আমি বলেছিলাম, আমি ছাড়া অন্য কাউকে ঠিক করতে, তিনি রাজি হলেন না এবং বললেন, “তোমাকেই হতে হবে।” শহীদ সাহেব করাচিতে আছেন, তিনি এ সমস্ত বিষয় কিছুই জানতেন না।

কাউন্সিল সভায় ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র গ্রহণ করা হল এবং নির্বাচনও সর্বসম্মতিক্রমে হয়ে গেল। মওলানা ভাসানী সভাপতি, আতাউর রহমান সাহেব সহ-সভাপতি, আমি সাধারণ সম্পাদক।... এখন আওয়ামী লীগ একটা সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে জনগণের সামনে দাঁড়াল। ম্যানিফেস্টো বা ঘোষণাপত্র না থাকলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।’

কিন্তু ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পরও বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে যেতে হয়। সে সময়ে ৩০ মে ১৯৫৪ থেকে ২৩ ডিসেম্বর ১৯৫৪ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ২০৬ দিন কারাভোগ করেন। ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শেখ মুজিব দলের নাম থেকে ‘মুসলিম' শব্দটি প্রত্যাহারের প্রস্তাব পেশ করলে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় কাগমারিতে এবং একইসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল সাংস্কৃতিক সম্মেলন। একই বছর ৩০ মে দলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, একই ব্যক্তি একসঙ্গে সরকার ও সংগঠনের দুটো পদে থাকতে পারবেন না। শেখ মুজিব দলকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। অর্থাৎ সংগঠনকে সুসংগঠিত করার উদ্দেশ্যে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেন।কিন্তু দলকে তৃণমূল জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গিয়ে তিনি শাসকদের কাছে আরো বেশি শত্রুতে পরিণত হন।১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির পর বঙ্গবন্ধু ১১ অক্টোবর গ্রেফতার হন। এ সময়ে টানা ১ হাজার ১৫৩ দিন তাঁকে কারাগারে কাটাতে হয় ৮ ডিসেম্বর ১৯৬১ পর্যন্ত। এরপর ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি আবারও গ্রেফতার হয়ে মুক্তি পান ওই বছরের ১৮ জুন। এ দফায় তিনি কারাভোগ করেন ১৫৮ দিন। এরপর ’৬৪ ও ’৬৫ সালে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি ৬৬৫ দিন কারাগারে ছিলেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তাঁর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। ওই সভায় দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি এবং সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় সম্বলিত প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছয় দফা উপস্থাপনের বছর ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এর পর তিনি ছয়-দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা পূর্ববাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। তিনি যেখানে সমাবেশ করতে গেছেন, সেখানেই গ্রেফতার হয়েছেন। ওই সময়ে তিনি ৩২টি জনসভা করে বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ৬৬ সালের ৮ মে আবারও গ্রেফতার হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পান। এ সময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন। এসময় আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাকর্মীকে কারাবন্দি করা হয়। নিপীড়ন ও অত্যাচার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে।এর ফলও ভোগ করে পাকিস্তানি শাসকরা।

১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন। ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের মহিলাসহ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের মূল সংগঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর প্রিয় আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। এ দফায় তিনি কারাগারে ছিলেন ২৮৮ দিন। বঙ্গবন্ধুকে স্মরণে রেখেই আওয়ামী লীগের নেতৃবর্গের দ্বারা মুজিবনগর সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেও ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন হলে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। জাতীয় সংসদের বিদায়ী নেতা বঙ্গবন্ধু সংসদে তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ২৬ জানুয়ারি জাতির পিতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি ও এম মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে সতের সদস্যের মন্ত্রিপরিষদ ও নয় জন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগদান করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে মন্ত্রীদের সম্পত্তির হিসাব দিতে হবে বলে যুগান্তকারী এক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় দল ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা বাকশাল গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু নতুন গঠিত এই জাতীয় দলে যোগদানের জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। ৬ জুন বঙ্গবন্ধু জাতীয় দল “বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ”-এর কার্যনির্বাহী ও কেন্দ্রীয় কমিটি এবং গঠনতন্ত্র ঘোষণা দেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে বাকশাল গঠন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে এদেশের মানুষের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিলেন। তার মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় বিশ্ববাসীর কাছে ছিল একটি বিস্ময়।

একইভাবে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে ভারত থেকে স্বদেশ প্রত্যার্বতনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদেশকে উন্নয়নের ধারায় উন্নত রাষ্ট্রের মহিমা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। লেখাবাহুল্য, আওয়ামী লীগের ইতিহাস যেমন বাংলাদেশের ইতিহাস তেমনি আওয়ামী লীগের ইতিহাস বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা যুগের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ইতিহাস।

২.

বঙ্গবন্ধুর নিজের জবানিতে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার কারণ এবং সাংগঠনিক তৎপরতার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এ রকম- ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে ঢাকায় মওলানা ভাসানী, মিয়া ইফতিখারউদ্দিন, আরও অনেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যদি মুসলিম লীগে কোটারি করা হয়, তবে নতুন পার্টি করা হবে। সোহরাওয়ার্দী মত দেন। তাছাড়া মুসলিম লীগের ওপর এদেশবাসী বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এটা কোটারি, কুশাসন, জুলুম, অত্যাচার এবং অর্থনৈতিক কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ না করার ফলে ঘটেছিল। তখনও ইংরেজ আমলের সেই বাঁধাধরা নিয়মে দেশ শাসন চলছিল। স্বাধীন দেশ, জনগণ নতুন কিছু আশা করেছিল, ইংরেজ চলে গেলে তাদের অনেক উন্নতি হবে এবং শোষণ থাকবে না। তারা দেখল ঠিক তার উল্টা। জনগণের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছিল। এদিকে ভ্রূক্ষেপ ছিল না শাসকগোষ্ঠীর।

উপনির্বাচনে জেতার পর শামসুল হক টাঙ্গাইল থেকে ফিরে আসার পরেই পুরানা মুসলিম লীগ কর্মীরা মিলে এক কর্মী সম্মেলন ডাকে ঢাকায়- ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সে সভা আহ্বান করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- ‘কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। আমরা জেলে বসেই সে খবর পাই। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে অফিস হয়েছে। শওকত মিয়া সকলের খাওয়া ও থাকার বন্দোবস্ত করত। সে ছাড়া ঢাকা শহরে কেইবা করবে? আর একজন ঢাকার পুরানা লীগকর্মী ইয়ার মোহাম্মদ খান সহযোগিতা করছিলেন। ইয়ার মোহাম্মদ খানের অর্থবল ও জনবল দুইই ছিল। এডভোকেট আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান এবং আনোয়ারা খাতুন এমএলএ সহযোগিতা করছিলেন। আমরা সম্মেলনের ফলাফল সম্বন্ধে খুবই চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার মত নেওয়ার জন্য। আমি খবর দিয়েছিলাম, “আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না। এদের কোনো কর্মপন্থাও নাই। আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, না রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন হলে তাতে যোগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।

কিছুদিন পূর্বে জনাব কামরুদ্দিন সাহেব ‘গণআজাদী লীগ’ নাম দিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান করেছিলেন, কিন্তু তা কাগজপত্রেই শেষ। যাহোক, কোথায়ও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজ গার্ডেন বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল। শুধু কর্মীরা না, অনেক রাজনৈতিক নেতাও সেই সম্মেলনে যোগদান করেন। শেরে বাংলা এ. কে, ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আল্লামা মাওলানা রাগীব আহসান, এমএলএদের ভিতর থেকে জনাব খয়রাত হোসেন, বেগম আনোয়ারা খাতুন, আলী আহমদ খান ও হাবিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে ধনু মিয়া এবং বিভিন্ন জেলার অনেক প্রবীণ নেতাও যোগদান করেছিলেন। সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।’ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে ‘নিরাপত্তা বন্দি’। আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনও আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন।

আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হওয়ার কয়েকদিন পরেই আমার ও বাহাউদ্দিনের মুক্তির আদেশ এল। বাইরে থেকে আমার সহকর্মীরা নিশ্চয়ই খবর পেয়েছিল। জেলগেটে গিয়ে দেখি বিরাট জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য এসেছে মওলানা ভাসানী সাহেবের নেতৃত্বে। বাহাউদ্দিন আমাকে চুপি চুপি বলে, “মুজিব ভাই, পূর্বে মুক্তি পেলে একটা মালাও কেউ দিত না, আপনার সাথে মুক্তি পাচ্ছি, একটা মালা তো পাব।’’ আমি হেসে দিয়ে বললাম, “আর কেউ না দিলে তোমাকে আমি মালা পরিয়ে দিতাম।” জেলগেট থেকে বের হয়ে দেখি, আমার আব্বাও উপস্থিত। তিনি আমাকে দেখবার জন্য বাড়ি থেকে এসেছেন। আমি আব্বাকে সালাম করে ভাসানী সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁকেও সালাম করলাম। সাথে সাথে আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ, ছাত্রলীগ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উঠল। জেলগেটে এই প্রথম আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’ হল। শামসুল হক সাহেবকে কাছে পেয়ে তাকে অভিনন্দন জানালাম এবং বললাম, “হক সাহেব, আপনার জয়, আজ জনগণের জয়।” হক সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, “চল, এবার শুরু করা যাক।” পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ নামে পরিচিত হয়।’

মুসলীম লীগের আদর্শহীনতার কারণে নতুন প্ল্যাটফর্ম

রাজনীতি করতে হলে নীতি-আদর্শ ও ত্যাগের মহিমায় সঞ্জীবিত হতে হয়। বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগ সম্পর্কে লিখেছেন- ‘যে কোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোন ভাল কাজ করতে পারে নাই এ বিশ্বাস আমার ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এদেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে এবং ত্যাগ আমাদের করতে হবে পাকিস্তানের জনগণকে সুখী করতে হলে। মুসলিম লীগ সরকার নির্যাতন চালাবে এবং নির্যাতন ও জুলুম করেই ক্ষমতায় থাকতে চেষ্টা করবে। নির্যাতনের ভয় পেলে বেশি নির্যাতন ভোগ করতে হয়। এখনও মুসলিম লীগের নামে মানুষকে ধোকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে কিছুটা; কিন্তু বেশি দিন ধোকা দেওয়া চলবে না। মুসলিম লীগের নামের যে মোহ এখনও আছে, জনগণকে বুঝাতে পারলে এবং শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে পারলে মুসলিম লীগ সরকার অত্যাচার করতে সাহস পাবে না।’

রাজনীতিতে সাহসিকতা

আর তিনি রাজনীতিতে পৃষ্ঠ- প্রদর্শনের পক্ষপাতী ছিলেন না। এজন্য মওলানা ভাসানী তাঁকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার এড়াতে পালাতে বলেছিলেন। তার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন- ‘তখন মওলানা ভাসানী ইয়ার মোহাম্মদ খানের বাড়িতে থাকতেন। তাঁর সাথে আমার দেখা করা দরকার; কারণ তাঁকে এখনও গ্রেফতার করা হয় নাই। তাকে জিজ্ঞাসা করা দরকার, তিনি কেন আমাকে গ্রেফতার হতে নিষেধ করেছেন? আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। কারণ, আমি গোপন রাজনীতি পছন্দ করি না, আর বিশ্বাসও করি না।’

গণতন্ত্র চর্চার দল

আওয়ামী লীগ ছিল গণতন্ত্র চর্চার দল। তিনি লিখেছেন- ‘পাকিস্তানে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে, তাতেই আমাদের ভয় হল। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুলি করে হত্যা করা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর। আমরা যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তারা এই সমস্ত জঘন্য কাজকে ঘৃণা করি।’

আওয়ামী লীগ গঠনের উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার। কারণ তখন এ অঞ্চলকে রীতিমত শোষণ করা হচ্ছিল। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন- ‘আমরা আওয়ামী লীগ গঠন করার সাথে সাথে যে ড্রাফট পার্টি ম্যানিফেস্টো বের করেছিলাম, তাতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা থাকায় লিয়াকত আলী খান আরও ক্ষেপে গিয়েছিলেন। পূর্ব বাংলা সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও যে উদারতা দেখিয়েছিল দুনিয়ার কোথায়ও তাহার নজির নাই। প্রথম গণপরিষদে পূর্ব বাংলার মেম্বার সংখ্যা ছিল চুয়াল্লিশজন। ...সিন্ধু, সীমান্ত ও বেলুচিস্তান নিয়েছিল আঠাশজন। পূর্ব বাংলার কোটার চুয়াল্লিশজন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দাদের ছয়জন মেম্বার পূর্ব বাংলা নির্বাচিত করে দেয়। কেউই আপত্তি করে নাই। আমরা সংখ্যাগুরু থাকা সত্তেও রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিকে করা হয়। আমাদের সদস্যরা বা জনগণ আপত্তি করে নাই। কিন্তু যখন দেখলাম, শিল্প কারখানা যা কিছু হতে চলেছে সবই পশ্চিম পাকিস্তানেই গড়ে উঠতে শুরু করেছে, আর কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়া পূর্ব বাংলার আর কেউ কোথায়ও নাই, বিশেষ করে বড় বড় সরকারি চাকরিতে পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করা শুরু হয়ে গেছে।’

এ কারণে নিজের দল সম্পর্কে তিনি আশাবাদী ছিলেন- ‘যাহোক, দুই তিনটা জেলা ছাড়া জেলা কমিটিও গঠন হয় নাই। প্রতিষ্ঠান গড়ার সুযোগ এসেছে। সাহস করে কাজ করে যেতে পারলে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। কারণ, জনগণ এখন মুসলিম লীগ বিরোধী হয়ে গেছে। আর আওয়ামী লীগ এখন একমাত্র বিরোধী দল, যার আদর্শ আছে এবং নীতি আছে। তবে সকলের চেয়ে বড় অসুবিধা হয়েছে টাকার অভাব।’

পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে নিজের দল সম্পর্কে বলে এসেছিলেন- ‘আমি তাকে বললাম যে, “আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টি। তাকে কাজ করতে সুযোগ দেওয়া উচিত। বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না। আপনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তা আমি জানি।” তিনি স্বীকার করলেন, আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল। আমি তাঁকে বললাম, “আওয়ামী লীগ বিরোধী দল আপনি স্বীকার করে নিয়েছেন, একথা আমি খবরের কাগজে দিতে পারি কি না?” তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই দিতে পার।”

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্র চর্চার জন্য দলের অস্তিত্ব দরকার। তিনি পশ্চিমাঞ্চলের অবস্থাও লিখেছেন- ‘রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। এই সময় মুসলিম লীগ দলের মোকাবেলায় একমাত্র আওয়ামী লীগই বিরোধী দল হিসাবে গড়ে উঠতে লাগল। পশ্চিম পাকিস্তানেও একদল নিঃস্বার্থ নেতা ও কর্মী আওয়ামী লীগ গঠন করতে এগিয়ে এলেন পীর মানকী শরীফের নেতৃত্বে।’

দলের জন্য জনসংযোগ

দলের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে রাজনীতির কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করেন বঙ্গবন্ধু। দল চালানোর মতো যথেষ্ট টাকা না থাকলেও তা নিয়ে বিচলিত হননি কখনো। বরং দলের প্রতি জনগণের আস্থা ও ভালোবাসাকে বেশি মূল্য দিয়েছেন। লিখেছেন- ‘মওলানা ভাসানী, আমি ও আমার সহকর্মীরা সময় নষ্ট না করে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। পূর্ব বাংলার জেলায়, মহকুমায়, থানায় ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে এক নিঃস্বার্থ কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করতে সক্ষম হলাম। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্ররা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মন প্রাণ দিয়ে রুখে দাঁড়াল। দেশের মধ্যে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছিল। শাসনযন্ত্র শিথিল হয়ে গিয়েছিল। সরকারি কর্মচারীরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারত। খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করে। বেকার সমস্যা ভীষণভাবে দেখা দিয়েছে। শাসকদের কোন প্ল্যান প্রোগাম নাই। কোনোমতে চললেই তারা খুশি। পূর্ব বাংলার মন্ত্রীরা কোথাও সভা করতে গেলে জনগণ তাদের বক্তৃতা শুনতেও চাইত না। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির কথা কেউই ভুলে নাই। আমরা তাড়াতাড়ি শাসনতন্ত্র করতে জনমত সৃষ্টি করতে লাগলাম। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা না মেনে নিলে আমরা কোনো শাসনতন্ত্র মানব না। এসময় ফজলুর রহমান সাহেব আরবি হরফে বাংলা লেখা পদ্ধতি চালু করতে চেষ্টা করছিলেন। আমরা এর বিরুদ্ধেও জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কোনো কোনো মুসলিম লীগ নেতা এককেন্দ্রিক সরকার গঠনের জন্য তলে তলে প্রপাগান্ডা করছিলেন। আওয়ামী লীগ ফেডারেল শাসনতন্ত্র ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির ভিত্তিতে প্রচার শুরু করে জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল।...

এরপর আমি হক সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে আওয়ামী লীগে যোগদান করতে অনুরোধ করলাম। চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় তিনি যোগদানও করলেন। সেখানে ঘোষণা করলেন, “যাঁরা চুরি করবেন তারা মুসলিম লীগে থাকুন, আর যারা ভাল কাজ করতে চান তারা আওয়ামী লীগে যোগদান করুন। আমাকে ধরে জনসভায় বললেন, “মুজিব যা বলে তা আপনারা শুনুন। আমি বেশি বক্তৃতা করতে পারব না, বুড়া মানুষ।” এ বক্তৃতা খবরের কাগজেও উঠেছিল।’

রাজনীতিতে আদর্শ ও নীতিহীনতার বাস্তবতা

‘আওয়ামী লীগের সভাপতি বিলাতে, জেনারেল সেক্রেটারি কারাগারে বন্দি। অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে। এই অবস্থায় কি করে গোলাম মোহাম্মদকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেবার বন্দোবস্ত করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বুঝতে কষ্ট হতে লাগল। আরও দেখলাম, একটা ফুলের মালা নিয়ে আতাউর রহমান সাহেব, আর একটা মালা হক সাহেব নিয়ে তেজগা এয়ারপোর্টে গোলাম মোহাম্মদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত গোলাম মোহাম্মদ সাহেবের গলায় দুইজনই মালা দিলেন। কিছুদিন পূর্বের থেকেই আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক দলের মধ্যে মনকষাকষি চলছিল এই অভ্যর্থনার ব্যাপার নিয়ে। এটা পরিষ্কার হয়ে পড়ল। কৃষক শ্রমিক দল আর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়, একমাত্র হক সাহেবের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার উপর নির্ভর করে কিছু সংখ্যক সুবিধাবাদী লোক একজোট হয়েছে ক্ষমতার ভাগ বসানোর জন্য। এদের কোনো সংগঠন নাই, আদর্শ নাই, নীতি নাই। একমাত্র হক সাহেবই এদের সম্বল। তারা গোলাম মোহাম্মদ সাহেবকে কেন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া)কেও অভ্যর্থনা করতে পারেন; কিন্তু আওয়ামী লীগ একটা সংগ্রামী প্রতিষ্ঠান—সেই প্রতিষ্ঠানের নেতারা কি করে এই অগণতান্ত্রিক ভদ্রলোককে অভ্যর্থনা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমার বুঝতে কষ্ট হল! আমি ও আমার সহবন্দিরা খুবই মর্মপীড়ায় ভুগছিলাম। আমাদের দুঃখ হল এজন্য যে, আমাদের নেতারাও ক্ষমতার লোভে পাগল হয়ে পড়েছেন। এতটুকু বুঝবার ক্ষমতা আমাদের নেতাদের হল না যে, যুক্তফ্রন্টের দুই গ্রুপকে নিয়ে খেলা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক দলকে আলাদা আলাদাভাবে তারা যোগাযোগ করছে, যাতে গোলাম মোহাম্মদ সাহেব পূর্ব বাংলায় এসে বিরাট অভ্যর্থনা পেতে পারেন। হলও তাই। কিন্তু তিনি যা করবেন, তা ঠিক করেই রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীকে দিয়ে যে তিনি যুক্তফ্রন্টকে দ্বিধাবিভক্ত করাবেন সে ক্ষমতাও তাকে দেওয়া হয়েছিল। যদিও পরে শুনেছিলাম, গোলাম মোহাম্মদ ওয়াদা করেছিলেন শহীদ সাহেব জুরিখ থেকে ফিরে আসলেই তাকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। বড় বড় শিল্পপতিরা ও কিছু সংখ্যক আমলা কিছুতেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে সেটা চাইছিলেন না।’

যুক্তফ্রন্ট ও দলের অবস্থান

যুক্তফ্রন্ট গঠন করা ও নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। লিখেছেন-‘ওয়ার্কিং কমিটির সভায় এ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হল। বেশি সংখ্যক সদস্যই যুক্তফ্রন্টের বিরোধী। কারণ, যাদের সাথে নীতির মিল নাই, তাদের সাথে মিলে সাময়িকভাবে কোনো ফল পাওয়া যেতে পারে, তবে ভবিষ্যতে ঐক্য থাকতে পারে না। তাতে দেশের উপকার হওয়ার চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা এই একতা চাচ্ছিল, তাদের উদ্দেশ্য মুসলিম লীগকে পরাজিত করা এবং ক্ষমতায় যে কোনোভাবে অধিষ্ঠিত হওয়া। ক্ষমতায় না গেলে চলে কেমন করে, আর কতকাল বিরোধী দল করবে।’... ‘আমি মওলানা সাহেবকে বললাম, “আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করবে, ভয়ের কোনো কারণ নাই। আর যদি সংখ্যাগুরু না হতে পারি আইনসভায় আওয়ামী লীগই বিরোধী দল হয়ে কাজ করবে। রাজনীতি স্বচ্ছ থাকবে, জগাখিচুড়ি হবে না। আদর্শহীন লোক নিয়ে ক্ষমতায় গেলেও দেশের কাজ হবে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার হতে পারে।” মওলানা সাহেব একমত হলেন, আমাকে বিভিন্ন জেলায় সভার ব্যবস্থা করতে বললেন। তিনি ও আমি প্রত্যেক জেলায় ও মহকুমায় ঘুরব, কোথায় কাকে নমিনেশন দেওয়া হবে ঠিক করব। শহীদ সাহেবও কয়েকদিনের মধ্যে করাচি থেকে ফিরে আসবেন এবং সমস্ত নির্বাচনের ভার নিবেন। আওয়ামী লীগের একটা জিনিসেরই অভাব ছিল, সেটা হল অর্থবল। তবে নিঃস্বার্থ এক বিরাট কর্মীবাহিনী ছিল, যাদের মূল্য টাকায় দেওয়া যায় না। টাকা বেশি দরকার হবে না, প্রার্থীরা যে যা পারে তাই খরচ করবে। জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষে।’

দলের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ

গোপন রাজনীতি যেমন বঙ্গবন্ধু পছন্দ করতেন না তেমনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন।ইসলামকে সামনে রেখে মানুষকে শোষণ করেছিল তৎকালীন শাসকরা। ধর্মের নামে সেই রাজনীতির কথা তুলে ধরেছেন তিনি। আসলে ইসলামের প্রকৃত পরিচর্যাকারী হয়েও জাতির পিতা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনীতিবিদ। তিনি লেবাস-সর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী ছিলেন না। আর পাকিস্তানিদের মতো ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর লেখায় আছে- ‘পাকিস্তান হবে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী বা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান নাগরিক অধিকার থাকবে। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তান আন্দোলনের যারা বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, এখন পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র করার ধুয়া তুলে রাজনীতিকে তারাই বিষাক্ত করে তুলেছে। মুসলিম লীগ নেতারাও কোনো রকম অর্থনৈতিক ও সমাজনৈতিক প্রোগ্রাম না দিয়ে একসঙ্গে যে শ্লোগান দিয়ে ব্যস্ত রইল, তা হল ইসলাম’। পাকিস্তানের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ যে আশা ও ভরসা নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন, তথা পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে কোন নজর দেওয়াই তারা দরকার মনে করল না। জমিদার ও জায়গিরদাররা যাতে শোষণ করতে পারে সে ব্যাপারেই সাহায্য দিতে লাগল। কারণ, এই শোষক লোকেরাই এখন মুসলিম লীগের নেতা এবং এরাই সরকার চালায়।’

‘আওয়ামী লীগ ও তার কর্মীরা যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা ও কর্মী আছে যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে; এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রবাদের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা চলে। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা কোনোদিন কোনো রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কাছে মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি, অবাঙালি সকলেই সমান। শোষক শ্ৰেণীকে তারা পছন্দ করে না। পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ রকম অপপ্রচার করা হয়েছে।’

আরো লিখেছেন- ‘আমরা যখন জেলে তখন এক রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হল, কলকাতা ও ঢাকায়। কলকাতায় নিরপরাধ মুসলমান এবং ঢাকায় ও বরিশালে নিরপরাধ হিন্দু মারা গেল। কে বা কারা রটিয়ে দিয়েছিল যে, শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেবকে কলকাতায় হত্যা করেছে। আর যায় কোথায়! মুসলমানরাও ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের অনেক লোককে গ্রেফতার করে আনল ঢাকা জেলে। আমরা যেখানে থাকি সেই পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডেই এদের দিনেরবেলায় রাখত। আমার মনে হয়, সাত-আটশত লোককে গ্রেফতার করেছে। আমি তাদের সাথে বসে আলাপ করতাম। সকলেই অপরাধী নয়, এর মধ্যে সামান্য কিছু লোকই দোষী। সাধারণত দোষী ব্যক্তিরা গ্রেফতার বেশি হয় না। রাস্তার নিরীহ লোকই বেশি গ্রেফতার হয়। তাদের কাছে বসে বলি, দাঙ্গা করা উচিত না; যে কোনো দোষ করে না, তাকে হত্যা করা পাপ। মুসলমানরা কোনো নিরপরাধীকে অত্যাচার করতে পারে না, আল্লাহ ও রসুল নিষেধ করে দিয়েছেন। হিন্দুদেরও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। তারাও মানুষ। হিন্দুস্তানের হিন্দুরা অন্যায় করবে বলে আমরাও অন্যায় করব—এটা হতে পারে না। ঢাকার অনেক নামকরা গুণ্ডা প্রকৃতির লোকেদের সাথে আলাপ হল, তারা অনেকেই আমাকে কথা দিল, আর কোনোদিন দাঙ্গা করবে না। জানি না, তারা আমার কথা রেখেছে কি না? তবে কয়েকজন যে আমার খুবই ভক্ত হয়ে গিয়েছিল তার প্রমাণ আমি জেল থেকে বের হয়ে পেয়েছি। এরা আমাকে রীতিমত ভক্তি করতে শুরু করেছে। আপদে বিপদে আমার পাশেও দাঁড়িয়েছে বিপদ ঘাড়ে নিয়ে।’

যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ধর্মকে ব্যবহার

‘এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে যে, জনগণকে ইসলাম ও মুসলমানের নামে’ স্লোগান দিয়ে ধোঁকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না এ ধারণা অনেকেরই হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি।’

১৯৫৬ সালের মার্চে গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে পাকিস্তান ইসলামী নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে মর্মে উল্লেখ থাকায় এবং তা সংবিধানের মৌলিক চরিত্র হওয়ায় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অর্থাৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় একই দেশের সমঅধিকারবঞ্চিত নাগরিক হিসেবে গণ্য হয়েছিল। পাকিস্তানি সংবিধানে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছিল বলেই বঙ্গবন্ধু তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমার সুস্পষ্ট বক্তব্য, আমরা লেবাস সর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রাসূলে করীম (সাঃ)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বার বার যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে, আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদের বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জনই মুসলমান সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাসের কথা ভাবতে পারেন তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা ফারস্থা করে তোলার কাজে।’

স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনার জন্য আয়োজিত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু নির্ভীক কণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার স্ব-স্ব অধিকার অব্যাহত থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মচর্চা বন্ধ করতে চাই না এবং তা করবও না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রের কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। আমাদের আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

৩.

মূলত দেশ স্বাধীন হবার পর রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চারিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় থেকেই সচেতন ছিলেন। ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য সংবিধানে ১২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে ৩৮ অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা হয় সেসময়ই। যা বর্তমান সরকারের সময়ও বহাল রয়েছে। ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে কোনো ব্যক্তি সংগঠন বা সংঘ করতে পারবেন কিন্তু তা যদি নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে কিংবা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে তাহলে উক্ত সংগঠন, সংঘ বা দল সংবিধানের পরিপন্থী বলে গণ্য হবে। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগও এই নীতি মেনে গড়ে উঠেছিল। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু ইসলামি আদর্শের মানুষ হলেও সকল ধর্মের প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন করতেন। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে তিনি কখনোই সমর্থন করেননি। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে বাংলাদেশে সকল সম্প্রদায়ের সমান অধিকারের কথা বলা আছে। বঙ্গবন্ধু সংবিধানে সেই অধিকার লিপিবদ্ধ করে গেছেন আর তাঁর আদর্শ অনুসরণ করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ ও শক্তিশালী দল চালাচ্ছেন।

লেখক : বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

এইচআর/বিএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।