হাবিবুর রহমান মিলন : উজান স্রোতের মাঝি
বাংলাদেশ হচ্ছে উচ্চকণ্ঠ মানুষের দেশ। কিছুটা হয়তো প্রাকৃতিক কারণেও। এদেশে কেউ যোগ্যতর হলেও তিনি সচরাচর প্রকৃত মর্যাদা পান না, যদি কণ্ঠ উঁচু করে কথা বলতে না পারেন। আবার অন্যদিকে বহু যোগ্যতাহীন দুর্বৃত্ত বাগিয়ে নেয় বহুকিছু শুধু উচ্চকণ্ঠ যোগ্যতা আর হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ফর্মূলা অনুযায়ী।
শাস্ত্রী বলেছিলেন : ‘যে তৈল দিতে পারিবে, তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসর হইতে পারে।’বাংলাদেশের আরেক নমস্য সাংবাদিক আব্দুল আউয়াল খান ‘সংবাদ- এ বহু ক্ষোভ নিয়ে লিখেছিলেন ‘যাদের পাদুকা পাওয়ার কথা, তারা পাচ্ছে পদক।’
নিশ্চয়ই এদেশে যোগ্যজনই প্রফেসর হচ্ছেন, যোগ্যজনই পদক পাচ্ছেন। শাস্ত্রী মহাশয় আর খান সাহেব ব্যতিক্রমের কথাই বলেছেন। যাকে নিয়ে এই রচনা, তিনি প্রথম দলের। পড়াশোনা, মানবিক গুণাবলিতে সর্বোচ্চ মানে থাকলেও শুধু নিম্নকণ্ঠ আর তৈল দিতে না পারার ‘অযোগ্যতা’ই তাকে পেছনে ঠেলে রেখেছে সারা জীবন। এ নিয়ে তাঁর মনোকষ্ট ছিল কিন্তু প্রতিহিংসা ছিল না। তিনি বুঝতেন সবই, চিনতেন শত্রু-মিত্র সবাইকেই, কিন্ত তাঁর সহজাত বৈশিষ্ট্য ছিল সবকিছু সহজেই মেনে নেওয়া।
তিনি হাবিবুর রহমান মিলন।‘সংবাদ’দিয়ে কর্মজীবন শুরু হলেও প্রায় গোটা জীবন কাজ করেছেন ইত্তেফাকে। ‘সন্ধানী’ছদ্মনামে দৈনিক ইত্তেফাকে তার নিয়মিত কলাম ছিল ‘ঘরে-বাইরে’। শেষে দৈনিক ইত্তেফাকের উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইউনিয়নের নেতা হিসেবে অখণ্ড বিএফইউজে’র সভাপতি হিসেবে ওয়েজ বোর্ড-সহ এই শিল্পের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আজ ১৪ জুন, তাঁর ৫ম মৃত্যবার্ষিকী। এই তারিখটি বুকে বাঁজে আজও। চলে যাওয়ার আগে কয়েকদিন ধরেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। প্রায় প্রতিদিনই হয় দেখতে যেতাম না হয় ফোনে খোঁজ নিতাম। তাঁর চলে যাওয়ার আগের দিনটিতেই ব্যতিক্রম হলো। আমি তখন বিএফইউজে’র সভাপতি। সাংগঠনিক কাজে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছি।
সেখানেই সন্ধ্যা হয়। এসময় মিলন ভাইয়ের ফোন : ‘লিডার, কই আপনে, আইজতো আইলেন না’। আমি জবাবে বললাম : ‘লিডার আমিতো ঢাকার বাইরে ; কাল সকালেই এসে দেখা করব।’ তিনি খুব ধরা গলায়, নিম্ন কণ্ঠে বললেন: ‘আর বোধ হয় দেখা হইলো না তাইলে’। খুব মন খারাপ হয়ে গেল । আমি কাঁচুমাচু করে পরদিন সকালেই যাবো বলেই ফোন রাখলাম। সাথে সহযোদ্ধা ওমর ফারুককে জানালাম মন খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু পরদিন সকালে এলো অন্য খবর। সে জন্যই বললাম, বুকে বাঁজে আজও তাঁর শেষ কথা টুকু।
মানুষ নাকি তাঁর মৃত্যুর ক্ষণটিকে দেখতে পায়!! আমি আজও এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে ফিরি, ওইদিন সন্ধ্যায় মিলন ভাই কী বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর সময় শেষ হয়ে আসছে? না হলে তিনি আমাকে ওই কথা বললেন কেন, যে পরদিন আর দেখা হচ্ছে না তাঁর সাথে!!! এর জবাব হয়তো একমাত্র তিনিই দিতে পারেন যিনি খেলিছেন ‘এ বিশ্ব লয়ে’।
আমি মৃতদের মুখ দেখি না, কারণ তাঁর জীবনকাল টুকুর স্মৃতিই ধরে রাখতে চাই। তেমনি খুব প্রিয়জন চলে গেলে তাঁকে নিয়ে লেখাও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। আজ পর্যন্ত মোনাজাত ভাইকে নিয়ে একটা পুরো লেখা দাঁড় করাতে পারিনি। অথচ মিলন ভাইয়ের গোটা পরিবার যেমন- আমার পরিবারের অংশ তেমনি মোনাজাত ভাইয়ের পরিবারও। এ রচনাও পূর্ণাঙ্গ নয়, খণ্ডচিত্র মাত্র।
বয়সের একটা বড় ব্যবধান নিয়েও আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনিতো আমাদের নেতাই, তিনি যখন অবিভক্ত বিএফইউজে’র সভাপতি, আমি ময়মনসিংহ সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক।কিন্তু তিনি আমাকে ডাকতেন ‘লিডার’ বলে। আমি খুবই কুণ্ঠিত থাকতাম কিন্তু পরে দেখলাম এটা তার স্বাভাবিক সম্বোধন।
‘সংবাদ’ এ কাজ করতাম বলে আলাদা একটা গুরুত্বও পেতাম তাঁর সাবেক হাউজ বলে। বন্ধু শাহ আলমগীর আর আমি নানা কারণে ছিলাম তাঁর খুবই নির্ভরযোগ্য। নিশ্চয়ই আরও অনেকজন ছিলেন। আমাদের দু’জনের কথা বললাম এজন্য, আমরা দু’জন মিলন ভাইয়ের অনেক কষ্টকর অভিজ্ঞতার সাক্ষী। কেন, কারা তার কষ্টের কারণ তা’ভিন্ন প্রসঙ্গ।
সারোয়ার ভাই যখন ইত্তেফাক ছাড়বেন সিদ্ধান্ত নিলেন, মিলন ভাই চেয়েছিলেন আমি ইত্তেফাকে যোগ দিই। এজন্য তাঁর প্রাণান্ত চেষ্টা আমি দেখেছি। শেষ পর্যন্ত কেন হয় নাই, কে কী করেছেন মিলন ভাই জানতেন, জানতাম আমিও। আমরা লড়াইয়ে নামিনি। কিন্তু ‘মানুষ’ চেনার জন্য অভিজ্ঞতাটা ছিল অসাধারণ।
একবার নির্বাচনে আমাদের দুই শীর্ষ নেতা সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী। এক ধরনের নিরপেক্ষতা থাকলেও মিলন ভাইয়ের প্রতি আমার পক্ষপাতের বিষয়টা সবাই জানতেন। নির্বাচনের ফল তাঁর পক্ষে যায়নি, এর চাইতেও তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন ময়মনসিংহে কম ভোট পাওয়ার জন্য। পরে ওই যে ‘মানুষ’ চেনার মূল চিত্র জানার পর তাঁর ক্ষোভ কমেছিল।
ইত্তেফাকে মালিকদের বাইরে সম্পাদক নিয়োগের সময় কেন মিলন ভাই পিছিয়ে পড়লেন, সেটি তাঁর মেধা বা যোগ্যতার কমতির জন্য নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণ। মিলন ভাই কষ্ট পেলেও এ নিয়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধী কোনো চর্চায় তিনি গা ভাসাননি। বরং বাস্তবতাকে তিনি মেনে নিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানও তাঁকে সন্মান দিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদশ ছিল তাঁর হৃদয় জুড়ে।এখনতো সবাই এই পন্থী, অনেক ভিড়, কিন্ত সেই জিয়া-এরশাদ শাসনে অতিষ্ট বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সাথে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে, যে ক’জন শীর্ষ সাংবাদিক নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁর অন্যতম হাবিবুর রহমান মিলন। এত আন্দোলন শেষে আওয়ামী লীগ যখন প্রথমবার ক্ষমতায়, তখন মিলন ভাই যার সাথে সারাদেশ ঘুরেছেন তেমন একজন নেতা মন্ত্রী। একদিন দেখি মিলন ভাই খুব মন খারাপ করে বসে আছেন। কী ব্যাপার? জানা গেল মিলন ভাই সেই মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেই মন্ত্রী এতই ব্যস্ত, তার এপিএসকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছেন যে, তিনি খুব ব্যস্ত। মিলন ভাই যেন পরে ফোন করে যান।
মিলন ভাই খুবই নিম্নকণ্ঠে বললেন: এই নেতার সাথে কমপক্ষে তিনশ’ সভায় বক্তৃতা দিয়েছি। কোথাও রাতে এক বিছানায় থেকেছি। ইত্তেফাক থেকে বেতনের টাকা অগ্রিম তুলে ওই নেতাকে সাহায্য করেছি।ব্যস ওই পর্যন্তই। নেত্রীর সাথে কতবার দেখা হয়েছে, মিলন ভাই না ওই নেতার নামে কোনো অভিযোগ করেছেন, না নিজের জন্য কিছু চেয়েছেন।
বাংলাদেশ প্রেস ইন্সস্টিটিউট তাঁর ‘ঘরে বাইরে’র বাছাই করা কিছু কলাম নিয়ে একটি গ্রন্থনা করেছে। এই কাজটি করার পেছনে শাহ আলমগীরের আন্তরিক উদ্যোগী ভূমিকা ছিল। আগ্রহীরা দেখবেন আমাদের সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানকে এই লেখাগুলো কিভাবে সমৃদ্ধ করেছে।পরিমিত কিন্তু চৌকষ ভাষায় সমাজ ও রাষ্ট্রের অসঙ্গতি তুলে ধরার মেধাবী বিশ্লেষণ ক্ষমতাইতো সাংবাদিকতার মূল শক্তি। হাবিবুর রহমান অত্যন্ত সফল ছিলেন বলা ও লেখায় এই দুই জায়গাতেই।
আমাদের সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের পেশাদারী মর্যাদা রক্ষায় সর্বশেষ যে প্রজন্ম নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেই প্রজন্মের অন্যতম প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান মিলন। তাঁর প্রজন্মের সাংবাদিকরা সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষায়ও ছিলেন আপসহীন। এরপরে তো খুব অল্প ব্যাতিক্রম বাদে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান হয় কুক্ষিগত হয়েছে মালিকের কাছে অথবা চলে গেছে ভাড়াটেদের হাতে। দুই একটি ব্যতিক্রম বাদে গৌরব করার কিছুই অবশিষ্ট নাই।
ব্যক্তি হাবিবুর রহমান মিলন জীবনের চলতি পথে সকল ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতাকে প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছ থেকে কিন্তু এসব থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছেন অত্যন্ত সফলভাবে। এই শক্তি সবার থাকে না বলেই তারা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসায়।
হাবিবুর রহমান সারা জীবন উজান ঠেলে চলেছেন, ব্যক্তি ও পেশাগত জীবন দুই জায়গাতেই, কিন্ত দমে যাননি।
বয়সের ব্যবধান নিয়েও কত হাস্যরস যে তাঁর সাথে করেছি, তা তিনি আমাদের প্রশ্রয় দিতেন বলেই। আবুল কালাম আজাদ, আখতার আহমেদ খান, স্বপন দাস গুপ্ত. ওমর ফারুক সহ আমরা খোঁচা দিয়ে বলতাম লিডার, আপনার এমন এলাকায় বাড়ি, সেই সরাইলের নাম নিলেই মানুষ বলে, সরাইলের কুত্তার কথা। বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত না হয়ে, ঘাড় দুলিয়ে বলতেন : ‘শুনেন। যে এলাকার কুত্তাই এত বিখ্যাত, সেই এলাকার মানুষ কত বিখ্যাত হইতে পারে, চিন্তা করেন।’
যেখানে তাঁকে কখনই দমানো যায় নাই সেটি হচ্ছে অবিরাম ধূমপান। যখনই বাধা দিতাম বলতেন: ‘লিডার আমি সব দুর্ঘটনায় পড়েছি, রেল-সড়ক-বিমান- নৌ কোনটাই বাদ নাই। ওই সবে যখন মরি নাই, আমার স্বাভাবিক মৃত্যুই হবে।’ হয়েছেও তাই।
আমাদের সাংবাদিক নেতাদের মধ্যে সব মানবিক গুণাবলি নিয়ে অসীম ধৈর্যশীল নেতা ছিলেন হাবিবুর রহমান মিলন। জীবন ভর উজান স্রোতে চলেও নিজের মেধা, যোগ্যতায় নিজের অবস্থান সংহত রাখা আর ছোট বড় সবার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার যে দৃষ্টান্ত সেটি অনেকের জন্যই শিক্ষণীয়।
চলে যাওয়ার দিনটিতে তাকে স্মরণ করি অনিঃশেষ শ্রদ্ধায়।
এসএইচএস/পিআর