ভয় নয়, কাজ দিয়ে করোনা জয়

ড. মীজানুর রহমান
ড. মীজানুর রহমান ড. মীজানুর রহমান , উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত: ০৯:০৬ এএম, ০৮ জুন ২০২০

ভয় নয় কাজ দিয়ে করোনাকে জয় করতে হবে। কাজ করে মানুষ মরে না, যেমনটি বলেছেন হেনরি ফোর্ড, "worry kills more people than work. That's because more people worry than work. Quit worrying start working"। করোনার ভয়কে পেছনে ফেলে সবাই কাজ করতে যাচ্ছে। আগের একটা লেখাতেও বলেছিলাম আমরা যেখানেই থাকি, 'লকডাউনে বাড়িতে, অসুস্থ হয়ে আইসোলেশনে, হাসপাতালে অথবা আইসিইউতে; অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে রাস্তায়, মিডিয়াকর্মী হিসেবে সংবাদের উৎসে, সবখানেই আমাদের খাদ্য, ওষুধ, নিরাপত্তা সামগ্রী, পিপিই এসব লাগছে।

খাদ্য ও নিরাপত্তা সামগ্রীর ৪৮ ঘণ্টা সরবরাহ বন্ধ থাকলে মৃত্যুর জন্য করোনার অপেক্ষায় থাকতে হবে না, ঘটনাটি এর আগেই ঘটে যাবে। আমাদের জীবন বাঁচাতে যা কিছু লাগছে সরবরাহ করছে মার্কেটিং ব্যবস্থা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিক্রয় বাহিনীর সদস্যরা। এদের ভূমিকা যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর ভূমিকার চেয়ে কম নয়। শত দুরবস্থার মধ্যেও মানুষ কেনাবেচা করছে। বিক্রয় বাহিনীর সদস্যরা সতর্কতার সাথে যতটা সম্ভব ‘স্বাস্থ্যবিধি’ মেনে এই কাজটি করছে এবং এটি অব্যাহত রাখবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।

করোনাসৃষ্ট মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া করোনা নিজেও দীর্ঘদিন আমাদের সাথে থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। এখন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন একটা টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত সীমিত পরিসরে ‘স্বাস্থ্যবিধি’ মেনে দূরত্ব বজায় রেখেই চলতে হবে আমাদের। টিকা নিয়েও সন্দেহ আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ মাইক রায়ান যেমনটি বলেছেন, ‘টিকা দিয়ে এই ভাইরাস সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হবে না।’ হামের টিকা দেয়া হচ্ছে, হাম নির্মূল হয়নি। এইচআইভির টিকা আবিষ্কার হয়নি। গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার হয় ১৭৯৬ সালে, গুটি বসন্ত নির্মূল হয় ১৯৮০ সালে অর্থাৎ ১৮৪ বছর সময় নিয়েছে।

থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে জ্বর মেপে যাত্রীদের পরিবহনে বা কারখানায় ঢুকতে দেয়া আর জীবাণুনাশক টানেলের স্প্রে অতিক্রম করা অথবা ওয়াসার পানির গাড়িতে ব্লিসিং বা স্যাভলন মিশিয়ে রাস্তায় পানি ছিটানো, এসকল অকার্যকর, হাস্যকর এবং ‘টাকা মেরে খাওয়ার’ প্রকল্প। এ ব্যাপারে লিখতে গিয়ে এক লেখায় লিখেছিলাম, কোভিড-১৯ এর জীবন আছে কিনা জানি না। আরএনএ কি জীবন নাকি জীবনের অংশ তাও জানি না।

এই লেখা দেখে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞানের অধ্যাপক শামীমা আমাকে মেসেঞ্জারে ইনবক্স করে যা জানিয়েছেন তা হলো, ‘ভাইরাস জীবন ও জড় এর মধ্যবর্তী একটা entity। তারা জীবের সংস্পর্শ ছাড়া বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না। রূপ (mutation) বদলাতে বদলাতে নিশ্চয়ই একসময় এর virulence properties নষ্ট হয়ে যাবে। ততদিন আমাদের স্মার্ট হতে হবে।’

দেশের অন্যতম ভাইরোলজিস্ট গণস্বাস্থ্যের ড. বিজন শীল বলেছেন, ‘আজ হোক কাল হোক প্রত্যেককে করোনার স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে।’ তিনিও হার্ড (HERD) ইমিউনিটির দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন বলেই মনে হলো। তবে শত বছরের মধ্যেও এ ধরনের প্যানডেমিক অবস্থায় না পড়ায় বিশেষজ্ঞরাও বারবার মত বদলাচ্ছেন। অনেকটা করোনার মিউটেশনের মতো।

আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভঙ্গুরতা বিবেচনায় আমাদের বিশেষজ্ঞরা প্রার্থনা করেছিলেন, আমাদের করোনার ঢেউগুলো যেন বড় না হয়। নিউইয়র্কের মতো বড় ঢেউ আসলে শপাঁচেক ভেন্টিলেটর দিয়ে ঢাকার হাজার হাজার সংকটাপন্ন রোগীকে আমরা বাঁচাতে পারব না। অতএব আমাদের পিক যেন বিলম্বিত হয় অর্থাৎ আস্তে আস্তে যেন আসে এবং ঢেউটা যেন হিমালয়সম না হয়ে লালমাইসম হয়।

এখন আবার পিকের বিলম্ব দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিলম্ব আমাদের অনেক ক্ষতি করে দেবে। করোনা থেকে সব দেশ দ্রুত বেরিয়ে যাবে আমরা আটকা পড়ে যাব, দীর্ঘদিন ভোগতে হবে। প্রতিদিন স্বাস্থ্য বুলেটিনে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে নমুনা সংগ্রহের সংখ্যা, পরীক্ষার সংখ্যা, শনাক্তের সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা, পুরুষ মহিলা ও আঞ্চলিক বিভাজনসহ শতাংশ হিসাবে এবং পুঞ্জিভূত মোট পরিসংখ্যান প্রকাশ করে।

এরইমধ্যে ‘দ্য ইকোনোমিস্ট' ম্যাগাজিন আইসিডিডিআর-বির এক কর্মকর্তার অনুমান উল্লেখ করে বলেছে, ‘কেবল ঢাকা শহরেই নাকি ৭ লক্ষ লোক আক্রান্ত’। যদিও আইসিডিডিআর-বি বিবৃতি দিয়ে এই পরিসংখ্যানের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেছেন। পরিসংখ্যানে অনেকেরই আস্থা নেই যেমনটা ছিল না ছদ্মনামধারী লেখক মার্ক টোয়েনের (মার্ক টোয়েনের আসল নাম Samuel Langhorne Clemens, এটাও তার আসল নাম কি না এ নিয়ে সন্দেহ আছে। মার্ক টোয়েন আমেরিকান কিনা এটা অনেকের সন্দেহ ছিল। তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। একবার স্থায়ী ঠিকানা লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন C/O. প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, ইউএসএ)।

মার্ক টোয়েন ১৯০৬ সালে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘সংখ্যা আমাকে প্রতারিত করে (figures often beguile me)’। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরেলি নাকি বলেছিলেন মিথ্যা তিন প্রকার : মিথ্যা , ডাহা মিথ্যা, এবং পরিসংখ্যান। বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ জর্জ ই পি বক্স বলেছেন, ‘সকল মডেলই ভুল, কেবলমাত্র কিছু উপকারী’। আমাদের ভুল হলেও একটা প্রজেকশন মডেল থাকার দরকার ছিল (হয়তো আছে, আমরা জানি না)। তাহলে আমরা কবে কত উঁচুতে উঠব এবং নামব তা জানতে পারতাম। দৈবচয়িত নমুনায়নের মাধ্যমে একটা র‌্যাপিড টেস্ট বোধহয় জরুরি প্রয়োজন। ডায়াগনস্টিক টেস্ট হিসেবে র‌্যাপিড টেস্টিংয়ের গুরুত্ব না থাকলেও সার্ভিলেন্স জরিপ করার জন্য এছাড়া অন্য কোনো ভারো উপায় নেই।

করোনা সংকটের বিবেচনায় আমাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ খাত হওয়া উচিত স্বাস্থ্যখাত। এই খাতেই এ বছর আমাদের সবচেয়ে বেশি সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। যদিও অর্থ লোপাটের সক্ষমতা থাকলেও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন বর্তমান প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যখাতকে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে না। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অথচ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েই এই বেসরকারি খাত ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।

নোয়াম চমস্কি যেমনটি বলেছেন, ‘...নয়া উদারবাদী মতবাদ মনে করে বেসরকারি শক্তি নিয়ন্ত্রিত দুনিয়ায় সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ... কিন্তু ধনী ও কর্পোরেট দুনিয়া আক্রান্ত হলে উদ্ধারের জন্য সরকারকেই হস্তক্ষেপ করতে হবে।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাজ্যে দ্রুত ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) প্রতিষ্ঠা করা হয়। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের দূরদর্শী প্রতিষ্ঠাতা Aneurin Bevan যে দর্শনের ওপর জোর দিয়েছিলেন তা হচ্ছে, ‘the essence of a satisfactory health service is that the rich and the poor are treated alike, that poverty is not a disability, and wealth is not advantaged’।

করোনা সম্পত্তি গ্রাহ্য করে না। সম্পদশালীরাও করোনায় মারা যাচ্ছেন। চট্টগ্রামের উদাহরণ দিয়েই বলছি চট্টগ্রামে কয়েক শত পরিবার আছে যাদের সম্পত্তির পরিমাণ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ ১২ মাজারের শহর চট্টগ্রামে হাসপাতালে ভেন্টিলেটরসহ আইসিইউ বেড আছে মাত্র দশটি। বড়লোকেরা ভেবেছিল অসুস্থ হলেই উড়ে সিঙ্গাপুর ব্যাংকক চলে যাবেন। চট্টগ্রামে আইসিইউ দিয়ে কী হবে?

চট্টগ্রামের বড়লোকেরা একটার পর একটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মাজার প্রতিষ্ঠা করেছেন তথাকথিত দান খয়রাতের টাকায় (যার মধ্যে কর ও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে জমানো টাকা এবং ব্যাংক ঋণের টাকা, যা কোনোদিন ফেরত দেবেন না এমন টাকাও আছে)। মাজারগুলোতে ওরসের সময় গরু জবাই কতটা হালালভাবে হয়েছে তার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা হয় (যেমন গরু জবাইকারীর বস্ত্র টাখনুর উপরে ছিল কিনা)। গরু ক্রয়ের টাকা হালাল কিনা বা ট্যাক্স এবং শুল্ক ঠিকমতো পরিশোধ করা সাদা টাকা কিনা এগুলো জিজ্ঞেস করা হয় না।

এবার অন্তত চট্টগ্রামের বড়লোকদের শিক্ষা হয়েছে। পরকালের সওয়াবের জন্য দান খয়রাত করা ভালো কিন্তু নিজে বাঁচার জন্য হলেও কিছু ভেন্টিলেটরযুক্ত আইসিইউ প্রতিষ্ঠা করা তার চেয়েও ভালো। মাজারে দান করার চেয়ে এখানে দান করলে সওয়াব বেশি বৈ কম হবে না। শুনেছি চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ধনী পরিবারটি তাদের এক সদস্যকে হারানোর পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে কয়েকটি আইসিইউ প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন।

তবে ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে বিপদে না পড়েও অনেকে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। যেমন অনেক আগেই ফেনীতে সদর হাসপাতালে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচ বেডের একটি আইসিইউ প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন জনৈক আলাউদ্দিন নাসিম। ধনী ব্যক্তিদের মাজারে মাজারে ঘুরে দ্রুত সওয়াবের সরাসরি রাস্তা থেকে বেরিয়ে এসে মানবসেবার রাস্তায় সওয়াব অর্জনের চেষ্টা শুরু করার এটাই সময়।

লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/বিএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।