বিপদে দুজন ‘মানুষ’ : চায় না কিছু গান ছাড়া

মনজুরুল আহসান বুলবুল
মনজুরুল আহসান বুলবুল মনজুরুল আহসান বুলবুল , সিনিয়র সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৮:৩৫ পিএম, ৩০ মে ২০২০

‘একজন ‘মানুষ’ দেখেছিলাম’- বাউল শাহ আব্দুল করিমের সাথে সাক্ষাৎ শেষে বলেছিলেন, লোকসঙ্গীত বিশারদ, শিল্পী কালিকা প্রসাদ। তাঁর উচ্চারণে তিনি ’মানুষ’ শব্দটার প্রতি যে জোর দিয়েছিলেন সেটা লিখে প্রকাশ করা যায় না। শোনার ব্যাপার এবং কর্ণে ধারণ করার বিষয়।

এই করোনাকালে বিভিন্ন মাধ্যমে এই রকম দুজন মানুষের আর্তনাদ ভেসে বেড়াচ্ছে। দুজনের সাথেই কথা বলি। তাদের জীবন বিপন্ন। একজনের জীবন বিবর্ণ, কারণ করোনা কেড়ে নিয়েছে সারা পৃথিবীর রং। তিনি হাটবাজারে পুরো পরিবার নিয়ে গান গেয়ে ফিরতেন। কিন্তু করোনায় নিভৃতবাসী জনজীবন তাঁকে বেকার করে ফেলেছে। জীবনটুকু আছে কিন্তু জীবিকার ব্যবস্থা না থাকায় সে জীবনও যায় যায়। আরেকজন বাউলের জীবন আক্রান্ত ‘মনুষ্য’ করোনায়। তার বাড়ি, গান গাওয়ার যন্ত্র আর প্রিয় গানের খাতা পুড়ে ছাই।

১.
আমার প্রথম ‘মানুষ’ অন্ধ বয়াতি ফজলু। তাঁর আর্তনাদটুকু শুনুন: আমিতো লাজে মরি/ কী যে করি, গলায় দড়ি দিয়া/ বিপদে পইড়াছি বড়; বাউলা গান শিখিয়া/ ভেবেছিলাম গানের জগৎ খুবই একটা ভালো/ গান করিবো বাউল হবো; জ্বালবো জ্ঞানের আলো/ দেখলাম গানে গিয়া; বাউল হইয়া/ কপাল বড় পোড়া / এই গান গাইয়া বেড়াই হাটবাজার জুড়িয়া/ আরে সাধু মহৎ বাউল ছিল; যত জ্ঞানীগুণী/ পালাইয়া গেছে তারা, গানে নামছে খুনি/ ওরা গায়ের জোরে, মুরুব্বিরে করে অপমান/ কথায় কথায় তুইলা ধরে/ হাদিস আর কোরান/ আরে গণ্যমান্য নাই আর এখন, উল্টে গেছে ধারা/ চেয়ারে বইয়া পাও দুলাইছে, ছোট গায়ক যারা / ওরা চোখ উল্টাইয়া ঠার দিয়া চলে আরে ঠারে / পোশাকের বাহার দিয়া কত সাজগো মারে/ আমিতো লাজে মরি...।’

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার তেকআনী গ্রামের অন্ধ ফজলু বয়াতি। নিজে অন্ধ তার ওপর দুই প্রতিবন্ধী সন্তানসহ মোট ৭ সদস্যের সংসার এখন আর চলছে না। গ্রাম-গঞ্জের হাটে-ঘাটে গান গেয়ে চলত তাঁর সংসার। কিন্তু সাধারণ ছুটি বা লকডাউনে থেমে গেছে সারাদেশের জীবন। বন্ধ হয়ে গেছে ফজলু বয়াতির বেঁচে থাকার একমাত্র উৎস। নিদারুণ কষ্টে, অর্ধাহারে-অনাহারে দিন যাপন করছেন তিনি ও তার পরিবার।

২৬ মে সকালে কথা বলি ফজলু বয়াতির সাথে। ৪৮ বছর বয়সী ফজলু বয়াতি দৃষ্টিশক্তি হারান সাত বছর বয়সে। এক টুকরো জমিতে দুইটা ঘর আছে। আয়ের একমাত্র উৎস গান। সড়কে, হাটে বাজারে গান গেয়ে বেড়ান তিনি, সপরিবারে। তিনি দোতারা বাজান, স্ত্রী হাতে তুলে নিয়েছেন একতারা আর খঞ্জনী, ছোট ছেলেটি বাজায় ঢোল। আর শিশু কন্যাটি করতাল হাতে মিষ্টি গলায় বাবার দোহার। কিন্তু এখন হাটবাজার বন্ধ, নিজের জীবন নিয়েই দৌড়াচ্ছে সবাই, কে আর গান শুনে। আয় বন্ধ। তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, তিনি প্রায় ৫০ ছুঁই ছুঁই, তাঁর আরেক সন্তানও প্রতিবন্ধী। কিন্তু না প্রতিবন্ধী হিসেবে, না বয়স্ক হিসেবে কোনো যোগ্যতাতেই তিনি সরকারে বহুল আলোচিত সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনীতে ঢুকতে পারেননি। কোনো তালিকাতেই তার নাম নেই। সামাজিক মাধ্যমে তাঁর দুর্দশার চিত্র উঠে আসায় কিছু সাময়িক সাহায্য তিনি পেয়েছেন।

শিল্পকলা একাডেমির সাথে কথা বলি। মহাপরিচালক জানান; কিছু সহায়তা পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু ফজলু বয়াতিকে বলি, এ সবইতো সাময়িক। কী ব্যবস্থা করলে তাঁর জন্য স্থায়ী কিছু করা যায়। টেলিফোনে বুঝতে পারি ফজলু বয়াতির মাথা এলেবেলে হয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতেই পারছে না এর জবাব কী হতে পারে। আমিই বলি: এক টুকরো জমি কিনে দিলে আবাদ করে চলতে পারবেন? অথবা একটা ছোট দোকান করতে পারেন, এমন ব্যবস্থা যদি হয়? মিন মিনে গলায় ফজলু বয়াতি বলেন; হ্যাঁ, সে রকম কিছু হলে তো ভালোই হয়। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি আমাকে বিস্ময়ের পাহাড়ের চূড়ায় ঠেলে দিয়ে বলেন : স্যার, মানুষ কি আর গান শুনবে না? আমি দোতারা নিয়ে আর হাটে মাঠে মানুষকে গান শুনাতে পারবো না? এমন হলে তো আমি মরে যাবো।

টেলিফোনের এ প্রান্তে আমি এক ‘মানুষে’র কণ্ঠস্বর শুনি। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি; প্রকৃত মানুষ বুঝি এমনই হয়। জমি নয়, দোকান নয়, টাকা নয়, গান ছাড়া যে জীবন, যে জীবন দোতারার তারে ছন্দ তুলে না, সে জীবন মানুষের জীবন নয়। অন্ধ ফজলু বয়াতি আমার সামনে দণ্ডায়মান থাকেন এক মহান মানুষ, শিক্ষক ও দার্শনিক হিসেবে। উপরে উদ্ধৃত গানটির দর্শণতত্ত্ব যেকোনো বিদ্যাপিঠের দর্শনচর্চ্চার চাইতেও গভীর ও অন্তর্ভেদী।

২.
শুনুন দ্বিতীয় ‘মানুষ’ রণেশ ঠাকুরের আর্তনাদ। ‘আমার চার দশকের বাদ্যযন্ত্র গানের খাতা-নথিপত্র/ পুড়াইয়া করেছে ছাই/মনের দুঃখ কার কাছে জানাই/ ও ভাই গো ভাই, আমার দোষ কি শুধু গান গাওয়া/না ভাটির দেশে উজান বাওয়া/ কোন দোষেতে শাস্তি পাইলাম/ একবার শুধু জানবার চাই/চোখের সামনে এহেন কাণ্ড/ আমার ঘরবাড়ি হয় লণ্ডভণ্ড/আসমান তলে হইল ঠাঁই/মনের দুঃখ কার কাছে জানাই/গুরু আমার আব্দুল করিম/ বলেছিলেন গানে গানে/ মানুষ ভজো পরম খোঁজ/ সুরেই তারে কাছে আনো/ আজকে তারে স্মরণ করি/ গানের কথা খুঁইজা মরি/ মুখে কোনো ভাষা নাই/ মনের দুঃখ কার কাছে জানাই।’

এই আর্তনাদ বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিমের শিষ্য, বাউল রণেশ ঠাকুরের। তাঁর উজান ধলের বাড়ির বাউল আসর ঘর গভীর রাতে জ্বালিয়ে দিয়েছে ‘মনুষ্যরূপী’ করোনাভাইরাস। প্রায় ৫৫ বছর বয়সী এই বাউল ও তার শিষ্য সামন্তের সকল বাদ্যযন্ত্রই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

একই দিনে ফজলু বয়াতির সাথে কথা শেষে কথা বলি রণেশ ঠাকুরের সাথে। খবর নেই। সিলেটের সাংবাদিক সংগ্রাম দত্ত আর সুনামগঞ্জের সাংবাদিক বিদ্যুৎ সরকারের কাছ থেকে তথ্য নেই। চেষ্টা করি বিস্তারিত জানার। মে মাসের গোড়ার দিকে ঘটনা। বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিমের ছেলে নূর জালাল জানান, রাত প্রায় দেড়টায় চিৎকার শুনে তিনি এগিয়ে গিয়ে দেখেন, বাউল রণেশ ঠাকুরের আসর ঘরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সকলের চেষ্টায় আগুন নেভালেও, রণেশ ঠাকুরের প্রায় চল্লিশ বছরের সাধনার সকল যন্ত্রপাতি, গানের বই-পত্র পুড়ে ছাই হয়েছে। তরুণ দোলন চৌধুরী বলেন, ঢোল, ছইট্টা, দোতরা, বেহালা, হারমোনিয়ামসহ নানা যন্ত্র। যা কয়েক যুগে বানিয়ে ছিলেন রণেশ ঠাকুরের পরিবার। সবই পুড়ে ছাই হয়েছে। পুলিশ একজনকে ধরেছে। প্রশাসন কিছু সহায়তা দিয়েছে।

রনেশ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করি : তিনি কাকে সন্দেহ করেন। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি হতভম্ব। বলেন: আমারতো কোনো শত্রু নাই। বলি, কোন সাম্প্রদায়িক বিষয়? তিনি তারস্বরে না না করে বলেন, এটা কী বলেন আপনি। আমাদের এলাকায় এই রকম আমরা চিন্তাও করি না। আমরা হিন্দু-মুসলমান এক সাথে বাউলা গান গাই। বলি, তা হলে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ? না, দৃঢ়ভাবে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। এলাকাবাসী নানা ব্যাখ্যা দেন কিন্তু কোনো শত্রুই খুঁজে পান না রণেশ ঠাকুর। কারো বিরুদ্ধে তাঁর কোনো অভিযোগ নাই।

জানতে চাই রণেশ ঠাকুরের কাছে: আমরা তাঁর জন্য কী করতে পারি। তিনি জানান : ঘর তোলার ব্যবস্থা হচ্ছে, বেঁচে থাকার জন্য কিছু সাহায্যও কিছু পাওয়া গেছে। পুলিশ একজনকে ধরেছে, হয়তো জানাও যাবে কে বা কারা কী জন্য এই অপকর্মটি করেছে। কিন্তু তার হাহাকার; ৪০ বছর ধরে তিনি তিল তিলে যে যন্ত্রপাতিগুলোর সংগ্রহ গড়ে তুলেছিলেন বাকি জীবনে তাকি আর পূরণ করা সম্ভব হবে?

রণেশ ঠাকুর আমার মন্তব্যের জন্য অপেক্ষা না করে আমার দিকে ছুঁড়ে দেন তাঁর আকাশছোঁয়া আর্তনাদ। বিশ্বাস করুন, কানে না শুনে লিখে সেই আর্তচিৎকার প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই। রণেশ ঠাকুর আমার কাছে জানতে চান : আমার গানের খাতাটির কী হবে? আমি মূর্খ মানুষ। নানা সময়ে যে গানগুলো ‘বানছি’ এরে তারে দিয়ে তা’ লিখে রেখেছিলাম একটি খাতায়। শতাধিক গানের মধ্যে কিছু গান আমার মুখস্থ কিন্তু আমার বাকি গানগুলো আমি কই পাইয়াম, গানের খাতার লগে লগে আমিইতো পুইড়া ছাই অইয়া গেলাম। বাকশূন্য আমি। নতুন ঘর নয়, আর্থিক সহায়তা নয়, কারো শাস্তির দাবি নয়। শুধুই গানের খাতাটি!! আমরা যারা নিজেদের মানুষ দাবি করি, নিঃস্ব হওয়ার আর্ত চিৎকার শুনে একজন ‘মানুষ’ রণেশ ঠাকুরের কাছে নিজেদের অতি বামন মনে হয়।

৩.
কানে এসে লাগে শাহ আবদুল করিমের কণ্ঠস্বর : ‘... আসবে কি আর শুভ দিন/ জল ছাড়া কি বাঁচিবে মীন/ ডুবলে কি ভাসে মরা/ আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া..।’ কালিকা প্রসাদ যেমন শাহ আবদুল করিমকে দেখে একজন ‘মানুষ’ দেখার তৃপ্তি পেয়েছিলেন। আমিও ফজলু বয়াতী আর রণেশ ঠাকুরে সাথে কথা বলে তেমনি ’মানুষ’ দেখার তৃপ্তিতে উদ্বেলিত। এরাও শাহ আব্দুল করিমের মতই, চায়না কিছু গান ছাড়া ।

৪.
করোনা আক্রান্ত এই অন্যরকম পৃথিবীতে প্রশ্ন জাগে : এই পৃথিবী কি ফজলু বয়াতি আর রণেশ ঠাকুরের মতো মানুষের পৃথিবী হবে? আশঙ্কা হয়। ফজলু বয়াইত যখন আক্ষেপ করে বলেন: ‘আরে সাধু মহৎ বাউল ছিল যত জ্ঞানী গুণী/ পালাইয়া গেছে তারা, গানে নামছে খুনি/ ওরা গায়ের জোরে মুরুব্বিরে করে অপমান/ কথায় কথায় তুইলা ধরে/ হাদিস আর কোরান’।

এই গানের পৃথিবী তাহলে কি অই খুনিদের দাপটের কাছেই পরাস্ত হবে? অথবা রণেশ ঠাকুরের প্রশ্ন কি জবাবহীনই থাকবে : ‘আমার দোষ কি শুধু গান গাওয়া/ না ভাটির দেশে উজান বাওয়া/ কোন দোষেতে শাস্তি পাইলাম/ একবার শুধু জানবার চাই।’ ভাটির দেশে উজান বাওয়ার আপরাধেই কি পুড়ে শেষ হয়ে যাবে রণেশ ঠাকুরের গানের খাতা, যন্ত্রপাতি?

নির্মোহ বাউল শাহ আব্দুল করিম বলেছিলেন: ‘এই পৃথিবী একদিন বাউলের পৃথিবী হয়ে যাবে’। কালিকা বলছেন: তাঁর এই বিশ্বাসের ভিত এতটা শক্ত এ কারণে যে, তিনি ‘মানুষ’ ছিলেন, যে মানুষ আমরা সচরাচর দেখতে পাই না।

ফজলু বয়াতি আর রণেশ ঠাকুর আমাদের সময়ের সেই ‘মানুষ’। আসুন আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াই, মানুষের সহযাত্রী হই।

লেখক : এডিটর ইন চিফ, টিভি টুডে

এইচআর/বিএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।