করোনায়ও নেশার দাপট!

মীর আব্দুল আলীম
মীর আব্দুল আলীম মীর আব্দুল আলীম , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:১৫ এএম, ২৮ মে ২০২০

করোনা সংকটে প্রয়োজন ছাড়া ঘরেই থাকার কথা কিন্তু মানুষ ঘরে থাকছে না। অপ্রয়োজনেও ঘর থেকে বের হয়ে আড্ডা দিচ্ছে; যত্রতত্র ঘোরাফেরা করছে অসাবধানী মানুষ। এমনকি নেশার টেবিলও জমছে বেশ। এ অবস্থায় বিষাক্ত নেশা সেবনে মানুষ মরছে। রংপুরে মদ্যপানে ঈদ উদযাপন করতে গিয়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ রয়েছেন আরও ৪ জন। পত্রিকান্তে জানা যায়, রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় এ ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের তথ্যমতে, মদপানে অসুস্থ ও মারা যাওয়া ব্যক্তিরা সংঘবদ্ধ দল। প্রায়ই তারা মদের আসর বসাতেন। ঈদের দিন মদপানের পর বিষক্রিয়ায় তাদের মৃত্যু হয়।

করোনাভাইরাসও নেশাগ্রস্তদের দমাতে পারেনি। অনেক ব্যবসা থমকে গেলেও মাদক ব্যবসায়ীরা যে সক্রিয় তা বলার অপেক্ষে রাখে না। ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন আর মদ্যপান করে মানুষ কেবল অসুস্থ আর বিকারগ্রস্ত হচ্ছে না, ঘটছে মানুষের জীবনহানিও। বিষাক্ত মদ্যপানে মানুষের মৃত্যুর খবর আমরা প্রায়শই পাচ্ছি। আবার নেশাগ্রস্তরা নেশার ঘোরে মানুষ হত্যা করছে। মাদকের নেশায় এদেশের হাজার হাজার পরিবার আজ পথে বসেছে।

মাদক আর মাদকাসক্ত মানুষ আমাদের সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছে। এদের কর্মকাণ্ডে আমরা; আমাদের দেশ প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাদকের মূলোৎপাটন করতে হবে। গডফাদারদের ধরে আইনের আওতায় আনতে হবে। মাদক শুধু একজন ব্যক্তি কিংবা একটি পরিবারের জন্যই অভিশাপ বয়ে আনে না, দেশ-জাতির জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনছে। নানারকম প্রাণঘাতী রোগব্যাধি বিস্তারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খারাপ করে তুলছে।

দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় দেশের অভ্যন্তরে মাদকের বিকিকিনি এবং বিভিন্ন সীমান্তপথে দেশের অভ্যন্তরে মাদকের অনুপ্রবেশ নিয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন সময়ে পুলিশি অভিযানে মাদকদ্রব্য আটক ও জড়িতদের আটকের কথা শোনা গেলেও মাদক ব্যবসার নেপথ্যে থাকা গডফাদারদের আটক করা হয়েছে কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে এমন কথা শোনা যায় না। ফলে মাদকবিরোধী নানা অভিযানের কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারও নতুন করে মাদক ব্যবসার প্রসার ঘটে।

মাদক ব্যবসায়ীদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে তরুণ সমাজ। দেশের তরুণ সমাজ মাদকের ভয়াবহ প্রভাবে বিপথগামী হচ্ছে। মাদকের নীল ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের আগামী প্রজন্ম। যা একটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার প্রকট রূপের পেছনে মাদক অন্যতম বড় একটি উপসর্গ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মতো উদ্বেগজনক ঘটনা আর কী হতে পারে?

২০১৭ এর শেষের দিকে, লায়ন্স ক্লাবের বাংলাদেশ দলের সাথে মিয়ানমার সফরের অভিজ্ঞতা আমাকে বেশ ব্যথিত করে। বাংলাদেশ ঘেঁষা সীমান্তে মিয়ানমারে অসংখ্য ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। সেসব কারখানায় কোটি কোটি পিস ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। অবাক করা কথা, মিয়ানমারের মানুষ, সেখানকার যুবসমাজ খুব একটা ইয়াবা আসক্ত নয়। কোনো কোনো এলাকায় তো ইয়াবা কী- অধিবাসীরা জানেনই না। মূলত বাংলাদেশিদের জন্যই সেখানে ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। যতদূর জানতে পারি, তাতে নাকি এ ব্যাপারে সে দেশের সরকারের মৌনসম্মতিও আছে।

মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা কারখানার কথা আমরা জানি, আমাদের সরকারও জানে, কিন্তু ইয়াবা চোরাচালান রোধ হচ্ছে না। মাদক কারবারিরা ধরাও পড়ছে মাঝে-মধ্যে। ভারতের সীমান্তেও অসংখ্য ফেনসিডিলের কারখানা আছে। সেখানেও এই একই অবস্থা। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো আমাদেরও দেশে মাদকের বাজার তৈরি করে নিয়েছে। এ জন্যই হয়তো দেশ মাদকে সয়লাব হচ্ছে।

মাদক সেবনের কুফল সম্পর্কে মহাসমারোহে আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। বিভিন্ন এনজিও মাদক সেবন নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। মাদকপাচার, বহন ও ব্যবহারের বিভিন্ন শাস্তি রয়েছে। তবু মাদক ব্যবহার কমেনি। ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, প্যাথেডিনের ব্যবসা রমরমা। নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণির মধ্যে মাদক সেবন প্রবণতা বাড়ছে। এমনকি কুকুর মারার ইনজেকশন সেবন করছে মাদকসেবীরা।

এ ব্যাপারে প্রশাসন নির্বিকার। তবে মাদক বিক্রেতাদের যে পুলিশ একেবারেই ধরছে না, তা নয়। মাঝে মাঝে মাদকসহ দুই-চারজনকে গ্রেফতার করা হলেও মাদক বিক্রেতারা আইনের ফাঁক-ফোকরে আবারও জেল থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় ব্যবসা পরিচালনা করছে।

মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন শুধু নগর-মহানগরেই সীমাবদ্ধ নেই, গ্রামবাংলা পর্যন্ত মাদক এখন সহজলভ্য। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মাদক। তবে মাঝে-মধ্যে মাদকদ্রব্য বহনের দায়ে কেউ কেউ ধরা পড়লেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে। দৃশ্যের আড়ালে এই যে অদৃশ্য মহাশক্তিধর চক্রটির জন্যই মাদকের ক্রমবিস্তার রোধ হয়ে উঠেছে অসম্ভব।

আমরা মনে করি মাদক সংশ্লিষ্ট চুনোপুঁটি থেকে রাঘব-বোয়াল পর্যন্ত প্রত্যেকের ব্যাপারেই আইন প্রয়োগে কঠোরতা দেখাতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগই মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধে সহায়ক হতে পারে।

একটি প্রজন্ম ধ্বংস হওয়ার আগে আমাদের সবার দায়িত্ব হবে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করা। আমরা বিশ্বাস করি রাষ্ট্রের কাছে মাদক সিন্ডিকেট মোটেও শক্তিশালী নয়। রাষ্ট্র চাইলে দেশের মাদক প্রসারতা কমবে। আর রাষ্ট্র তা সহসাই করবে এ প্রত্যাশা রইলো।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক

এইচআর/বিএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।