ধর্ম যার যার, উৎসব সবার
এবার ঈদ উদযাপন হচ্ছে এক ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশে। করোনা নামক ভয়াবহ মারণব্যাধির কারণে মানুষের জীবন থেকে শান্তি ও স্বস্তি দূর হয়েছে। বেঁচে থাকা নিয়েই দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। আবার দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন লোকের সংখ্যাও বেড়েছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও বিদ্বেষ বেড়েছে। এই সংকটকালেও ধর্ম নিয়ে উদারতার অভাবও লক্ষ করা যাচ্ছে।
আমাদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পাকিস্তানে। আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি পাকিস্তানে। আর এটাও আমাদের সবার জানা যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ছিল সাম্প্রদায়িক। দ্বিজাতি তত্ত্ব ছিল পাকিস্তানের ভিত্তি। হিন্দুর জন্য আলাদা রাষ্ট্র, মুসলমানের জন্য আলাদা রাষ্ট্র। এই চরম সাম্প্রদায়িক ব্যবস্থাটি তখনকার রাজনীতির কারবারিরা মেনে নিয়েছিলেন। ভারতবর্ষ থেকে বৃটিশ তাড়ানোর আন্দোলন পরিণতি পেয়েছিল দেশভাগের মধ্য দিয়ে। ভাবা হয়েছিল, এভাবে ধর্মভিত্তিক দুইটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হলে শান্তি আসবে, স্বস্তি আসবে, আসবে দুই ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের জীবনে সমৃদ্ধি। হিন্দুর জন্য ভারত, মুসলমানের জন্য পাকিস্তান। দেশভাগের পর দেখা গেল চিত্র ভিন্ন হয়েছে। পাকিস্তানে হিন্দু থাকলো, ভারতে মুসলমান। দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে, রক্ত, অশ্রু, বেদনা-বিচ্ছেদের সকরুণ অসংখ্য কাহিনী তৈরি করেও ভারতকে মুসলমানমুক্ত করা যায়নি, পাকিস্তানকেও হিন্দুমুক্ত। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলো, এবং দুই দেশের রাজনীতিতেই সাম্প্রদায়িকতা স্থায়ীভাবে জায়গা পেয়ে গেল। যদিও ভারত রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধর্ম নয়, ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করলো আর পাকিস্তান থাকলো ধর্ম নিয়েই। ধর্ম মানে ইসলাম ধর্ম।
হিন্দুরা পাকিস্তানে থাকলো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে। তাদের মর্যাদা এবং অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল। তারপরও নিরুপায় বিপুল সংখ্যক হিন্দু জনগোষ্ঠী পাকিস্তানে থেকে যায়। যেমন আমরা ছিলাম। কেমন দেখেছিলাম আমাদের মুসলমান প্রতিবেশী , এলাকাবাসী এবং বন্ধুদের? বলতে দ্বিধা নেই, আমরা যে তখন খুব অনিরাপদ বোধ করেছি কিংবা কথায় কথায় আমাদের সম্মানহানির ঘটনা ঘটতো তা কিন্তু নয়। মুসলমান বন্ধুদের সঙ্গে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব নিয়েই আমরা থেকেছি, চলেছি। ‘মালাউন' শব্দটি তখন খুব শুনেছি বলেও মনে পড়ে না। পূজার সময় মুসলমান বন্ধুদের যেমন পাশে পেয়েছি, ঈদেও আমরা তাদের সঙ্গে থেকেছি। নামাজ পড়তাম না কিন্তু ঈদ জামাতের কাছে উপস্থিত থাকতাম। নামাজ শেষে কোলাকুলি করতাম। মুসলিম বন্ধুদের সঙ্গে তাদের বাসায় গিয়ে সেমাই-পোলাও খেতাম। মুসলিম বন্ধুরাও মন্দিরে গিয়ে পূজা-প্রার্থনায় অংশ না নিয়েও উপস্থিত থেকে আমাদের উৎসাহিত করতো, প্রসাদ গ্রহণে দ্বিধা করতো না। উৎসবগুলো মূলত ধর্মীয় হলেও তাতে সম্প্রীতির খুব ঘাটতি ছিল না।
বিশেষভাবে বলার মতো কথা হলো তখন ঈদুল আজহায় এত গরু কোরবানি দিতে দেখিনি। দু-চারটা যা গরু কোরবানি হতো তা একটি নির্দিষ্ট জায়গায়, একটু বিরল বসতি দেখে। ফলে কোরবানির ঈদেও আমাদের খুব অস্বস্তিতে পড়তে হতো না। অর্থাৎ পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ধর্মভিত্তিক কৃত্রিম হলেও মানুষে মানুষে সম্পর্কটা অকৃত্রিমই ছিল।
দুই.
এখন পরিস্থিতি দেখি ভিন্ন। গরুকে যে অধিকাংশ হিন্দু জবাইঅযোগ্য মনে করে- এটা জেনেও কোরবানি দেয়ার বেলায় হিন্দুদের অসুবিধার দিকটি একটুও বিবেচনা করা হয় না। সম্প্রীতির স্বার্থে হিন্দুদের সবকিছু মেনে নিতে হয়। আজানের সময় মন্দিরে শব্দ করা যাবে না, কিন্তু পূজার সময় মাইকে আজান প্রচার বন্ধ থাকবে না। এভাবে মেনে নেয়া এবং মানিয়ে নেয়ার নামই এখন সম্প্রীতি। সাম্প্রতিক সময়ে একটি স্লোগান জনপ্রিয় হয়েছে সংখ্যালঘুদের মধ্যে- ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার‘। ধর্ম তো যার যার ঠিক আছে, কিন্তু রাষ্ট্র কি সবার সমান সমান অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে?
সব ধর্মের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সবার সম্মিলিত ত্যাগ, কষ্ট, অশ্রু, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল অসাম্প্রদায়িক পথে। ধর্মনিরপেক্ষতা হয়েছিল অন্যতম রাষ্ট্রনীতি। যারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, অংশ নিয়েছিলেন, তারা ভেবেছিলেন যেহেতু পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে, সেহেতু পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চিন্তাও পরাভূত হয়েছে। এই ভাবনাটি ছিল অতিসরলীকরণ দোষেদুষ্ট। সাম্প্রদায়িকতা মানুষের মনোজগতের ব্যাপার। এর গড়ে ওঠা এবং বেড়ে ওঠা সবসময় দৃশ্যমানও হয় না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া মাত্রই মানুষের মন থেকে পাকিস্তানি মানসিকতা দূর হয়ে গেছে বলে ভাবনাটির মধ্যেই চরম গলদ ছিল। তখন ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে অত উচ্ছ্বাসপ্রবণ না হয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এনিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালানো উচিত ছিল।
ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে এক পক্ষ যখন বাইরে গদগদ ভাব প্রকাশে ব্যস্ত, অন্যপক্ষ, মানে পরাজিত পক্ষ তখন এনিয়ে বিরুদ্ধ-প্রচারণায় বাতাস বিষাক্ত করে চলছিল। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়ে তারা নিজ নিজ এলাকা থেকে গা-ঢাকা দিয়ে অন্য এলাকায় গিয়ে মসজিদ-মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়ে প্রচার চালিয়েছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা হলো ধর্মহীনতা। কিছু কিছু বাস্তব কারণে সাধারণ মানুষ ওই প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়েছে। সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৭৫সালের ১৫ আগস্ট। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গতিপথ বদলে দেওয়া হয়। পেছনে হাঁটা শুরু হয়। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। সামরিক ডিকটেটর এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে বাংলাদেশকে আবার কার্যত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করেন।
তারপর বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা নতুন মাত্রা পেতে থাকে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো ধর্ম নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কেউ নিজেদের ‘ধর্মহীন’ প্রমাণ করতে চায় না। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী ক্ষমতায় থাকলেও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার কেবলই বাড়ছে। আওয়ামী লীগও এখন আর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে না। ধর্ম নিয়ে যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে, যারা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষক, তাদের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ ‘কৌশলগত’ ঐক্য ও সমঝোতার পথেই চলছে। বাংলাদেশ আবার অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে- এটা অনেকটা কষ্টকল্পনা বলে মনে হয়।
তিন.
এবার আসা যাক উৎসব প্রসঙ্গে। উৎসবের আভিধানিক অর্থ- আনন্দানুষ্ঠান, ধুমধাম। অর্থাৎ যে সব আনন্দ আয়োজন ধুমধাম করে করা হয় তাকে আমরা উৎসব বলতে পারি। উৎসবকে আনন্দ ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ বলেই মনে করা হয়। কারো কাছে বা উৎসব হলো ব্যক্তিগত কিংবা জাতিগত আইডেনটিটি বা পরিচয়চিহ্ন। উৎসব বিভিন্ন রকম হয় বা হতে পারে। রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, ঐতিহ্যগত ইত্যাদি ধরনের উৎসবের সঙ্গে আমাদের মোটামুটি পরিচয় আছে। উৎসবের উৎপত্তি মূলত লোক বিশ্বাস এবং ধর্ম বিশ্বাস থেকে। আমাদের দেশে ধর্মীয় বিশ্বাসজনিত উৎসবই ব্যাপকতা লাভ করেছে। ঈদ, পূজা, বড়দিন ইত্যাদি উৎসবের ভিত্তি হলো ধর্মাচার বা ধর্ম। আর পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে বলা যায় ধর্ম বিশ্বাস নির্বিশেষে বাঙালির ঐতিহ্যগত সামাজিক উৎসব। মেলা, খেলাধুলা, নৌকা বাইচ, গান-নাচ, যাত্রা- এসব একই সঙ্গে উৎসব এবং সংস্কৃতি। উৎসবতো আসলে সংস্কৃতিরই অংশ। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে কিছু দিবস আছে যেগুলোর সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নেই। বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস – উৎসবমুখর পরিবেশে এগুলো পালনের সঙ্গে ধর্ম বিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক নেই।
ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে পৌঁছার পথ রচনা করে উৎসব। উৎসবের উদ্দেশ্য হলো সবাইকে এক করা, ভাগ করা নয়। উৎসব সবসময় একটা মিলনের জায়গা তৈরি করে। একা একা উৎসব করা যায় না। উৎসব করতে হলে একত্রিত হতে হয়, মিলিত হতে হয়। উৎসবের সঙ্গে সাজসজ্জা, পোশাক, খাওয়া-দাওয়ার বিষয়গুলো জড়িত। উৎসবস্থলকে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো, নতুন পোশাক পরিধান করা এবং ভালো বা উন্নতমানের খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে কিসের উৎসব ! ধর্মীয় কিংবা সামাজিক- সব উৎসবেই এগুলো দরকার। শুভেচ্ছা কার্ড ও উপহার বিনিময় করাও উৎসবের অনুষঙ্গ। যেকোনো উৎসব আয়োজনই মানুষে মানুষে নৈকট্য বাড়ায়। আর মানুষ যত কাছাকাছি আসে তত তার মধ্যে শুভবোধের উন্মেষ হয়, মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটে। উৎসবের মূল কথা হলো- সংকীর্ণতা পরিহার করতে হবে, উদারতা দেখাতে হবে। উৎসবই প্রকৃতপক্ষে সম্প্রীতির পথ রচনা করে। আমরা কি উৎসবের এই মর্মবাণী উপলব্ধি করে উৎসবে সামিল হই?
চার.
তাহলে সম্প্রীতি বিষয়টি কী? সম্প্রীতি শব্দের আভিধানিক অর্থ- সদ্ভাব, সন্তোষ, আহ্লাদ, প্রণয়, আনন্দ। অর্থাৎ মানুষে মানুষে সদ্ভাব থাকাটাই হলো সম্প্রীতি। এক সময় আমরা সম্প্রীতির পরিবেশে বসবাস করলেও সাম্প্রতিককালে সম্প্রীতিটা একটু কমে এসেছে বলেই মনে হয়। সম্প্রীতি একজনে হয় না, হয় জনে জনে। কোনো সমাজ বিচ্ছিন্ন একক মানুষের সম্প্রীতির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে বসবাস করতে গেলে সম্প্রীতি ছাড়া চলে না। মানুষে মানুষে যোগাযোগ, সংযোগ ছাড়া সম্প্রীতি গড়ে ওঠে না। বর্তমান ভোগবাদী সমাজে আত্মস্বার্থপরতা আমাদের এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে আমরা নিজেকে ছাড়া আর কিছু বুঝি না। আত্মীয়-স্বজন, এমন কি বয়স্ক মা-বাবার ক্ষেত্রেই যেখানে কারো কারো সীমাহীন উদাসীনতা, তখন অন্য মানুষের কাছাকাছি হওয়ার সময়-সুযোগ হয় কি করে ! একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার, মাড়িয়ে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা এখন সর্বত্র। আর এর জন্য একধরনের দূরত্ব মানুষে মানুষে তৈরি হচ্ছে। কবি আসাদ চৌধুরীর একটি কবিতার শিরোনাম ‘সম্প্রীতি পালালো কোথায়‘?
সত্যিতো সম্প্রীতি কোথায় পালালো, কীভাবে এবং কেন পালালো- আমরা কি তা গভীর ভাবে ভেবে দেখেছি?
‘সম্প্রীতি’ নামে মাসুদ খানের একটি সুন্দর ছড়া আছে। এখানে ছড়াটি উদ্ধৃত করছি :
পাঁচটি আঙুল পাঁচ রকমের
পাঁচ প্রকারের কৃতি
পাঁচ ধরনের ধর্ম তাদের
পাঁচটি সংস্কৃতি।
মিলেমিশে ফুটে থাকে
হাতের পাঞ্জাদেশে
কাজের সময় ঐক্যবদ্ধ
ধর্ম নির্বিশেষে।
একটি আঙুল আঘাত পেলে
অন্য আঙুল এগিয়ে যায়
সমদুঃখে সমব্যথায়
দরদভরা হাত বোলায়।
হোক না আঙুল নানা রকম
কেউ পিছে কেউ আগে
ভাতটা খেতে গেলে কিন্তু
পাঁচ আঙুলই লাগে।
পাঁচ.
সংখ্যা দিয়ে, ধর্ম দিয়ে যখন মানুষকে বিবেচনা করা হয়, তখন স্বাভাবিক নিয়মেই মানবিকতাটা গৌন হয়ে পড়ে। আধুনিক গণতন্ত্র সংখ্যাধিক্যের বিষয়টিকে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে যে সংখ্যায় একজন বেশি হলেই আধিপত্য করার সুযোগ তৈরি হয়। আজ সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু নিয়ে পৃথিবী জোড়া যে সংকট তা কি গণতন্ত্রের একটি কুফল? ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েও আজকাল বড় ধরনের লড়াই শুরু হয়েছে। ফলে ধর্ম এখন শান্তি ও মিলনের উৎস না হয়ে অশান্তি ও বিভেদের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যে দেশে যে ধর্মানুসারীরা সংখ্যায় বেশি সে দেশে তারা সংখ্যালঘুদের পীড়ন করাকে এক রকম অধিকার হিসেবে দেখছে। এর সঙ্গে আবার আছে রাজনীতি, রাজনৈতিক কূটনীতি। মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখার কারণেই সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে। অন্য দেশের কথা বাদ থাক, আমরা বাংলাদেশেই আমাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখি।
আমাদের দেশে কি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ বিরাজ করছে? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে যা বোঝায় তা হয়নি বা হয় না। রক্তাক্ত ভায়োলেন্স না হলেও এখানে এক প্রকার নীরব সন্ত্রাস সব সময় চলে আসছে। এখানে সংখ্যালঘুরা পলায়ণপর মানসিকতার কারণে পাল্টা আক্রমণ করতে পারে না। সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার সংখ্যালঘুদের দিন দিনই সংকুচিত হয়ে আসছে। সংখ্যালঘুদের ওপর নানা ধরনের জুলুম – অত্যাচার ঘটছে। কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের জমি-জমা, সম্পদ,ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি হামলার শিকার হচ্ছে, কখনো কখনো বেদখল হয়ে যাচ্ছে। উপাসনালয়ে আক্রমণ, প্রতিমা ভাঙচুর নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিন্দু নারীরা ধর্ষণের শিকার হলে ভয়ভীতি দেখিয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়া থেকেও বিরত রাখা হয়। দেশে হিন্দু জনসংখ্যা ক্রমাগত কমছে। অনিরাপদ জীবন ছেড়ে তারা অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়াচ্ছেন।
ছয়.
দায়িত্ববান ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে অনেক সময় পরামর্শ দিয়ে বলা হয় : আপনারা নিজেদের সংখ্যালঘু ভাববেন না। আপনারা এদেশের নাগরিক। এ ধরনের কথা শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু বাস্তবে নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা পাওয়া যে কি কঠিন এটা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। হিন্দু বা অন্য সংখ্যাল্প জনগোষ্ঠীর মানুষদের সব সময় মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, এদেশে তার সমান অধিকার নেই। তার জন্য আছে কোটা বা বিশেষ বিবেচনা। এটা একজন মানুষের জন্য কত অসম্মানের তা বুঝতে পারলে সম্প্রীতির পরিবেশ হারিয়ে যেত না। ক্রিকেট দলের একজন সৌম্য সরকার খারাপ খেললে দোষ হয় তার ধর্ম বা ধর্ম বিশ্বাসের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা হয়। এত গ্লানি নিয়ে মাঠে নেমে তার ওপর যে চাপ তৈরি হয়, সেটা তাকে মানসিক ভাবে কতটা দুর্বল করে দেয়, সেটা বোঝার চেষ্টা করা হয় না। অথচ আরবি নামের কেউ খারাপ খেললে তার ধর্ম নিয়ে কোনো কথা হয় না।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্রধান বিচারপতি পদে একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ নিযুক্ত হয়েছিলেন। নিশ্চয়ই তাকে ওই পদে দেওয়া হয়েছিল তার যোগ্যতা বিবেচনা করেই। তার নাম সুরেন্দ্র কুমার সিনহা – এজন্য নিশ্চয়ই তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়নি। কিন্তু যেই তার একটি রায় নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, অমনি তার ধর্ম সামনে চলে আসলো । তারপর তো কতকিছু হয়ে গেল। তিনি বিতাড়িত হলেন। কিন্তু একজন মুসলমান প্রধান বিচারপতি সরকারের পছন্দের বাইরে গেলে কি তার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কথা উঠতো?
সাত.
হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ একদিনে তৈরি হয়নি, একটি ঘটনা থেকেও তৈরি হয়নি। এর পটভূমি ও প্রেক্ষাপট রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন : ‘আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু – মুসলমানে বসে না – ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়’। আবার ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন : হিন্দু - মুসলমানের পার্থক্যটা আমাদের সমাজে আমরা এতই কুশ্রীভাবে বেআব্রু করিয়া রাখিয়াছি যে, কিছুকাল পূর্বে স্বদেশী অভিযানলর দিনে একজন হিন্দু স্বদেশীপ্রচারক এক গ্লাস জল খাইবেন বলিয়া তাঁহার মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া হইতে নামিয়া যাইতে বলিতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করেন নাই।‘
এ সব ধরা-ছোঁয়ার বিষয় এখন আর নেই। কিন্তু পূর্ব পুরুষের মুখে শোনা গল্প এখন নতুন করে বিশ্বাসের মূলে নাড়া দিচ্ছে না, কি করে অস্বীকার করি?
১৯১১ সালের অক্টোবর মাসে এক বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন : ‘হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সকল দিক দিয়া একটা সত্যকার ঐক্য জন্মে নাই বলিয়াই রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে এক করিয়া তুলিবার চেষ্টায় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সূত্রপাত হইল। এই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমরা মুসলমামকে যখন আহ্বান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজ উদ্ধারের সহায় বলিয়া ডাকিয়াছি, আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে কাজের জন্য আর দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পিছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না – মুসলমান এই সন্দেহটি মনে লইয়া আমাদের ডাকে সাড়া দেয় নাই। আমরা দুই পক্ষ একত্র থাকিলে মোটের উপর লাভের অঙ্ক বেশি হইবে বটে, কিন্তু লাভের অংশ তাহার পক্ষে বেশি হইবে কি না, মুসলমানের সেইটেই বিবেচ্য । অতএব মুসলমানের কথা বলা অসঙ্গত নহে যে আমি যদি পৃথক থাকিয়াই বড় হইতে পারি তবেই তাহাতে আমার লাভ’।
মুসলমানরা যে হিন্দুদের পাশাপাশি থেকেও ক্রমে পৃথক হয়ে গেল তার দায় কি তৎকালীন হিন্দু সমাজপতি ও রাজনৈতিক নেতারদের ওপর চাপানো যায় না? পশ্চিমবঙ্গের গবেষক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখছেন : ‘আজও পশ্চিমবঙ্গে প্রচারের ধারাটা এমন যে মুসলমানরা পাকিস্তান চাইল বলেই দেশ ভাগ হয়ে গেল। তাদের জানা থাকে না যে, পাকিস্তানের আগে মুসলমানরা চেয়েছিলেন মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। সে অধিকার স্বীকার করা হয়নি বলেই, ওঠে পাকিস্তানের দাবি।‘
মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার নিশ্চিত না হলে মানুষ ‘আলাদা'বোধ করবেই। যেটা এখন বাংলাদেশের হিন্দুরা করছে।
আট.
ধর্ম নিয়ে আজকাল এক ধরনের উন্মাদনা শুরু হয়েছে। মানুষ নিধন করা হচ্ছে ধর্মের নামে। যা মানুষকে বিবেকহীন, মানবিক বোধহীন করে তোলে তাকে কি ধর্ম বলা চলে? ‘আত্মপরিচয় ‘ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন : ‘সকল মানুষেরই আপন ধর্ম বলে একটা জিনিস আছে। কিন্তু সেইটেকেই সে স্পষ্ট করে জানে না। সে জানে আমি খৃস্টান, আমি মুসলমান, আমি বৈষ্ণব, আমি শাক্ত ইত্যাদি। কিন্তু সে নিজেকে যে ধর্মাবলম্বী বলে জন্মকাল থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত নিশ্চিত আছে সে হয়তো সত্য তা নয় - --যেটা বাইরে থেকে দেখা যায় সেটা আমার সাম্প্রদায়িক ধর্ম। সেই সাধারণ পরিচয়েই লোকসমাজে আমার ধর্মগত পরিচয়। সেটা যেন আমার মাথার উপরকার পাগড়ি’।
রবীন্দ্রনাথের মতে, মানুষের সত্যিকারের ধর্ম হলো : ‘মাথার ভিতরকার মগজ, যেটা অদৃশ্য, যে পরিচয়টি আমার অন্তর্যামীর কাছে ব্যক্ত’।
ভেতরের মগজটাকে ব্যবহার না করে আমরা যত দিন মাথার ওপরটা নিয়ে হৈচৈ-এ মত্ত থাকবো তত দিন আমরা প্রকৃত সম্প্রীতি আমাদের মধ্যে আর ফিরিয়ে আনতে পারবো কি?
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এইচআর/বিএ/পিআর