বাঙালির মহাকাশ বিজয়
বাঙালির মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন পূরণের দিন ১২ মে। ২০১৮ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হলো দেশের প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই ঘটনাটি ঘটেছিল বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৫ মিনিটে। বিশ্বে স্পেস সোসাইটিতে ৫৭তম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশ হিসেবে লিপিবদ্ধ হলো বাংলাদেশের নাম। দেশের সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের সরাসরি সম্প্রচার প্রত্যক্ষ করতে মধ্যরাতের পরও সজাগ থেকে সেদিন, এই ঐতিহাসিক ক্ষণটির জন্য শ্বাসরুদ্ধকর প্রতীক্ষার প্রহর গুণছিলেন।
অবশেষে জাতির চিরস্মৃতি জাগানিয়া সেই মাহেন্দ্র লগ্নটি এলো ভিডিও বার্তায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের স্বপ্নমানবী প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনী ঘোষণার পর কাউন্টডাউন শেষে উৎক্ষেপণ মঞ্চ থেকে স্পেসএক্সের সর্বাধুনিক রকেট ফ্যালকন-৯ এর কক্ষপথের উদ্দেশে স্বপ্ন জয়ের যাত্রা শুরু হলো। এই যাত্রা বাঙালির মহাবিজয়ের যাত্রা-মহাকাশ বিজয় যাত্রা। টিভির পর্দার সামনে আনন্দ-উল্লাসে উদ্ভাসিত দেশের মানুষ। সেদিন বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম ও আমেরিকার সিএনএনসহ বিদেশি সম্প্রচার মাধ্যমগুলোতে গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হলো বাঙালির মহাকাশ বিজয়ের এই গল্প।
এর আগে বাংলাদেশ সময় ১১ মে রাত ৩টা ৪৭ মিনিটে বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুতি চূড়ান্ত ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে থমকে যায় ঘড়ির কাঁটা। স্টার্টআপ মোড শুরু হওয়ার সময় কারিগরি ত্রুটির কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। জানানো হয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ওইদিন আর উড়ছে না। স্যাটেলাইটটি ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ইরমার কারণে উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হয়েছিল।
ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে টেলিযোগাযোগ বিভাগের তৎকালীন সচিব শ্যামসুন্দর শিকদার, বিটিআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ এবং প্রকল্প পরিচালক মেসবাহউদ্দিনসহ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের একটি প্রতিনিধিদল এবং সাবেক টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম ও আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক উপস্থিত থেকে মহাকাশ বিজয়ের ঐতিহাসিক ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেন। ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যযোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী হিসেবে কেনেডি স্পেস সেন্টারে আমার উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও সেদিন আমি দেশের উৎসুক মানুষের সাথে মহাকাশ বিজয়ের উল্লাস প্রত্যক্ষ করার লোভ সংবরণ করতে পারিনি বলে যুক্তরাষ্ট্রে আমার যাওয়া হয়নি।
পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই ঢাকায় বিআইসিসিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর সফল উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গাজীপুরে সজীব ওয়াজেদ উপগ্রহ ভূ কেন্দ্র-১ এবং রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় সজীব ওয়াজেদ গ্রাউন্ড স্টেশন-২ উদ্বোধন করেন। সজীব ওয়াজেদ গ্রাউন্ড স্টেশন-১ এর বিকল্প হিসেবে কাজ করছে সজীব ওয়াজেদ উপগ্রহ ভূ কেন্দ্র -২। যাদের প্রচেষ্টায় মহাকাশে বাংলাদেশের ঠিকানা তৈরি হয়েছে জাতি তাদের প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।
বঙ্গবন্ধু আধুনিক টেলিকম ব্যবস্থার সূচনা করেন
মহাকাশে বাংলাদেশের পদচারণার প্রথম সোপান “বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১” জাতীয় জীবনে এ এক ঐতিহাসিক সূচনা ও অবিশ্বাস্মরণীয় এক অগ্রযাত্রা। এই অগ্রযাত্রা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় চলমান ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের সংগ্রাম এগিয়ে নেয়ার এক উজ্জ্বল সোপান অতিক্রম করা। অবিস্মরণীয় এই যাত্রা উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশক। এই যাত্রার ভিত্তি রচিত হয়েছিল জাতির পিতার হাত ধরে।
আমরা জানি, টেলিকম প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ক্ষতবিক্ষত রূপের ওপর দাঁড়িয়েও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) এবং ইউপিইউয়ের সদস্য পদ লাভ করে। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বহির্বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের আধুনিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার সূচনা করেন। তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা “ডিজিটাল বাংলাদেশ” এর রূপকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০০৯ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশকে ৫৭তম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী গর্বিত দেশ হিসেবে তুলে ধরার দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের উদ্যোগ নেন। ২০০১ সালে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের কারণে সে কর্মসূচি আর বাস্তবায়িত হয়নি।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্পের পটভূমি
২০০৯ সালের মে মাসে বিটিআরসির একজন কমিশনারকে আহ্বায়ক করে স্যাটেলাইট কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রস্তুতিমূলক কার্যাদি শুরু করা হয়। পরে ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মহাকাশে অরবিটাল স্লটের জন্য আইটিইউতে আবেদন দাখিল করা হয়।
উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান Space Partnership International (SPI), USA নিয়োগ, ইন্টারস্পুটনিক থেকে ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ অরবিটাল স্লট লিজ গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে স্যাটেলাইট নির্মাণ প্রতিষ্ঠান Thales Alenia Space France এর সাথে ১১ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে স্যাটেলাইট নির্মাণ ও উৎক্ষেপণের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর সম্পন্নের মধ্য দিয়ে প্রকল্পের মূল কার্যাদি শুরু হয়। প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয় ২৭৬৫.৬৬ কোটি টাকা, তন্মধ্যে Thales এর চুক্তি মূল্য প্রায় ১৯০৮.৭৫ কোটি টাকা।
স্যাটেলাইটের প্রয়োজনীয়তা
মহাশূন্যে উৎক্ষেপিত ৩৭০০ কিলোগ্রাম ওজনের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১, ১৫ বছরের অধিক সময় মহাশূন্যে থেকে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ সুবিধার ব্যাপক প্রসার ঘটছে, তন্মেধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সমগ্র বাংলাদেশের স্থল ও জলসীমায় নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচারের নিশ্চয়তা, বর্তমানে বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়াবাবদ প্রদেয় বার্ষিক ১৪ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয়, ট্রান্সপন্ডার লিজের মাধ্যমে প্রচুর বৈদিশিক মুদ্রা আয়, টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচার সেবার পাশাপাশি টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল-লার্নিং, ডিজিটাল-এডুকেশন, ডিটিএইচ প্রভৃতি সেবা প্রদান করা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাবমেরিন অথবা টেরিস্ট্রিয়াল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট যোগাযোগ সুবিধা প্রদান, স্যাটেলাইটের বিভিন্ন সেবার লাইসেন্স ফি ও স্পেকট্রাম চার্জবাবদ সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, স্যাটেলাইট টেকনোলজি ও সেবার প্রসারের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানে সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর ১৪টি সি ব্যান্ড এবং ২৬টি কেইউ ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডারসহ মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। ৪০টি ট্রান্সপন্ডার দ্বারা বাংলাদেশ, সার্কভুক্ত দেশসমূহ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও ‘স্তান’ভুক্ত দেশসমূহে স্যাটেলাইট সুবিধা প্রদান করতে পারবে। ইতোমধ্যে ফিলিপাইন ও নেপালে স্যাটেলাইট সেবা বিক্রির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক টিভি সম্প্রচার উদ্বোধন
২০১৯ সালের ৩১ জুন প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠান থেকে বঙ্গবন্ধু-১ এর মাধ্যমে টিভি চ্যানেলগুলোর বাণিজ্যিক সম্প্রচারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বর্তমানে বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডসহ দেশের ৩৬টি টেলিভিশন চ্যানেল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রাচার করছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবং আফ্রিকায় অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হচ্ছে। এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ভি-স্যাট এবং রেডিও স্টেশনগুলো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এতে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের উদ্যোগ
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ এর মিশন লাইফ ১৫ বছর এবং ডিজাইন লাইফ ১৮ বছর। দেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২, ২০২৩ সালের মধ্যে উৎক্ষেপণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কাজ শুরু হয়েছে।দেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট কী ধরনের হবে এবং এর দ্বারা কী কী সেবা প্রদান করা হবে তা নির্ধারণের জন্যে অংশীজনদের সাথে আলোচনা ও আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি সামনে রেখে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ প্রযুক্তির লেটেস্ট ভার্সন ফাইভ-জি ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে এবং ফাইভ-জি পলিসি চূড়ান্ত ও ইকোসিস্টেম তৈরির কাজ হচ্ছে।
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী
এইচআর/বিএ/জেআইএম