দাতা, বিজ্ঞাপনদাতা এবং একজন ‘ধনী’ মানুষ
‘লোকটা গরিব! বুঝলেন খুব গরিব/
কী রকম এবং কতটা গরিব বলুন তো/
যাচ্ছেতাই রকমের গরিব মশাই, বিচ্ছিরি রকমের গরিব/
আসলে টাকা ছাড়া লোকটার আর কিছুই নেই’ [আরোগ্য, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়]
‘আসলে টাকা ছাড়া লোকটার আর কিছুই নেই’ এমন ‘গরিব’ দেখতে দেখতে এমন ধারণা হয়ে গিয়েছিল, এই জীবনে বোধ করি আর একজন ‘ধনী’ মানুষ দেখে যেতে পারবো না। এদেশে দানবীর দেখি, দান করে তা প্রচারের ঢোল পেটান এমন বিজ্ঞাপনদাতা দেখি কিন্তু ‘ধনী লোক’ দেখি খুব কম।
দেশে প্রতি বছর কারা সবচাইতে বেশি কর দেয় তাদের নামের তালিকা যখন দেখি, তখন হতভম্ব হয়ে যাই। দেখি যাদের অর্থবিত্তের দাপটে টিকতে পারি না তাদের নাম এই তালিকায় নেই। বিড়িওয়ালা-জর্দাওয়ালারা এই তালিকার শীর্ষে। নির্বাচনে অংশ নেন, জিতেও যান, এমন তালিকা ধরে দেখি আহা, এত ‘গরিব মানুষ’ এই দেশে! একজন মহামতি ’খেলাপি’র নির্বাচনী হিসাব দেখি, আহারে তার কিছুই নাই! বাড়ি-গাড়ি এমনকি থাকার জায়গাও! এই যে এত ব্যবসায়ী সমিতি, নানা ব্যবসায়ী সংঘের এত বাঘা বাঘা নেতা, তাদের নাম দেখি না কর দেনেওয়লাদের তালিকায়! গরিব বলে কথা! দেবেনই বা কোথা থেকে?
তবে ‘আসলে টাকা ছাড়া লোকটার আর কিছুই নেই’ এমন ‘‘গরিবদের” দাতা চরিত্র দেখি প্রায়শই। বিশেষ করে জাকাত দেয়ার মওসুমে। এই দাতারা তখন হয়ে যান বিজ্ঞাপনদাতাও। ঘোষণা দেয়া হয় কোন ‘রাজপ্রাসাদ’ থেকে জাকাতের কাপড় বিতরণ করা হবে। এটি আবার ‘জাকাতের কাপড়’। বাজারের সবচাইতে কম দামের, কম টেকসই, দ্রুত রং ওঠে ফ্যাকাসে হয়ে যায় এমন ‘‘গুণগত মানসম্পন্ন” কাপড় তৈরি হয় বিশেষ কায়দায়, জাকাতের জন্য। সেই কাপড় পেতে ভোররাত থেকে রাজপ্রাসাদের সামনে ভিড়। একসময় বিতরণ শুরু। হুড়োহুড়ি। পরদিন মিডিয়ায় শিরোনাম ‘জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে নিহত ... জন’। টেলিভিশনের সামনে সেই ‘দানবীর” বীরদর্পে হাজির। সহাস্যবদনে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি বলছেন, ‘এই জাতির কিছু হবে না, কিচ্ছু হবে না। যে জাতির সাধারণ মানুষ লাইন ধরে একটি কাপড় নিতে পারে না, এইটুকু শৃঙ্খলা যে জাতির মধ্যে নেই, সেই জাতির কিচ্ছু হবে না’। কথা সত্য। এই জাতির কিছু হোক বা না হোক তার কিন্তু হচ্ছেই। প্রতিনিয়ত টাকার ভারে আরও ‘গরিব’ হয়ে পড়ছেন তিনি ও তেনাদের দল।
আর বিজ্ঞাপনদাতাদের তো কথাই নেই। এবার করোনাদুর্যোগ হওয়ার সময়েই আমার প্রিয় এক টেলিভিশন আধিকারিক খুব রেগে বললেন, দেখেন কী কাণ্ড, ১০০ জন লোককে খিচুড়ি দেবে, এই জন্য এক এমপি, প্রাক্তন মন্ত্রী ক্যামেরা চেয়েছেন। এটা কি নিউজ হলো? আমি ক্যামেরা পাঠাইনি। আসেন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেই, এ ধরনের নিউজ কভার করবো না। তার পেশাদারিত্বের টনটনে মর্যাদাবোধ দেখে খুবই খুশি হই। কিন্তু নিজের বিস্তর অভিজ্ঞতা থেকে বলি: দাঁড়াও বৎস, তিষ্ট ক্ষণকাল! মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে দেখি, ‘‘দানবীর” বিজ্ঞাপনদাতাদের ভিড়ে মিডিয়া সয়লাব। টেলিভিশনের খবরে অনেকটা জুড়ে তারা জায়গা দখল করে ফেলেছেন। পত্রিকার পাতায় যে অংশে রঙ্গীন ছবি ছাপা হয়, তার বড় অংশজুড়ে এই ‘‘বিজ্ঞাপনদাতা দাানবীর”দের ছবি। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখি এক দানবীর তার ২৫ সহযোদ্ধাসহ এক ভিখারিনীর মুখে মাস্ক লাগিয়ে দিচ্ছে। এক দানবীর সাঙ্গপাঙ্গসহ ত্রাণের বস্তা তুলে দিচ্ছেন কারো হাতে। কে দাতা আর কে গ্রহীতা ছবি দেখে বের করা মুশকিল।
এরপর ধানকাটা, ফেসবুক লাইভ, সেলফি, ছবি তুলে ত্রাণের বস্তা ফেরত নেয়ার কত কী দেখা হলো, বলে শেষ করা যাবে না। কপালে আরও কত কী দেখার বাকি, কে জানে! এই দাতা এবং কিছু দিয়ে বিজ্ঞাপনের মতো প্রচার করা বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপে পিষ্ট দেশ ও সমাজ। ঢোল পেটানো ছাড়া দান নয় এমনই তাদের দর্শন। এই দানবীররা নানা উত্তাপে এতটাই প্রভাবশালী, মিডিয়ার সাধ্য কি তাদের দাবায়া রাখে। তবে এর যে ব্যতিক্রম নেই তা নয়। টাকার সাথে মনুষ্যত্ববোধ, বিবেকবোধ, দায়িত্ববোধ আছে বলেই তারা ব্যতিক্রম। অবশ্যই এই ব্যতিক্রমরা শীর্ষেন্দুর তালিকায় পড়েন না।
আমার নিজের মধ্যে খুব তীব্র আঞ্চলিকতাবোধ নেই। আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে ভাবি বলেই, জাতীয়তাবাদ বা আঞ্চলিকতা বোধ খুই গৌন মনে হয়। ঠিক কি বেঠিক তা- নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু হালে দেখলাম এ রকম আত্মঅহংকারটাও জরুরি। এই করোনাকালে বিশ্বজুড়ে যখন সামাজিক দূরত্বের কথা জোরেসোরে আলোচিত হচ্ছে, তখন সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক হুজুরের জানাজায় সমবেত হন হাজার মানুষ। অই সমাবেশে উড়ে গেছে সামাজিক দূরত্বের সব আওয়াজ। তাই নিয়ে কিছু গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব তাদের হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের প্রতিক্রিয়ার ভাষা নিয়ে কথা হতে পারে। তবে মূল বিষয়টি এসেছে তাদের হতাশাজনিত উদ্বেগ বা আক্ষেপ থেকেই, কোনো বিদ্বেষ থেকে নয়। কিন্তু তাতেই ক্ষেপেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্মানিত কেউ কেউ। এই ক্ষুদ্ধজনেরা দুই গণমাধ্যমব্যক্তিত্বকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন এই বলে যে, তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে অপমান করেছেন। নোটিশে তুলে ধরা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশাল ইতিহাসকে। যেহেতু উকিল নোটিশ, তাই সেটি আইনগতভাবেই ফয়সালা হোক।
সবশেষে সেই এলাকার এমপি মহোদয় ঘোষণা দিয়েছেন, কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। যারাই তার এলাকার নামে বিদ্রুপ করবে, তাকেই আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে। আইনসভার সদস্যের এলাকার প্রতি প্রেমবোধ বলে কথা। প্রসঙ্গটি টানলাম এ জন্য যে, নিজের এলাকা নিয়ে একটু-আধটু আত্মঅহমিকা থাকাই বোধ হয় জরুরি, তবে সবটাই যেন ’মৌলবাদী’ না হয়। ভুল বুঝাবুঝি যাতে না হয় সে জন্য বলি, অন্ধবিশ্বাস, অন্ধসমর্থন, অন্ধবিরোধিতাকেই আমি মৌলবাদ গণ্য করি।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের বাসিন্দা বলে গৌরববোধ যে নেই- তা নয়, কিন্তু সেটি মৌলবাদী পর্যায়ে নয়। ১ মে এই জেলার বয়স হলো ২৩৩ বছর। কবি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে বলতে চাই, আপনি আজ খুশি হতে পারেন, শেষ পর্যন্ত একজন ধনী লোক পাওয়া গেল। এই ধনী লোকটির শুধু টাকাই নেই, আর সবই আছে। আপনি আরও খুশি হবেন এটি জেনে যে, এই লোকটির নিবাস, আপনার প্রাক্তন নিবাস, বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলাতেই। বেশ কয়েক বছর আগে শীর্ষেন্দু ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম এক টেলিভিশনের জন্য। এতই আগ্রহ উদ্দীপক ছিল এই সাক্ষাৎকারটি, যে কারণে নির্ধারিত চল্লিশ মিনিটের দুই কিস্তিতে এটি সম্প্রচার করতে হয়েছিল। সে সময় কথার ফাঁকে তিনি বলছিলেন তাঁর ময়মনসিংহ ও বিক্রমপুরের জীবনের কথা। তাঁর কোন লেখায় ময়মনসিংহের কথা আছে তাও বলেছিলেন।
তাই কবি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাথে আমিও অহংকারে, আনন্দে তুড়ি বাজাই এ কারণে যে, এই ‘ধনী’ লোকটি বসত করেন, বৃহত্তর ময়মনসিংহের অংশ, এখন আমার নিজের জেলা শেরপুরে। দেশের সবাই জানেন- শেরপুরের আশি বছর বয়সী নাজিমউদ্দিনের কথা। তাঁর পরিচয় তিনি একজন ‘ভিক্ষুক’। ঝিনাইগাতি উপজেলার গান্ধীগাঁও গ্রামের নাজিমউদ্দিন ছিলেন পেশায় দিনমজুর। এক সড়ক দুর্ঘটনা তার কাজ করার শক্তি কেড়ে নেয়। তিনি ভিক্ষুকে পরিণত হন। দুই পুত্র ঢাকায় রিকশা চালায়, বুড়ো মা-বাবার দিকে নজর দেয়ার সময় নেই তাদের। এলাকায় পড়ে থাকা এক টুকরো জমিতে মাথাগোঁজার একটু ঠিকানা তাঁর আছে, কিন্তু জমিটি তাঁর নয়। ভিক্ষা করে আধপেট খেয়ে স্বপ্ন দেখেন একদিন একটি ঘর তুলবেন তিনি। কোথায়? তার ঠিক নেই। সে জন্যই কয়েক বছরে তিনি জমিয়েছেন ১০ হাজার টাকা। এই ১০ হাজার টাকার মূল্য বুঝবেন না ক্যাসিনো সম্রাটের সাগরেদ বা তাদের উচ্ছিষ্টভোগীরা। বুঝবেন না তারকা হোটেলে পাপিয়া আসরে এক তুড়িতে যারা বড় নোটের বান্ডিল শূন্যে উড়িয়ে দেন তারা। বুঝবেন না যারা ঢাকার বোরিং লাইফ থেকে একটু মুক্তবাতাসের স্বাদ নিতে, পুকুর থেকে তোলা তাজা মাছ ভাজা আর পানীয় দিয়ে জীবনটা ভিজিয়ে নিতে হেলিকপ্টারে ছুটে যান ছোট বাংলাদেশের কোনো এলাকায়। সকালে গিয়ে বিকেলে ফেরেন। খুদে খুদে ময়লা নোটে জমানো ১০ হাজার টাকার প্রতিটি নোটেই নাজিমউদ্দিনের কান্না, শ্রম, কষ্ট, একটি ঘরের স্বপ্ন জড়িয়ে আছে।
চীন কোথায়? উহান কোথায়? করোনাভাইরাস কী? মাস্ক কী, কোয়ারেন্টাইন কাকে বলে, পিপিই কী? আইসোলেশন কাকে বলে, ভেন্টিলেটর দিয়ে কী হয়, তার কিছুই জানেন না নাজিমউদ্দিন। কিন্তু তিনি যখন দেখেন মানুষের না খাওয়ার কষ্ট, তখন ভেতরের নাজিমউদ্দিন জেগে ওঠে। কারণ তিনি তো জানেন, কাজ না থাকার কী কষ্ট। তিনি তো জানেন, একটু খাবারের জন্য মানুষের কাছে হাতপাতা কতটা অমর্যাদার। না খেয়ে থাকার কষ্ট কী নাজিমউদ্দিনকে তা জানতে হয় না নোবেলজয়ীদের বাণী শুনে অথবা কবিতা-চিত্রকলা বা এনজিওর জরিপ থেকে। নিজের জীবন দিয়েই তিনি জানেন ক্ষুধার কষ্ট কী। তাই তিনি তাঁর সারাজীবনের সঞ্চয় ১০ হাজার টাকা সরকারি ত্রাণ তহবিলে তুলে দিয়ে বলেছেন, ‘‘আমার এই ৮০ বছর বয়সে ঘর থাকলেই কী না থাকলেই বা কী। কিন্তু যারা না খেয়ে আছে তাদের তো বাঁচতে হবে।”
আমার শোনা মানবতাবাদী দর্শনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপসংহার এটি। মানুষের জন্য জয়গান গাওয়া গীতিকবিতার সর্বশ্রেষ্ঠ পঙক্তি এটি। মানুষের জন্য রাজনীতি নিয়ে বক্তৃতার সর্বশ্রেষ্ঠ সারাংশ এটি। নাজিমউদ্দিন, আপনি আমাদের কালের সেই শ্রেষ্ঠ ধনী, যার টাকাটাই শুধু নেই। কিন্তু আপনার যা আছে তা আমাদের প্রবল দাপটশালী, প্রভাবশালী দাতা-বিজ্ঞাপনদাতাদের নেই। কুর্নিশ আপনাকে।
নাজিমউদ্দিনের এই দান আলোড়িত করেছে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। তাঁর নির্দেশে একখণ্ড নিষ্কণ্টক জমিতে ঘর তুলে দেয়া হচ্ছে নাজিমউদ্দিনের জন্য। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশের পর শেরপুরের প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা হামলে পড়েছেন। জেলা প্রশাসনের ধবধবে অফিসে ফুলের তোড়া দিয়ে যখন নাজিমউদ্দিন বন্দনায় সবাই ব্যস্ত, তখন খোঁজ নেই এই যে দেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রের এত আয়োজন, তার কোনো সুবিধা কি নাজিমউদ্দিন পেয়েছিলেন? সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর সুবিধা পেতে যে যোগ্যতার প্রয়োজন তার সবই নাজিমউদ্দিনের ছিল। তিনি বয়স্ক, তিনি ভিক্ষা করেন, তার থাকার ঠিকানা নেই- এর চাইতে আর কী যোগ্যতা প্রয়োজন? রাষ্ট্র এখানে লা-জওয়াব! কী প্রশাসন, কী জনপ্রতিনিধি, কী দলের নেতা; কেউ নাজিমউদ্দিনের কাছে যাননি কখনও। দুস্থদের যে তালিকা সেই তালিকায় নাজিমউদ্দিনের নাম ওঠেনি কোনোদিন! করোনাকে ধন্যবাদ। করোনা নাজিমউদ্দিনকে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে, এই অমানবিক রাষ্ট্রের গালে একটি চপেটাঘাত করার। ‘‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছো অপমান...”।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যখন বড় কষ্ট নিয়ে বলেন, আজ বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন দেয়ার জন্য কত নেতা, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় তখন অনেককেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক নেতাই চোখ তুলে জবাব দিতে পারেন না। এ নিয়ে রাজনৈতিক গবেষণা হোক। কিন্তু গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধুকে বুকে ধারণ করে আছেন বহু মানুষ তাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে। কোনো বিনিময়ের প্রত্যাশা নিয়ে নয়।
কী করে ভুলবো ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার অজপাড়াগাঁর দরিদ্র রিকশাভ্যানচালক হাসমত আলীর ভালোবাসার কাহিনী। সারাজীবনের সঞ্চয়ের টাকায় নিজের নামে নয়, স্ত্রী-পুত্রের নামে নয়; তিনি একখণ্ড জমি কিনেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ‘এতিম’ কন্যা শেখ হাসিনার জন্য।
কী করে ভুলবো, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের কালো পোশাকের মকবুলের কথা। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর থেকে তিনি কালো পোশাক পরেই জীবন কাটিয়েছেন। বলতেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড তাঁর জীবনের সবটুকু রং কেড়ে নিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ৩৪ বছর ধরে খালি পায়ে ছিলেন ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার পাচানীর গ্রাম্যচিকিৎসক তফাজ্জল হোসেন। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা তফাজ্জল হোসেনকে এক জোড়া জুতা ও পায়জামা-পাঞ্জাবি উপহার দেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার সম্মানার্থে তিনি মাত্র তিনদিন এসব ব্যবহার করে আগের প্রতিজ্ঞায় ফিরে যান।
কী করে ভুলি ১৯৫৪ সনের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহার করা সাইকেলটি সারাজীবন আঁকড়ে রাখা ওয়াজেদ মন্ডলকে। কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণ বড়বেড় দ্বীপচরে আবদুস সোবাহানের কথা। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রূপপুর মহল্লার আব্দুর রহিম বা বরিশালের উজিরপুর থানার পশ্চিম শোলক গ্রামের রব মিয়াকে। বঙ্গবন্ধুময় জীবন তাদের কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশা নিয়ে নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুতেই তারা জড়িয়ে আছেন সারাজীবন।
সবশেষে যাদের কথা বললাম, তাদের সাথে নাজিমউদ্দিনের ত্যাগের হয়তো পার্থক্য আছে। কিন্তু ভালোবাসা আর মানবিকতায় একই রকম পূর্ণ তাদের ত্যাগের সবটুকু।
‘টাকা ছাড়া লোকটার আর কিছুই নেই’ এমন ‘গরিব’দেরই রাজত্ব এখন দেশজুড়ে। প্রবল দাপট তাদের, কী সরকারে, কী প্রশাসনে, কী ব্যবসায়, কী দলে, কী পেশাজীবীদের মধ্যেও। তাদের তুলনায় এই সমাজে নাজিমউদ্দিনদের অবস্থান খুবই দুর্বল। তবু প্রত্যাশা করি ‘টাকা ছাড়া আর কিছুই নেই’ এমন ‘গরিব’দের সামনে আমাদের অসহায় কিন্তু প্রকৃত ‘ধনী’ নাজিমউদ্দিন দৃষ্টান্ত হোন। তাদের প্রেরণা হোক।
এইচআর/বিএ/জেআইএম