খাঁচাবন্দী মানুষ
করোনা। দেশে দেশে এখন মহামারির এক কাব্যের নাম। যে পৃথিবীতে মানুষ পশুপাখিকে খাঁচাবন্দী করে রাখে, সেই পৃথিবীতে মানুষ আজ নিজেই খাঁচাবন্দী। বিশ্বজুড়ে চলছে লকডাউন। তার ভেতর চলছে মৃতের সংখ্যা গণনা। বিষণ্নতা গ্রাস করছে আমাদের চারপাশকে। অনেক প্রিয়মুখ হারিয়ে যাচ্ছে। তারা সব মৃত।
আবার সম্পূর্ণ অচেনা মুখ দ্রুত প্রিয় হয়ে যাচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা দিনরাত চেষ্টা করছেন মানুষকে প্রাণে বাঁচাতে। ঘরবন্দী জীবনে যাদের জুটছে না দুই বেলা খাবার, তাদের মুখে এক বেলা খাবার তুলে দেয়ার চেষ্টা করছেন তারা। যে যার সাধ্যমতো। এবং নিঃস্বার্থভাবে। তারা প্রচার-প্রচারণা বা কারও স্বীকৃতি চান না। আবার করোনায় মৃতব্যক্তির শেষযাত্রায় আত্মীয়-স্বজনরাও যখন আসছেন না বা আসতে পারছেন না সেখানে কিছু মানুষ মৃত্যুভয়কে তুচ্ছজ্ঞান করে কাঁধে তুলে নিচ্ছেন লাশ। তারা গাইছেন মানবতার গান। দেখতে চান সভ্যতার জয়।
অনেকের এখন অখণ্ড অবসর। ঘরবন্দী জীবন। কিন্তু তার উল্টোচিত্রও দেখছি। পৃথিবীর সব হাসপাতাল-ক্লিনিকের দিকে চোখ রাখুন। ঘুমহীন ক্লান্ত শরীর নিয়ে কত মানুষ পরিশ্রম করে যাচ্ছেন অন্যকে বাঁচানোর জন্য। ওটাই তাদের পেশা। সেবাই তাদের ধর্ম। সেই তাদের নিয়েও আমাদের দেশে আছে মানুষের রাগ-ক্ষোভ-হতাশা। আসলে কিছু কিছু চাকরি আছে যেখানে হয়তো অনেক টাকা আছে। সঙ্গে আছে শারীরিক-মানসিক পরিশ্রম। আছে অন্যের জীবনের জন্য দিনরাতের লড়াই। মৃত্যুকে হটিয়ে দিয়ে একটা মানুষকে বাঁচাতে পারলে যে আনন্দ তা কোনো সুপারশপে কেনা যায় না।
আবার শতচেষ্টায়ও বাঁচাতে না পারলে সেই মানুষটার ভেতরের দহনটা বোঝা যায় না। হয়তো সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন না। তারা শুধু বোঝে চিকিৎসকদের ‘রেভিনিউ মডেল’। এরা অনেক টাকা আয় করে! কিন্তু দিনরাত উজাড় করে দেয়া তাদের শ্রম-মেধার পুঁজির মূল্যটা বুঝতে চান না! এখন বোধহয় মানুষের সেই ভাবনার দরোজায় ‘উপলব্ধি’ কড়া নাড়ছে। মানুষ বাঁচানোর এই যুদ্ধে প্রথম সারির যোদ্ধা স্বাস্থ্যকর্মীরা। যুদ্ধের ময়দানে তারাও ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে! আসলে মানুষ আজ কত অসহায়!
এই দুর্দিনে, দুঃসময়ে তবু সে মুক্তি খোঁজে। কোথাও না কোথাও মুক্তির আলো দেখতে পায়। ঘরবন্দী মানুষগুলো জানালা দিয়ে তাকিয়ে হয়তো রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হয়। ‘এই আকাশে আমার মুক্তি, আলোয় আলোয়/আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায়।’ এখানে জীবনের তীব্রতম দুঃখ আছে। আবার তীব্রতম উত্তরণ আছে।
আজ সারাবিশ্বে কত মানুষ ঘরবন্দী। কেউ খাবার পাচ্ছেন। কেউ পাচ্ছেন না। তবু করোনার ভয়াল থাবা থেকে বাঁচতে নিজেকে চার দেয়ালের মধ্যেই আটকে রাখতে হচ্ছে। আধখোলা জানালা দিয়ে তাকালে মনটা হয়তো বাইরে যাচ্ছে। সেই মনটাও বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে যখন কানে আসছে প্রতিটি দেশে কীভাবে হু হু করে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। বিষাদগ্রস্ত সেই মন আতঙ্কিত হয়ে আবার ঘরে চলে আসছে। কারণ; আমরা বাঁচতে চাই। অনেকে বিরক্ত হয়ে টেলিভিশন দেখাই হয়তো বন্ধ করে দিচ্ছেন। ভাবছেন এই সব মৃত্যুর খবর শুনে শুনে নেগেটিভ এনার্জি খরচ করে কী লাভ!
কিন্তু জীবনে সবসময় লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলে না। মেলানো সম্ভব নয়। করোনায় লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া পৃথিবীর কোনো হিসাব কি মিলছে আজ? আক্রান্ত-শনাক্ত-মৃতের সংখ্যা দিয়ে করোনায় ক্ষতি মাপা যাবে না। প্রথম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও যোদ্ধারা জানতেন শত্রুকে মারতে পারলেই জয়। সেখানে শত্রু ছিল চেনা। আজ এই করোনাযুদ্ধে শত্রু অচেনা। গোটা পৃথিবী এক হয়ে যুদ্ধে নেমেও শত্রুকে দেখতে পাচ্ছে না। মাঝপথে সেই যুদ্ধে আবার বেসুরা দামামা বাজছে!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সবাইকে এক হয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার উপায় খোঁজার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু সেই ডাকে সাড়া দিতে নারাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিদিন প্রেস কনফারেন্সে যা বলছেন তাতে মনে হচ্ছে; করোনা মোকাবিলায় তিনি একাই যথেষ্ট! করোনার মতো একটা ফালতু বিষয় নিয়ে এত মাথা ঘামানোর দরকার কী! তিনি নিজে করোনার চেয়ে শক্তিশালী। অথচ আজ বিশ্বে সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশের নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কে থামছে না মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিন সেটা বড় হচ্ছে।
একা অনেক যুদ্ধজয়ের ইতিহাস আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। আবার আছে পরাজয়ের স্মৃতিও। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি স্মৃতিহীন হয়ে পড়েছেন? স্মৃতি হারিয়ে গেলে কী থাকে? নিঃসঙ্গতা। অতীত ভুলে গেলে স্মৃতি থাকে না। স্মৃতিহীনতাই নিঃসঙ্গতা। একা যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন দেখতে হলেও স্মৃতি প্রয়োজন। নিকট অতীত কিন্তু বলে মার্কিনিরা একা যুদ্ধে জিততে পারেনি। তবে এবার একা লড়ার; এই ভাবনার মাশুল দিতে হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রকে। সেটা ট্রাম্পের একরোখা মানসিকতার কারণে। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের প্রথম রাউন্ডে কিন্তু হেরেছে যুক্তরাষ্ট্র।
আবার যে চীন করোনার উৎসস্থল। অথচ সেই চীন করোনার উৎস খুঁজতে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবিকে পাত্তা দিতে নারাজ! তাহলে কি করোনার এই মহামারির সময়েও আর্থিক লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলাতে গিয়ে বিশ্ব দ্বিধাবিভক্ত? অর্থনীতিবিদরা অনেকে বলছেন, করোনা মহামারির বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করতে না পারলে, শুধু মানুষ মরবে না। অচল হয়ে যাবে পৃথিবীর বহু দেশের অর্থনীতির চাকা। বাড়বে অসাম্য। এখনও উপলব্ধির সময় হারিয়ে যায়নি।
কিন্তু সময় ফুরিয়ে গেলে বড় ভুলের খেসারত দিতে হতে পারে মানবজাতিকে। ক্ষমতাধর দেশগুলোকে সেটা সবার আগে বুঝতে হবে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে করোনাকে পরাস্ত করা যাবে না। ক্ষমতার অনুশাসিত সিপাহী দিয়ে করোনাকে হার মানানো যাবে না। দরকার সাহস, মেধা, মনন, ঐক্য, সম্মিলিত চেষ্টা, আর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার মানসিকতা। সেটা দেখাতে না পারলে মহামারি শেষে বেঁচে থাকা মানুষগুলো দেখবে এক অন্য পৃথিবীকে।
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/বিএ/পিআর