করোনা জীবাণু অস্ত্র : চীন কিন্তু ইরাক নয়, মিস্টার ট্রাম্প

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৮:৫৬ এএম, ২৩ এপ্রিল ২০২০

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিযোগ উত্থাপন করেছেন যে করোনাভাইরাস বিশ্বকে যেই দুর্যোগের মধ্যে ফেলেছে তা কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়। এই বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে চীন এবং তারা করোনাভাইরাস উহানের একটি ল্যাবরেটরিতে তৈরি করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উহানের ল্যাবরেটরিতে তার বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে বিষয়টি তদন্ত করার দাবি জানাচ্ছে। চীনের উচিত এই দাবি মেনে নেয়া। চীন মার্কিন অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং তাদের তদন্তের দাবিও প্রত্যাখ্যান করেছে। ট্রাম্প গত ১৮ এপ্রিল হোয়াইট হাউসের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন এবং কথাটা প্রমাণিত হলে ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকিও দিয়েছেন।

এদিকে চীনের ল্যাবে জীবাণু তৈরি হয়েছে- ট্রাম্পের এমন দাবিতে পানি ফেলে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ২১ এপ্রিল জেনেভায় ডব্লিউএইচও জানিয়ে দিয়েছে, ‘সব তথ্য-প্রমাণাদি থেকে জানা যায় যে, ভাইরাসটি একটি প্রাণী থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। এটি কোনো গবেষণাগারে বা অন্য কোথাও থেকে ছড়ায়নি। তবে প্রাণী থেকে কীভাবে এই ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এমন ধরনের ভাইরাস ল্যাব থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়া সম্ভব কিনা- সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাব দেননি ডব্লিউএইচও মুখপাত্র ফাদেলা চাইব। এর আগে দ্য উহান ইনস্টিটিউট এমন দাবিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছিল।

প্রমাণ ছাড়া চীনকে ঘায়েল করা ট্রাম্পের পক্ষে সম্ভবও না। কারণ চীন ইরাক নয়। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং লোকটিও সাদ্দাম হোসেন নয়। জুনিয়র বুশও ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে এমন জীবাণু অস্ত্রের অভিযোগ তুলেছিলেন এবং এই মিথ্যা অভিযোগ কেন্দ্র করে সাদ্দামকে খতম করেছিলেন। ইরাককে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উত্থাপন করে একটি ক্ষণস্থায়ী স্নায়ুযুদ্ধ আরম্ভ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মনে হয় না, এই নিয়ে কোনো স্নায়ুযুদ্ধ আরম্ভ করার বা কোনো ফায়দা লোটার ফন্দি-ফিকির করে যুক্তরাষ্ট্র সফল হবে।

১৯৯১ সালের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর আমেরিকা গত তিন দশকব্যাপী বিশ্বে একক সুপার পাওয়ার হিসেবে বিরাজমান। রাশিয়া তার দুর্বল নেতৃত্ব এবং ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরিণতিটা সামাল দিতে গিয়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি উল্টে গেছে। রাশিয়ার বিরাট সামরিক শক্তি এবং পুতিনের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি- পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়ার ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাতে সক্ষম হয়েছে। হেনতেন শক্তি নয়, এমনকি রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকার অভিযোগ ছিল যে, ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার গোপন হস্তক্ষেপের ফলে ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছিলেন।

ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় নাকি রাশিয়ার সঙ্গে অকারণে সংঘাতের নীতি অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ট্রাম্পের উপদেষ্টামণ্ডলীর সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টা অনেকটাই প্রমাণিত এখন। পুতিন রাশিয়ার পুনর্গঠনের কাজটি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করার জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে হিলারি ক্লিনটনকে না চাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারি ক্লিনটন সম্পর্কে পুতিনের ধারণাতো আগে থেকেই খারাপ ছিল।

আমেরিকা করোনাভাইরাস নিয়ে চীনকে অভিযুক্ত করে যে বক্তব্য দিয়েছে সেই সম্পর্কে তার ইউরোপীয় মিত্ররা কী ধারণা পোষণ করে তা এখনও জানা যায়নি। এখন পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা সারাবিশ্বে দুই লাখের কাছাকাছি। আক্রান্ত সাড়ে ২৫ লাখ ছাড়িয়েছে। প্রতি মিনিটে এই সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে এক লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে ইউরোপে। সেই কারণে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর চীনের ওপর ক্ষোভ থাকতেই পারে তবে সেটি ইরাকযুদ্ধে আমেরিকাকে যে হাওয়া দিয়েছে সে রকম না।

সাদ্দামের বিরুদ্ধে বুশ জীবাণু অস্ত্রের অভিযোগ তুলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরাকের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ বাঁধিয়েছিল তাতে ইউরোপীয় দোসররা সবাই আমেরিকার সঙ্গে ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আগের মতো নয়। করোনার আক্রমণে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং স্পেনসহ ইউরোপের অবস্থা লন্ডভন্ড। ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে সুর মেলাবে বলে মনে হয় না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে স্পেন চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে যে চীন উহানে গত বছরের নভেম্বরে করোনা মোকাবিলায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেও কথাটি বিশ্ববাসীকে জানাতে বিলম্ব করেছে। চীনের বিরুদ্ধে স্পেনের এই অভিযোগ উত্থাপন আমেরিকার সঙ্গে সুর মেলানোর পূর্বপ্রস্তুতি নাকি সত্যের প্রকাশ- এখনও বোঝা যাচ্ছে না।

শুধু পাহাড়পরিমাণ অস্ত্রের মজুত থাকলেই এখন সুপারপাওয়ার হওয়া মুশকিল হয়ে উঠেছে। আর্থিক সঙ্গতি এখন বড় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশ্বে এখন চীন অর্থের দিক থেকে অন্য দেশকে ছাড়িয়ে গেছে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও। বিশ্ব অর্থনীনৈতি প্রবৃদ্ধিতে চায়নার অবদান প্রায় ৩০ শতাংশ। চীন সারাবিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে অকাতরে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দিয়ে আসছে। শত্রু-মিত্র না দেখে এমন সাহায্য প্রদানে চীনের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে বিশ্বের সর্বত্র। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার দেশগুলো চীনের বন্ধুত্বের প্রত্যাশী।

করোনাভাইরাস চীনের উহান প্রদেশে থেকে আরম্ভ হলেও তারা তা সফলভাবে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেছে। করোনার এখনও কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। চীনের প্রতিরোধের প্রদ্ধতিটাই সবাই অনুসরণ করে করোনা প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। চীন কিন্তু করোনার ব্যাপারেও আন্তরিকভাবে সাহায্য করছে বিশ্বের অন্য আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলোকে। এখন কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষার সামগ্রীও চীনের গুলোই উত্তম। বাংলাদেশও গত ২০ এপ্রিল এক কার্গো প্লেন সুরক্ষা সামগ্রী চীন থেকে এনেছে। করোনার চিকিৎসার সরঞ্জামাদি নিয়ে আমেরিকার বাজারও এখন চীনের দখলে।

করোনা-পরবর্তী বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ কে করবে- এখন তাই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সম্ভবত বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রগুলোরও চীনের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে। কারণ বিশ্ব খুব দ্রুত দুর্ভিক্ষ এবং আর্থিক মহামন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলো নিজেরাই সংকটে পড়বে। আর আমেরিকার আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। আমেরিকা এখন শঙ্কিত হয়ে উঠেছে। চীনকে প্রতিরোধ করার জন্য করোনাভাইরাসকে চীনের ল্যাবে তৈরি বলে সারাবিশ্বকে আতঙ্কিত করা আমেরিকার কৌশলমাত্র।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/বিএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।