হাওরের ধান কাটা নিয়ে সংশয়, নতুন ধানের ক্রেতাও নেই
প্রতিবছর বৈশাখ মাস এলেই হাওরে বোরো ধান কাটা শুরু হয়। জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত এই ধান কাটা চলে। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আংশিক এলাকা নিয়ে এই হাওরাঞ্চল। খাদ্য উদ্বৃত্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় তথা হাওরের সাত জেলার প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের প্রধান এবং বছরের একমাত্র উৎপাদিত ফসল বোরো ধান। বাংলাদেশে এবার মোট ৪১ লাখ ২৮ হাজার ৫৪৮ হেক্টর আবাদ করা জমির মধ্য সাত জেলায় মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৯ লাখ ৮৬ হাজার ১০১ হেক্টর জমি। অর্থাৎ ২৩ শতাংশ (তথ্য ডিএই'র)। এদেশের মোট চাহিদার পাঁচ ভাগের এক ভাগ খাদ্যের জোগান আসে হাওর থেকে।
এবার করোনার কারণে হাওরে ধান কাটার শ্রমিক চাহিদা অনুযায়ী আসতে পারছে না। খবর পাওয়া গেছে পাকা ধান নিয়ে কৃষকরা এখন শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ক্ষুদ্র কৃষকরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ইতোমধ্যই ধান কাটা শুরু করলেও বড় কৃষকরা চিন্তিত। জোতদার কৃষকের মধ্য যাদের শত শত বিঘা জমি আছে তারা বাইরের শ্রমিক দিয়েই ধান কাটতে হয়। অপরদিকে দরিদ্র শ্রমিকরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাওরে এসে দুই মাস ধান কেটে ভালো উপার্জন করে থাকে। ধান কাটা শ্রমিকরা প্রতিবছর চৈত্রের মাঝামাঝি সময়ে হাওর এলাকার বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায়। করোনা পরিস্থিতিতে এখনও শ্রমিকরা হাওরে পৌঁছতে পারেনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সাত জেলার আশপাশের এলাকার কিছু কিছু শ্রমিক হাওরে পৌঁছালেও আশাতীত নয়। বিগত কয়েক বছর যাবৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অকাল বন্যায় কৃষকের উৎপাদিত ধান ঘরে তুলতে পারেনি। এতে হাওরের অধিকাংশ কৃষক পরিবার অর্থনৈতিকভাবে কষ্টে রয়েছে। এরই মধ্য করোনার কারণে হাওরের ধান যদি কাটার কারণে ঘরে তুলতে না পারে তবে মহাবিপদ দেখা দিতে পারে। ধান কাটা তাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। হাওরের সাত জেলার পৌনে দুই কোটি মানুষের খোরাকসহ দেশের খাদ্য ঘাটতি মেটানো হয় উৎপাদিত ধানে।
ক্ষেতমজুরদের হাওরে আসা এবার সম্ভব হবে কিনা তা কৃষকরা বলতে পারছে না। বহুকাল ধরে উত্তরাঞ্চলের জেলা রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, বগুড়াসহ দেশের অনেক জেলা থেকে ধানকাটা শ্রমিকরা হাওরে আসত। কৃষি বিভাগ বিদ্যমান সংকট কাটাতে ফসল কাটার জন্য ১৮০টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ও ১৩৭টি রিপার বরাদ্দ দিয়েছে। কৃষিবিভাগ সূত্রে খবরটি জানা গেছে। বলা হয়েছে হাওরের সাত জেলায় আরও ৩৬২টি হার্ভেস্টার ও ১০৫৬টি রিপার সচল রয়েছে। এছাড়া পুরাতন আরও ২২০টি হার্ভেস্টার ও ৪৮৭টি রিপার মেরামত করা হচ্ছে। এসব কৃষি যন্ত্রপাতি দিয়ে হাওরের সাত জেলা এলাকার ধান কাটা আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন। অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় হার্ভেস্টার পৌঁছানো সম্ভব হয় না বলে কৃষকরা অভিমত ব্যক্ত করেছে।
এদিকে বন্দরনগরী ভৈরব বাজারে নতুন ধান আমদানি শুরু হলেও ক্রেতা নেই বলে আড়তদাররা জানিয়েছে। চলতি সপ্তাহে হাওর এলাকা থেকে নদীপথে ট্রলারযোগে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ নতুন ধান ভৈরবে আমদানি হচ্ছে বলে জানা গেছে। হাওরের উৎপাদিত বিশাল অংকের ধান কৃষকরা ভৈরবে পাঠিয়ে বিক্রি করে। চাঁদপুর, মীরকাদিম, আশুগঞ্জসহ আশেপাশের রাইসমিল মালিকরা ভৈরব বাজার থেকে ধান কিনতে আসে। রাইসমিল মালিকরা জানায় শ্রমিকের অভাবে এখনও পর্যন্ত চাতালগুলো চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ করোনার কারণে দেশের পরিবহন, রেলপথ, সড়কপথ সবই বন্ধ রয়েছে। ফলে বাইরের জেলার চাতাল শ্রমিকরা এখনও রাইসমিলে আসতে পারেনি।
শুধু তাই নয় ধানের পাইকাররাও পরিবহনের কারণে ভৈরবে আসাযাওয়া করতে পারছে না। আরও বড় সমস্যা ভৈরবসহ দেশের জেলা উপজেলার অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক বন্ধ রয়েছে। এ কারণে ব্যবসায়ীরা টাকা-পয়সা লেনদেন করতে পারছে না। ভৈরব বাজারের অসংখ্য ধানের আড়তের গুদামে ধান সংকলিত না হওয়াই হাজার হাজার মণ ধান মেঘনা নদীর পাড়ে স্তূপ করে রেখেছে। এই অবস্থায় ব্যবসায়ী ও কৃষকের অর্থনীতি বিপর্যয় হয়ে পড়েছে। শিগগিরই করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে হাওরের কৃষকদের ভাগ্যে ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে বলে পর্যবেক্ষকমহল মনে করে। কৃষকের ধান কাটার বিষয়টি সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের ধান কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে দ্রুত কেটে ঘরে তুলতে পারে সেই ব্যবস্থাটুকু সরকারকেই করতে হবে।
লেখক : মিডিয়াকর্মী, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ।
এইচআর/বিএ/এমএস