করোনাবিদ্ধ গণমাধ্যম
বিশ্ব এখন এক অভূতপূর্ব ও অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ অতিক্রম করছে। এমন দুর্যোগ আর কখনো দেখেনি বিশ্ব। বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের এই সময়ে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে মানুষের এমন অসহায় আত্মসমর্পণ, সভ্যতার ইতিহাসই নতুন করে লিখতে বাধ্য করবে। বিশ্বের বড় একটা অংশ এখন কার্যত অবরুদ্ধ। কিন্তু এই অবরুদ্ধ সময়েও আরও অনেকের মতো কাজ করতে হয় গণমাধ্যমকর্মীদেরও। শুধু কাজ করতে হয়, তা না; এই সময়ে গণমাধ্যমকর্মীদের দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ আরও বেড়ে যায়। এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানান গুজব ছড়ায়। মানুষ তখন আস্থা রাখে মূলধারার গণমাধ্যমে। সেই আস্থার প্রতিদান দিতে আরও নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে হয় গণমাধ্যমকর্মীদের।
যেহেতু মানুষ ঘরে বন্দী তাই তার হাতে টিভি দেখার, পত্রিকা পড়ার অঢেল সময়। কিন্তু টিভি বা পত্রিকা যারা চালায় তারাও তো মানুষ। আপনারা সুযোগ পেলেই যাদের সাংঘাতিক বলে গালি দেন, সেই সাংবাদিকরাই কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে-ময়দানে কাজ করছে। আপনার কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিচ্ছে। আপনি যখন মাসের বাজারে ফ্রিজ-ভর্তি করে দরজায় খিল এটে নেটফ্লিক্সে নতুন ছবি খুঁজছেন, সাংবাদিকরা তখন হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে করোনার খবর সংগ্রহ করছে। নেটফ্লিক্সে ক্লান্তি এলে টিভি চ্যানেল অন করেই হয়তো আপনি গালি দিলেন, সব সরকারের দালাল। কোনো খবর নেই। এটা ঠিক সাংবাদিকরা আপনার চাহিদামতো আপনার ইনবক্সের সাথে তাল মিলিয়ে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়াতে পারে না। থানকুনি পাতার মতো কোনো অব্যর্থ আবিষ্কার করতে পারে না। তারপরও এই দালালরা দিনরাত কাজ করে। আপনার অফিস বন্ধ, কিন্তু সব টিভি কিন্তু ২৪ ঘণ্টাই চলছে।
গণমাধ্যমের প্রথম চ্যালেঞ্জটা এসেছে পত্রিকার ওপর। ঢাকার অনেক ভবনে আরও অনেক কিছুর মতো পত্রিকা ঢোকাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। করোনার ভয়েও অনেকে পত্রিকা রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন। দেশজুড়ে লকডাউন পরিস্থিতির কারণে বিঘ্নিত হয়েছে পত্রিকার সরবরাহ। তাই চাহিদা বাড়লেও সার্কুলেশন গেছে কমে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি পত্রিকা তাদের ছাপা ভার্সন বন্ধ করে শুধু অনলাইন ভার্সন চালু রেখেছে। যেগুলো ছাপা হচ্ছে, সেগুলোরও কলেবর কমে গেছে। সার্কুলেশন যেমন কমে গেছে, তেমনি বিজ্ঞাপনও কমে গেছে, আয়ও কমে গেছে। পত্রিকাগুলো লোকজন কমিয়ে প্রকাশ অব্যাহত রেখেছে। অনেকে বাড়িতে বসে অফিস করছেন। কিন্তু তবুও পত্রিকার অনেক কর্মীকে অফিসে আসতে হয়।
পত্রিকার তুলনায় অনলাইনগুলো কিছুটা বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। কারণ তাদের যেহেতু ছাপা বা বিলি করার তাড়া নেই, তাই তাদের পক্ষে বাড়িতে বসেই অনেকটা অফিস করা সম্ভব। অধিকাংশ অনলাইনই বাড়িতে বসে অফিস সুবিধা চালু করেছে। খুব জরুরি কর্মী ছাড়া সবাইকে অফিসে আসতে হয় না। এই সময়ে অনলাইনের চাহিদা বেড়েছে ব্যাপকভাবে। মানুষ যেহেতু ঘরে আছে, তাই অনলাইনে হিট বেড়েছে, মানে পাঠক বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় আয় বাড়েনি। কিন্তু তারপরও সর্বশেষ খবর নিয়ে তৈরি থাকছে মূলধারার অনলাইন নিউজপোর্টালগুলো। থাকছে হচ্ছে বাড়তি সতর্কও। এই যে বাড়তি পাঠক, এদের ধরে রেখে নিয়মিত পাঠক বানাতে হলে বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জটাই এখন চলছে।
তবে টেলিভিশনের চ্যালেঞ্জটাই সবচেয়ে বেশি। মানুষের হাতে এখন টেলিভিশন দেখার অঢেল সময়। কিন্তু টেলিভিশনে নতুন কন্টেন্টের বড্ড ঘাটতি। সব ধরনের শ্যুটিং, ডাবিং বন্ধ। তাই নতুন নাটক-সিনেমা-গান নেই। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে পুরোনো আইটেম দিয়ে এয়ারটাইম ভর্তি করতে হচ্ছে। নিউজ চ্যানেলগুলোর চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। কারণ তাদের পক্ষে তো পুরোনো আইটেম দিয়ে এয়ারটাইম ভর্তি করা সম্ভব নয়। তারওপর করোনা ছাড়া আর কোনো নিউজ নেই। এরমধ্যেই বৈচিত্র্যের খোঁজ, এর মধ্যেই প্রতিযোগিতা।
গণমাধ্যমের আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো, নিরাপত্তা। নিজের এবং অফিস ও বাসার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কাজটা অত সহজ নয়। করোনাভাইরাস শনাক্তের পর থেকেই গণমাধ্যমগুলো নিজেদের কার্যালয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে এটা কখনোই নিশ্ছিদ্র করা সম্ভব নয়। কারণ গণমাধ্যম কার্যালয়ে নানা রকমের লোকজন আসা-যাওয়া করে। টকশোর জন্য প্রতিদিনই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে লোক আসে। তাছাড়া টেলিভিশনের রিপোর্টারদের নানান ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় যেতে হয় প্রতিদিন। তাদের কেউ একজন আক্রান্ত হলে গোটা অফিস ঝুঁকিতে পড়ে যায়।
অন্য সব পেশার মানুষ শুধু নিজেরা আক্রান্ত হলেই উদ্বিগ্ন হন। আর সাংবাদিকদের সবার খবর রাখতে হয়। নিজেরা আক্রান্ত হলেও বন্ধ করার উপায় নেই। এটিএন নিউজের এক রিপোর্টার করোনা পজেটিভ হওয়ার পর তাদের ২০ কর্মীকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। এর আগে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের এক ক্যামেরাপারসনের করোনা পজেটিভ হওয়ার পর ৪৭ জনকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠাতে হয়েছিল। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর যা অবস্থা, ৪৭ জনকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠালে অফিস চালানোই মুশকিল। ইতোমধ্যে পাঁচজন সংবাদকর্মীর করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে। আতঙ্ক বাড়ছে। কিন্তু আতঙ্ক বাড়লেও সকল গণমাধ্যম কিন্তু এখনও তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করছে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ আটকে থাকা মানুষের ঘরে পৌঁছে দিতে।
তবে সেই চেষ্টা যে সবসময় সফল হয়, তাও নয়। আমরা সবসময় সবাইকে নিরাপদ থাকতে বলি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলি; কিন্তু নিজেরা সবসময় তা মেনে চলতে পারি না। যেমন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ এবং সেখান থেকে গুলশানে যাওয়ার পথ এবং গুলশানের বাসা পর্যন্ত দলীয় নেতাকর্মী এবং সাংবাদিকরা যা করেছে, তা স্বাস্থ্যবিধির চরম লঙ্ঘন ও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। তারচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল আশকোনা হজ ক্যাম্পে ইতালিফেরত প্রবাসীদের বিক্ষোভ কাভার করার ঘটনা।
অনেককে দেখেছি দেয়ালে উঠে কাছ থেকে ছবি নিচ্ছেন, কেউ কেউ বিক্ষুব্ধদের সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। অনেককে দেখি এক্সক্লুসিভের আশায় করোনা হাসপাতালে ঢুকে পড়েন। সাংবাদিক ভাইয়েরা, এটা ব্যক্তিগত সাহসের ব্যাপার না। আপনি কিন্তু ঝুঁকিতে ফেলছেন, আপনার পরিবার, আপনার অফিস এবং আশপাশের সবাইকে। তাই করোনাকে মোকাবিলা করতে হবে সতর্কতার সাথে, এখানে সাহসের কোনো ব্যাপার নেই।
আর করোনা সাংবাদিক চেনে না, মন্ত্রী চেনে না, এমপি চেনে না, প্রধানমন্ত্রী চেনে না, রাজপুত্র চেনে না; করোনা এক মহাসাম্যবাদী ভাইরাস। আমরা সবাইকে ঘরে থাকতে বলব, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলব; আর নিজেরা ধাক্কাধাক্কি করে ছবি তুলব; এটা হতে পারে না। শুক্রবার বায়তুল মোকাররম মসজিদে ১০ জনের জামাতের ছবি তুলতে যখন ৩০ জন ফটোসাংবাদিক যায়, তখন একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি লজ্জিত হই।
আবার শত চেষ্টা সত্ত্বেও বস্তুনিষ্ঠতারও ঘাটতি হয়ে যায়। এমনিতে বলা হয়, করোনা আতঙ্ক থেকে বাঁচতে গুজবে কান দেবেন না, বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যমে আস্থা রাখুন। ফেসবুকে গেলে দেখবেন, করোনার হাজার রকমের প্রতিষেধক। নানারকমের ওষুধ তো আছেই; থানকুনি পাতা, গরম পানি, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা- নানান তত্ত্ব। দুই মাস আগে করোনার টিকা আবিষ্কারের খবরও পড়েছি ফেসবুকে।
মূলধারার গণমাধ্যমে কিন্তু এসব পাবেন না। তারা শুধু যথাযথ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত প্রতিষেধকের খবরই দেবে, দেয়া উচিত। কিন্তু সবসময় এই ঔচিত্যটা আমরা বজায় রাখতে পারি না। ময়মনসিংহের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক দাবি করলেন, ইথানলের ভাপ নিলে এবং ইথানল দিয়ে কুলি করলে করোনা সংক্রমণ হয় না। আমাদের কোনো কোনো গণমাধ্যম কিন্তু এই খবর ফলাও করে প্রচার করেছে। অথচ ডাক্তাররা বলছেন, এটা কোনোভাবেই হতে পারে না। ইথানল এমনিতেই বিষাক্ত। তাই ইথানলের ভাপ বা কুলি মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এখন আমাদের খবর দেখে যতি কেউ ইথানল ব্যবহার করতে গিয়ে যদি ঝুঁকিতে পড়ে, তার দায়িত্ব কে নেবে। তাই আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। কোনো গুজবকে যেন আমরা বৈধতা দিয়ে নিউজ বানিয়ে না ফেলি।
তবে গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিজেদের অস্তিত্বের এবং সামনের দিনগুলোতে সেই চ্যালেঞ্জ আরও জটিল হবে। এখন সবগুলো গণমাধ্যমই কোনো না কোনোভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখছে। কিন্তু এখন আয় প্রায় বন্ধ। এর প্রভাব পড়বে সামনের দিনগুলোতে। আর সামনে যে মহামন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে, তার প্রভাবও পড়বে গণমাধ্যমে। এমনিতেই সবগুলো গণমাধ্যম ঠিকমতো কর্মীদের বেতন দিতে পারে না। সামনের দিনগুলোতে এই সংকট আরও প্রকট হবে।
আয় না হলে মালিকরা বেতন দেবেন কোত্থেকে। তখন হয়তো কর্মী ছাঁটাই, অনিয়মিত বেতন, এমনকি প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এখন যে গণমাধ্যমকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে, ভবিষ্যতে তাদেরই চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়বে। সরকার নিশ্চয়ই গণমাধ্যমের পাশে থাকবে, তাদের নীতি সহায়তা দেবে। তবে আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার আপনাদের সমর্থন, আপনাদের মানে জনগণের। মাধ্যমটা যেহেতু জনগণের, তাই জনগণ পাশে থাকলেই সেটা সবচেয়ে সুরক্ষিত থাকবে।
এইচআর/বিএ/পিআর