করোনা মোকাবিলায় সচেতনতার বিকল্প নেই
করোনাভাইরাসের থাবায় গোটা বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ অবরুদ্ধ। শক্তিধর এবং মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো সব চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়েও শঙ্কামুক্ত হতে পারছে না। দেশে দেশে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন সচেতনতামূলক জরুরি ব্যবস্থা। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী লকডাউনসহ নানামাত্রিক প্রতিরোধ উদ্যোগ সত্ত্বেও করোনার ছোবল বিস্তৃত হচ্ছে জ্যামিতিক হারে।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, করোনার কারণে সমগ্র মানবজাতিই আজ হুমকির মুখে। তিনি করোনাভাইরাসকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘সবচেয়ে বড় সংকট’ বলে অভিহিত করেছেন। বিশ্বে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে এ বিষয়ে আমরা কতটা সচেতন? প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ফোনে খোঁজখবর নেয়। যখন শোনে পরিবার নিয়ে কোনোভাবেই বাসার সীমানা অতিক্রম করছি না, এটি শুনে তারা রীতিমতো অবাক হয়ে যায়। এ সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞেস করলে সহজেই তাদের কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যায়, ‘আমাদের গ্রামে এগুলো আসবে না। আমরা প্রতিদিন বাজার-ঘাটে যাচ্ছি, আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের কথা শুনে বিস্মৃত হই। কেননা এখনও যদি তারা সচেতন না হয় তাহলে কবে তাদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি হবে? যদিও প্রশাসন এ বিষয়ে যথেষ্ট ভালো ভূমিকা পালন করছে কিন্তু আমরা নিজেরা যদি সচেতন না হই তাহলে কোনোভাবেই সম্ভব নয় এ মহামারির হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা।
গত ৪ এপ্রিল বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে যখন দেখছিলাম, করোনার আক্রমণকে উপেক্ষা করে কর্মস্থলে যোগদানের জন্য দলে দলে মানুষ ঢাকার পথে, এ দৃশ্য দেখে রীতিমতো আমি স্তম্ভিত হয়েছি। যেখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি চলছে। সরকারি অফিস-আদালত, গণপরিবহন বন্ধ। কাঁচাবাজার ও নিত্যপণ্যের দোকান ছাড়া বন্ধ আছে সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সরকার সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত করলেও কারখানা বন্ধের সময়সীমা বাড়ানোর কোনো ঘোষণা না আসায় ৫ এপ্রিল (রোববার) থেকে কারখানাগুলো খুলবে, এমন নির্দেশনায় ঢাকা অভিমুখে স্রোত নামে মানুষের। ঢাকায় এসে এখন এই শ্রমিকরা পড়েছেন মহাবিপদে।
গার্মেন্ট মালিকরা কেন আগে থেকে বন্ধের ঘোষণা দিলেন না তা আমাদের বোধগম্য নয়। যদিও পরবর্তীতে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার জন্য মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি। এর পাশাপাশি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে জরুরি সেবার সঙ্গে নিয়োজিতরা ছাড়া রাজধানীকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের আগমন-বহির্গমন বন্ধে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)।
আমরা লক্ষ্য করছি যে, দেশের বিভিন্ন এলাকার জনগণ করোনা নিয়ে এখনও এতটা সচেতন নন যতটা থাকা উচিত ছিল। কেননা করোনা সংক্রমণের ভয় উপেক্ষা করে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় জনসমাগম অব্যাহত রয়েছে। সশস্ত্রবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহলের মধ্যেও রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা পাকাচ্ছে অনেকেই। সরকারি নিষেধাজ্ঞা না মেনে গ্রামের হাট-বাজারে চলছে কেনাকাটা। অনেক জায়গায় ত্রাণ বিতরণের কার্যক্রমে ব্যাপক জনসমাগমের ঘটনাও ঘটছে। ঘরের বাইরে আসা এসব সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘অনেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন না। এর জন্য সামনে ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করছে।’
আমরা ক’জন এমন আছি যারা এর ভয়াবহতার কথা চিন্তা করছি? প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি মৃতের সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। মানব ইতিহাসে এমন দুর্দশা বা ক্রান্তিকালের অভিজ্ঞতা আগে কখনো ঘটেছে কিনা কারও জানা নেই। পূর্বেও পৃথিবীতে যত মহামারি হয়েছে তা বিশ্বব্যাপী এ বিস্তৃত ছিল বলে মনে হয় না। কারণ তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এমন উন্নত ছিল না, যার ফলে এ মহামারিগুলো পৃথিবীর একটা নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ ছিল, এক সাথে বিশ্বের এতটি দেশে তা কখনই বিস্তৃত হয়নি। বিশ্বযুদ্ধগুলোতেও বিশ্বকে এমন লকডাউনের মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। অথচ করোনার কারণে মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষাই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘আমাদের জন্য সামনের দিনগুলো খুবই ভয়ানক। ইউক্রেনে সম্প্রতি আক্রান্তের সংখ্যা স্বল্পমাত্রায় দেখা দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সে দেশে শত শত কবর খোঁড়া হচ্ছে আর আমরা গার্মেন্ট খুলে দিচ্ছি। এর মাধ্যমে আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। জনসাধারণের ঘরে থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কিন্তু অনেকে মানছেন না।’
বাংলাদেশের মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, ‘বিজ্ঞানের ভাষা অনুযায়ী দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সামনে বাড়বে। সম্প্রতি বিশ্বের যেসব দেশ আক্রান্ত হয়েছে, সেসব দেশে প্রথমে অল্প মানুষ সংক্রমিত হলেও পরে ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছে। এটাই করোনা ভাইরাসের চরিত্র।’
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ৩১ দফা নির্দেশনা বাস্তবসম্মত ও সময়োচিত। ঘোরতর বিপদের এই মুহূর্তে এ নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করাই হবে একজন সুনাগরিকের মৌলিক কাজ। প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাস সম্পর্কে চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ এবং এ ভাইরাস সম্পর্কিত সচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, লুকোচুরির দরকার নেই, করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।
এছাড়া দিনমজুর, শ্রমিক ও কৃষকসহ সমাজের স্বল্প আয়ের মানুষ যাতে অভুক্ত না থাকে, সে জন্য তাদের সাহায্য করার কথা উল্লেখ করে ‘সোশ্যাল সেফটিনেট কার্যক্রম’ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর ৩১ দফা নির্দেশনা খুবই সুচিন্তিত ও সময়োপযোগী। এসব নির্দেশনার সুচারু বাস্তবায়ন হলে করোনাযুদ্ধে আমাদের জয়লাভ সহজতর হবে। সংক্রমণের অপেক্ষায় থাকার কোনো সুযোগ নেই।
আসুন, আমরা সকলে দেশ ও জাতির কল্যাণের কথা ভেবে নিজ নিজ স্থান থেকে ভূমিকা রাখি, সচেতন হই, নিজে নিরাপদ থাকি এবং দেশকে নিরাপদ রাখি।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
এইচআর/বিএ/এমএস