করোনায়ও উল্টাপাল্টার উদাম দৌড়

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:০৩ এএম, ০১ এপ্রিল ২০২০

কোথাও গোলাবারুদের শব্দ না থাকলেও, হত্যা উৎসব দেখা না গেলেও, নতুন নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কারের খবর না থাকলেও, এক দেশের যুদ্ধবিমান অন্য দেশের আকাশসীমায় ঢুকে ক্ষেপণাস্ত্র না ছুড়লেও থমকে গেছে গোটা দুনিয়া। করোনা নামের এক ক্ষুদ্র আনুবীক্ষণিক ভাইরাস বিশ্বকে যুদ্ধের চেয়েও ভয়ানক অবস্থায় তলিয়ে দিয়েছে। যেখান থেকে কবে নিস্তার ঘটবে সেই নিশানা না থাকলেও, এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশে নেতিবাচকতার ছড়াছড়ি। কেউ কারও চেয়ে কম যাচ্ছেন না। কমবেশি উল্টাপাল্টা ব্যস্ততা সবখানে। তা কথাবার্তা, আচার-আচরণসহ যাবতীয় কর্মতৎপরতায়।

একদিকে সমানে দেশে ফেরা প্রবাসীদের ভিলেনের কাতারে নেয়ার চর্চা। যেন তারাই করোনার মূলহোতা। আরেকদিকে ‘স্টে হোম’ বাণী ছড়িয়ে যথেচ্চাচারের প্রতিযোগিতা। নানান খাদ্যপণ্য, ডেটল, স্যাভলনের বস্তাবোঝাই করে সব আউট অব মার্কেট করে ঘরে ওঠার দিগম্বর দৌড়। কেউ কেউ সাধ্য ও দরকারের সীমা ছাড়িয়ে করছেন-করেছেন কাণ্ডটি। পেশাদার মজুতদারদের হারিয়ে দিয়েছেন এ শ্রেণির অনেকে।

বিজ্ঞাপন

সরকার করোনাভাইরাসের তথ্য গোপন করছে বলে অভিযোগ ছোড়া হচ্ছে রাজনৈতিক বিরোধীমতসহ কোনো কোনো মহল থেকে। কিন্তু আসল তথ্যটা কী? তা জানান দিচ্ছে না কেউ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) পরিচালক, মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার প্রেসব্রিফিংয়ে একেক দিন একেক শাড়ি পরা নিয়ে কথার কচলানি চলেছে কিছুদিন। এরপর বেদনা দেখা দেয় তার ব্রিফিংয়ে দেয়া তথ্য নিয়ে। কেন তিনি নিয়মিত মৃতের হিসাব দেন না, এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আক্ষেপ অনেকের। আক্রান্তের হিসাবটাও মনমতো হয় না তাদের। ইনিয়ে-বিনিয়ে সংখ্যাটাকে মনগড়া বলার চেষ্টাও ব্যাপক।

কিন্তু সংখ্যাটা কত তা-ও জানাচ্ছেন না এই মহলটি। প্রতিদিন ‘দেশে লাখ লাখ করোনা রোগী আক্রান্ত হচ্ছে। শত শত মারা যাচ্ছে’ এ রকম তথ্য পেলে যেন তারা খুশি হন। আবার সরকারের দিক থেকে বিষয়টিকে মামুলি হিসেবে প্রচারের চেষ্টাও তেমন শোভন হচ্ছে না। সত্যিই বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র অর্ধশতের মতো হয়ে থাকলে কেন এত উতলা আয়োজন?

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

নামমাত্র কয়েকজনের মৃত্যু এবং আক্রান্তের জেরেই আতঙ্কে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, ডিপ্লোম্যাট, দূতাবাস কর্মকর্তা এবং বিদেশি নাগরিকরা পরিবার নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে? সরকারি হিসাব মতে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম। মৃত্যুহারও অনেক কম। এমনকি যারা বাংলাদেশ থেকে পালাচ্ছেন, তাদের দেশের অবস্থা বাংলাদেশের তুলনায় অত্যন্ত ভয়াবহ। তারপরও তারা ‘কম আক্রান্ত দেশ’ বাংলাদেশ ছেড়ে নিজেদের মারাত্মক আক্রান্ত দেশে চলে যাচ্ছেন কোন দুঃখে?- এসব প্রশ্ন তোলারই সুযোগ নেই। তার পরই না জবাব।

এদিকে করোনা মোকাবিলায় সাফল্য অর্জনকারী দেশগুলো কী পদক্ষেপ নিয়েছে সেই তথ্য সংগ্রহের গরজও কম। তারা প্রচুর পরিমাণে টেস্ট করেছে। সন্দেহভাজনদের কোয়ারেন্টাইনে বাধ্য করেছে। আইসোলেশনে নিয়েছে আক্রান্তদের। শুরু থেকে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের এখানে হয়েছে উল্টাকর্ম। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না করে সাধারণ ছুটি দিয়ে সবাইকে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন না করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাড়ি যেতে দেয়া হয়েছে প্রপার গাইডলাইন না দিয়ে। কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোরা তা মানছে কি-না মনিটর করা হয়নি।

অন্যদিকে তথ্য গোপনের পাশাপাশি করোনা আক্রমণ করেনি বলে ধমক দিয়ে থামিয়ে রাখার ঘটনাও যে ঘটেনি, তা নয়। এতসব দুঃসংবাদের মাঝেও ঘটনাচক্রে দুয়েকটা সুখবর ধরা দেয়নি। মানুষকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার মহতী চেষ্টার সংবাদ বরবাদ হয়ে গেছে সাইয়েমা নামের এই সরকারি কর্মকর্তার দুই গরিব বৃদ্ধকে কান ধরে ওঠবস করানোর ঘটনা।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

একটি শিল্প গ্রুপের উদ্যোগে ঢাকায় উহানের লেইশেনশান হাসপাতালের মতো করে- করোনা চিকিৎসার একটি অস্থায়ী হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ ভণ্ডুল করে দেয়ার সংবাদও এ সময়ের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের কাজে বাধা দিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর ও তার লোকজন। এ ঘটনার পর হাসপাতাল নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়।

জাতির এ ক্রান্তিকালে রাজধানীর কয়েকটি নামকরা স্কুলে শিক্ষকরা খুশিতে ক্লাস রেকর্ডিং করেছেন। এ জন্য তারা কোনো সম্মানীও দাবি করেননি। তবুও শুধু ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির লেকচার ভিডিও ধারণের জন্য ১৬ কোটি টাকার বিশাল বাজেট দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর। শিক্ষা অধিদফতরের ধান্দাবাজরা এই সুযোগে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্টুডিও ব্যবহার করেছে। যদিও কথা ছিল রেকর্ডিংয়ের জন্য শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়াধীন ব্যানাবেইসের স্টুডিও ব্যবহার করার। তাড়াতাড়ি করার অজুহাত দেখিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেয়া হয়েছে। অথচ ঢাকার কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চমৎকার স্টুডিও ছিল। এভাবে বিতর্কিত দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সরকারের কাজে যুক্ত করার ধান্দা করছে শিক্ষা অধিদফতরের কতিপয় কর্মকর্তা।

করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় ‘সংসদ টেলিভিশনে’ ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাদান শুরু করার উদ্যোগ নেয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এটুআই প্রকল্পের সহায়তায় এই সম্প্রচার কাজটি বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর। আর এই সুযোগে বিশাল বাজেট দিয়ে বসেছে অধিদফতর। টিভিতে সম্প্রচারের জন্য ক্লাসের ভিডিও ধারণেই ১৬ কোটি টাকার বাজেট চেয়েছে শিক্ষা অধিদফতর।

বিজ্ঞাপন

করোনার টালমাটাল পরিস্থিতিতে রাজশাহীর তানোর উপজেলার কামারগাঁ খাদ্যগুদাম থেকে ৬০ মেট্রিক টন ধান গায়েব করে দেয়ার খবরও দেখতে হয়েছে। এই হচ্ছে আমাদের নৈতিকতা। এসব করতে ভয় হয় না। মন কাঁপে না। বুকের বাম কোণটায় একটুও ব্যথা হয় না। জিহ্বা একটুও আড়ষ্ট হয় না। যদিও দম ফুরোলেই হয় সাড়ে তিন হাত, নইলে শ্মশান। মানুষের জন্য কাজ করছে কিছু মানুষ, আর কিছু অমানুষ ব্যস্ত মানুষের কবর তৈরিতে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/বিএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।