দৈহিক দূরত্ব কিন্তু সামাজিক একাত্ম
পশ্চিমা দুনিয়া সবসময়ই তাদের রুচি ও সংস্কৃতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় বা দিতে চায় গোটা বিশ্বের প্রতি। তারা মনে করে, তারাই সবসময় সঠিক। প্রবল ক্ষমতাই তাদের এই মনস্তত্বের নেপথ্যে কাজ করে বুঝি। আজ করোনা আক্রান্ত দুনিয়া নতুন নানা শব্দ বাক্যবিন্যাসে পরিচিত হচ্ছে। এখানেও পরাশক্তির লড়াই আছে। করোনাকবলিত চীন যখন হুবেই ও উহানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করলো তখন ব্যবহৃত হলো ‘লকডাউন’ শব্দটি। আমেরিকা, ইউরোপ তখন সোচ্চার এই বলে যে, ‘লকডাউন’ তো মহাস্বৈরাচারী শব্দ, চীনের মতো দেশই এমন শব্দ ব্যবহার করতে পারে। একটা এলাকার পুরো জনগোষ্ঠীকে লকডাউন করা যায় না, এটা মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরার স্বাধীনতার বিরোধী ইত্যাকার নানা ব্যাখ্যা।
সেই করোনা যখন আমেরিকা, ইউরোপে কড়া নাড়লো, তখন তারা খুঁজে পেতে বের করলো সমাজবিজ্ঞানে বহুল পরিচিত এক শব্দ ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং- সামাজিক দূরত্ব’। বলা হলো, করোনা থেকে বাঁচার বড় দাওয়াই ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং- সামাজিক দূরত্ব’। পশ্চিমা বিশ্বে সমাজের যে চেহারা তা’ এমনিতে বিচ্ছিন্নই। একেকজন একেকটি দ্বীপ, পরিবারের সদস্যদের দূরত্বও দৃশ্যমান। তাদের এই সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং- সামাজিক দূরত্ব’ বাক্যবিন্যাসটি বুঝে হোক না বুঝে হোক, আমাদের দেশেও গ্রহণযোগ্যতা পেল, গণমাধ্যমেও এর এখন ব্যাপক প্রচার।
কিন্তু জোর দিয়ে বলি, বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে ‘সামাজিক দূরত্ব’ কথাটি যায় না। কী শুভ সময়, কী দুর্ভোগের সময়, বাঙালির সামাজিক শক্তির যে রূপ আমরা দেখেছি তা’ আমাদের ‘দূরত্ব ‘শেখায় না, ‘একাত্ম বা নৈকট্য’ই শেখায়। সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে লাখ লাখ মানুষ ছুটিতে, পার্বনে, উৎসবে, দুর্যোগে শহর থেকে যে গ্রামপানে ছুটে যান সেটি সামাজিক সম্পর্কের টানেই। সেটি শুধু বাড়িফেরা মাত্র নয়।
নিউইয়র্ক থেকে একজন সেদেশি বন্ধু জানালেন, করোনার আগমনীতেই তার সত্তরোর্ধ্ব মা-বাবাকে পৃথক বাসায় সবকিছু সরবরাহ দিয়ে তালাবদ্ধ করে রেখে আসা হয়েছে। দুই বুড়োবুড়িই নিজেদের দেখভাল করছেন। এটা সেখানকার নির্মম বাস্তবতা হলেও আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির বিপরীত। এ কথা সত্য করোনা আমাদের ভিন্ন এক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু পাশের ফ্ল্যাটে যখন দেখি ‘দয়া করে বাসায় আসবেন না’ তখন মন বিদ্রোহ করে, বলে, এটি আমাদের সংস্কৃতি নয়।
সিডর, আইলার সময় বাদ দেই; ফিরে যাই ১৯৭১ সনের মুক্তি সংগ্রামের কঠিন সময়ের দিকে। গোটাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর তাদের দোসররা টহল দিচ্ছে। অবরুদ্ধ দেশের মানুষ জানতো, মুক্তিযুদ্ধের সাথে সামান্য সম্পর্কও তাদের জন্য মহাবিপদ ডেকে আনতে পারে। কিন্তু তাই বলে ভারতমুখী উদ্বাস্তু উন্মুল শরণার্থী দল বা মধ্যরাতে ক্লান্ত শ্রান্ত মুক্তিবাহিনীর দলকে কি আশ্রয়, আহার দেয়নি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষেরা? সেখানে কি শুধুই রাজনীতি ছিল? না, ছিল দেশপ্রেম, মানবপ্রেম আর আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির সম্মিলন। এটাই আমাদের শক্তি।
আজকের এই দুর্যোগের দিনে গরিব মানুষের জন্য খাবার আর নিজেদের তৈরি হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে মাঠে আছে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, যুব ইউনিয়ন। বেতনের টাকা দিয়ে দিচ্ছে আমাদের ক্রিকেটাররা, বিদ্যানন্দ আহার ও চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে সারাদেশে, একদিনের বেতন ও বৈশাখী ভাতা দিয়ে দিচ্ছে আমাদের সেনাবাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তারা, উহানের চেয়েও বড় হাসপাতাল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ, পনেরো কোটি টাকার মেডিকেল সরঞ্জাম আর পিপিই দিচ্ছে বেক্সিমকো, আকিজ গ্রুপ গড়ে তুলছে তিনশ শয্যার বিশেষ হাসপাতাল, গণস্বাস্থ্য তৈরি করছে স্বল্পমূল্যে টেস্টিং কিট, গাজীপুরের মেয়র তার এলাকার গণ্ডি পেরিয়ে যেখানে প্রয়োজন সেখানেই দৌড়ে যাচ্ছেন সহায়তা নিয়ে সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের সাহায্য করতে কাজে নেমেছে নানা গণমাধ্যম, তাদের সাথে যোগ দিয়েছে বিশ্বনন্দিত ক্রিকেটার সাকিবের ফাউন্ডেশন। আরেক ক্রিকেট তারকা মাশরাফি তো মাঠেই আছেন সব সহায়তা নিয়ে।
ব্র্যাক, আশা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, বুয়েট অ্যালামনাই, গার্মেন্টসের মালিকরা হাত বাড়াচ্ছেন সবটুকু সামর্থ্য নিয়ে। একজন ব্যারিস্টার তার গাড়ি এলাকার হাসপাতালের কাজে ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন, বস্তায় বসে হিরো আলম নিজ এলাকায় ত্রাণ দিচ্ছে। হাজারীবাগের বেড়িবাঁধের এক বাড়িওয়ালা ভাড়ায় থাকা নিম্ন আয়ের মানুষদের বাসাভাড়া মওকুফ করে দিয়েছেন, একজন তার নতুন কেনা ফ্ল্যাটের চাবি দিয়েছেন করোনা চিকিৎসায় তার ফ্ল্যাট ব্যবহার করার জন্য, রাজধানীর প্রধান সড়কে তিন অচেনা যুবক নিজে থেকে জীবাণুনাশক ওষুধ ছিটিয়ে দিচ্ছে গাড়িতে, রিকশায়, ভ্যানে।
সাত মসজিদ রোডের এক ছোট্ট মুদির দোকানদার তার দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়া রিকশাওয়ালাদের রিকশায় তুলে দিচ্ছে খাবার, বৃদ্ধ বাবা চোখে চশমা এঁটে ডাক্তার ছেলের পোশাক বানিয়ে দিচ্ছে, করোনায় আক্রান্ত কেউ মারা গেলে মৃতের গোসলের দায়িত্ব নিচ্ছে একজন ইমাম। বিভিন্ন হাসপাতালের ডাক্তাররা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের বাইরে নিজেরা গ্রুপ তৈরি করে ফোনের মাধ্যমে চব্বিশ ঘণ্টা রোগীদের সেবা দিচ্ছেন, এক বিশ্বমানের গবেষণাগারের কর্মীরা অন্যসব গবেষণা ফেলে নেমে পড়েছেন করোনা আক্রান্তদের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার কাজে।
আইইডিসিআরের গবেষককর্মীদের দিনরাত এখন একাকার, তারা শুধু আর চাকরির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আরও অজ্ঞাত জনের না জানা নানা উদ্যোগ চলছে মানুষকে বাঁচাতে। সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা সবচাইতে অবহেলিত জনের পাশে দাঁড়াচ্ছেন পরম মমতায়। এ দুঃসময়ে এই ভালো মানুষ, ভালো প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগগুলো চোখ ভরিয়ে দেয় জলে। আশা জাগায়, আমাদের সব শেষ হয়ে যায়নি এখনও!
এই উদ্যোগগুলো কি সামাজিক উদ্যোগ নয়? নিজেদের নির্ধারিত দায়িত্বের বাইরে গিয়ে মানুষ বাঁচাতে যে বিচ্ছিন্ন বা সম্মিলিত উদ্যোগ এটিই আমাদের সামাজিক সংস্কৃতি, আমাদের অমিত শক্তি। এ কথা সত্য, করোনা আমাদের এমন এক বাস্তবতায় ঠেলে দিয়েছে যেখান সবাইকে সবার সাথে কিছুটা দৈহিক দূরত্ব রেখেই চলতে হচ্ছে, নিজের এবং অপরের নিরাপত্তার জন্যই। এবং অবশ্যই এটা মানতে হবে।
কিন্তু এটাও সত্যি, এই দৈহিক বা শারীরিক দূরত্ব আমাদের সামাজিক নৈকট্য বা সামাজিক একাত্মতা ধ্বংস করতে পারবে না। তাই ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ নয় বরং আমরা বলি : ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং বাট সোশ্যাল অ্যাফিনিটি’; দৈহিক দূরত্ব কিন্তু সামাজিক একাত্মতা’। কারণ, আমাদের সংস্কৃতি দুর্যোগ- দুঃসময়ে সামাজিক একাত্মতারই সাক্ষ্য দেয়। এই শক্তির বলেই ‘আমরা হেলায় / নাগেরে খেলারই / নাগেরই মাথায় নাচি’।
এইচআর/বিএ/এমএস