করোনা, গুজব আর বিভ্রান্তি : ভয়ঙ্কর তিন ভাইরাস
গত ২৪ মার্চ তথ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। কমিটিতে ১৫ জন সরকারি কর্মকর্তাকে দুটি করে মোট ৩০টি বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল মনিটর করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এমনিতে আমরা জানি, টেলিভিশনে যাই দেখায় না কেন, সরকারের কেউ না কেউ অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও তা দেখছেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কমিটি গঠন করে মনিটর করার বিষয়টি বিরলই বটে। কেউ একজন আমাদের টিভি দেখছেন, বিষয়টি মন্দ নয়। অন্তত একজন দর্শক তো মিললো।
কিন্তু আপত্তিটা হলো, কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব হলো ‘বেসরকারি টিভি চ্যানেলসমূহে সম্প্রচারিত বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিষয়ে অপপ্রচার বা গুজব প্রচার করা হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করা’। আর ‘অপপ্রচার বা গুজব চিহ্নিত হলে তা বন্ধ করার জন্য সাথে সাথে মন্ত্রণালয়ের কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা’।
এই ব্যস্ততার সময়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এমন একটি কমিটি গঠনই বলে দেয় বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর ওপর তাদের আস্থা নেই। তাদের সন্দেহ টিভিগুলো অপপ্রচার বা গুজব প্রচার করতে পারে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। কারণ অতি সামান্য ব্যতিক্রম বাদ দিলে মূলধারার গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বা গুজব প্রচারের কোনো অভিযোগ নেই। বিশেষ করে জাতীয় কোনো দুর্যোগের মুহূর্তে গণমাধ্যমগুলো আরও সাবধানী ও দায়িত্বশীল থাকে। তাই তথ্য মন্ত্রণালয়ের এমন কমিটি গঠন সাংবাদিকদের জন্য অপমানজনক। তারচেয়ে বড় কথা হলো, কোনটা অপপ্রচার, কোনটা গুজব; সেটা কোন মাপকাঠিতে ঠিক করবেন সরকারি কর্মকর্তারা।
তাদের দৃষ্টিতে তো সরকারবিরোধী যেকোনো তথ্যই অপপ্রচার বা গুজব মনে হতে পারে। আমরা কেন আমাদের দায়িত্বশীলতা মাপার দায় সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে ছেড়ে দেব। ২৪ মার্চ কমিটি গঠিত হলেও তা নজরে আসে ২৬ মার্চ। অবশ্য তীব্র সমালোচনার মুখে তথ্য মন্ত্রণালয় কমিটিটি বাতিল করেছে। তবে অপমানটা আমার এখনও যায়নি। কমিটি গঠন করছে মানেই, তারা আমাদের সন্দেহ করছে। চাপের মুখে কমিটি বাতিল করেছে বটে, কিন্তু সন্দেহটা নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যায়নি। কমিটি বাতিল করলেও অনানুষ্ঠানিক মনিটরিং নিশ্চয়ই চালাচ্ছেন তারা।
মূলধারার গণমাধ্যম অপপ্রচার বা গুজব না ছড়ালেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনলাইন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুজবের কারখানা যেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়ে প্রকাশ্য প্লাটফর্মগুলো কিছুটা নিয়ন্ত্রিত বটে। কিন্তু থেমে নেই গোপন বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যমগুলো। ফেসবুকের মেসেঞ্জার বা হোয়াটসআপ মেসেজে চলছে গুজব আর আতঙ্কের অবাধ বিস্তার।
গত কয়েকদিনে আমি করোনা-সংক্রান্ত কয়েক হাজার মেসেজ পেয়েছি। প্রেরক পরিচিত এবং বিশ্বস্ত এমনগুলোই শুধু খুলেছি। সবগুলো ওপেন করা বা দেখা আসলেই সম্ভব নয়। চট্টগ্রামের রোহানকে ফোন করে চট্টগ্রাম মেডিকেলে করোনা রোগীর মৃত্যুর খবর তো অনেক পুরোনো। আমার ধারণা এই অডিও বার্তাটি পাননি, এমন কোনো লোক নেই। শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কথিত ‘রোহানের বাবা’কে গ্রেফতার করেছে। ভার্চুয়াল জগতে এমন আরও অনেক ‘রোহানের বাবা’ আছে, যাদের সবাইকে খুঁজে বের করা বা ধরা সত্যি কঠিন।
গণমাধ্যম দায়িত্বশীল। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো দায়িত্ব নেই। চাইলেই যা ইচ্ছা তাই লিখে ফেলা যায়। প্রকাশ্যে না লিখলেও ইনবক্সে চালাচালি করা যায়। স্বাভাবিক সময়ে যাই হোক, জাতীয় সংকটের সময়ে এই ধরনের গুজব আতঙ্ক ছড়ায়। আমাদের সবার সচেতনতা ছাড়া এই গুজব ছড়ানো বন্ধ করা সত্যি অসম্ভব। আপনার যে বন্ধু আপনার কাছে গুজব সংক্রান্ত কোনো কিছু পাঠাবে সাথে সাথে তাকে সতর্ক করুন, তিরস্কার করুন, সচেতন করুন।
শুধু করোনা-সংক্রান্ত গুজব নয়, অনেক আজগুবি গুজবও আছে। এই দোয়া একশো জনকে পাঠালে আপনার করোনা হবে না, এই মেসেজ ১০ জনকে পাঠালে শেখ হাসিনা সরকার আপনাকে ১০ জিবি ইন্টারনেট দেবে; এমন বার্তার অত্যাচারও সইতে হবে আপনাকে। আর আছে অসাধারণ সৃষ্টিশীল সব কৌতুক, যা এই অবরুদ্ধ সময়ে আমাদের মন ভালো করে দেয়।
তবে গুজবের সাথে আছে বিভ্রান্তি। গুজব তবু চাইলে এড়ানো যায়, বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি নেই। যেমন শুরুতে শুনলাম করোনাভাইরাস বাতাসে বেঁচে থাকে না। পরে জানা গেল, বাতাসেও বেঁচে থাকে। প্রথমে বলা হলো- সবার মাস্ক পরার দরকার নেই। শুধু যারা আক্রান্ত তারা পরবেন। এখন তো মাস্ক ছাড়া ঘর থেকে বেরুলেই পুলিশের পিটুনি খেতে হয়। এখন বলা হচ্ছে, একটি মাস্ক একবার ব্যবহার করা যাবে। প্রতিদিন মাস্ক বদলাতে হলে মৃত্যুর সময় মুখে মাস্ক থাকবে, কিন্তু পেটে খাবার থাকবে না।
শুরুতে শুনলাম, গরমে করোনা বাঁচে না। এখন শুনি করোনার কোনো শীত-গরম নাই। একজন বলছেন, বাইরে থেকে ফিরেই হাত ধুয়ে ফেললেই মুক্তি। আবার আরেকজন বলছেন, বারবার হাত ধোয়ার চেয়ে হাতে গ্লাভস পরে নিলেই হয়। আবার এও বলা হচ্ছে, বারবার ব্যবহার করা গ্লাভস ভাইরাসের বাহক হতে পারে। এখন আমি কী করবো, গ্লাভস পরবো না পরবো না, মাস্ক পরবো না পরবো না?
পিপিই নিয়েও বিভ্রান্তির শেষ নেই। বলা হচ্ছে, পিপিই ছাড়া কোনো ডাক্তার চিকিৎসা দেবেন না। আবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, পিপিই’র অত দরকার নেই। এমনও বলা হচ্ছে, একটি পিপিই একবারের বেশি ব্যবহার করা যাবে না। তাই যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশের সব ডাক্তারকে প্রতিদিন পিপিই সরবরাহ করবে এমন সাধ্য কার আছে। শুধু পিপিই বানাতেই ফতুর হয়ে যাবে বাংলাদেশ।
মূলধারার গণমাধ্যমে দেখি করোনাভাইরাসের টিকা আর ওষুধ আবিষ্কারের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু ফেসবুকে একাধিকবার দেখেছি টিকা আবিষ্কারের খবর। সেটি যে ভুয়া তা বলে না দিলেও চলবে। এমন অসংখ্য ভুয়া খবরে সয়লাব ফেসবুকের নিউজফিড আর উপচেপড়া ইনবক্স। করোনা রোগীর প্রেসক্রিপশন মিলছে ফেসবুকে- একদম ওষুধের ডোজ, কোম্পানির নামসহ।
কোথাও গোমূত্রে, কোথাও থানকুনি পাতায় সমাধান খুঁজছেন কেউ কেউ। যে থানকুনি পাতা কেউ ছুঁয়েও দেখতো না, সেই থানকুনি পাতার এখন দারুণ কদর। ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, এটা জানার পর লেবুর হালি একশো টাকা ছুঁয়েছিল। কমলা, মাল্টারও অনেক কদর এখন। দোকানে পাওয়া যায় না সিভিট। প্যারাসিটামল, ফেনাডিন, ইনহেলারও খালি করে কিনে নিয়েছে লোকে। কালিজিরা, রসুন, আদা কত কত অব্যর্থ ওষুধ যে পাওয়া যায় ফেসবুকে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
সেদিন একজন মজা করে বলছিল, কয়েকজন করোলা চাষী যদি চালাকি করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, করোলায় করোনা সারে; তাহলে দেখা যাবে করোলার দাম বেড়ে যাচ্ছে। করোনার দোয়াও পাওয়া যায় ফেসবুকে।
উন্নত বিশ্বে যতটা ভয়ঙ্করভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে, বাংলাদেশে এখনও সেভাবে ছড়াতে পারেনি। আশা করি আমাদের সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আমরা করোনার বিস্তার ঠেকাতে পারবো। কিন্তু করোনা ছড়াতে না পারলেও গুজব, আতঙ্ক আর বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে ব্যাপকভাবে। এই গুজব আর বিভ্রান্তির ভাইরাসও কম বিপজ্জনক নয়। ফেসবুকে এত তথ্য আর এত ‘বিশেষজ্ঞ’ মত পাই, আমার মাথা ঘোরায়।
কোনটা করবো, কোনটা করবো না বুঝতে পারি না। বেসরকারি টেলিভিশনের অপপ্রচার আর গুজবের পেছনে না দৌড়ে সরকার যদি সত্যি সত্যি গুজব আর বিভ্রান্তির ভাইরাস ঠেকানোর চেষ্টা করে তাহলে মানুষ একটু স্বস্তি পেতে পারে। আর অপপ্রচার, গুজব, আতঙ্ক আর বিভ্রান্তি ছড়ানো বন্ধের একমাত্র উপায় হলো তথ্যের অবাধপ্রবাহ নিশ্চিত করা। সরকার মূলধারার গণমাধ্যমকে সন্দেহ না করে, তাদের পাশে নিয়েই সেই কাজটি করতে পারে।
এইচআর/বিএ/পিআর