করোনা : স্যালুট উগান্ডা
কথায় কথায় উগান্ডাকে তাচ্ছিল্য করার দিন শেষ। করোনা মোকাবিলায় গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে দেশটি। যা বহু দেশের জন্য স্বপ্ন বা কল্পনার। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বড় বড় দেশ করোনা মোকাবিলা প্রশ্নে উগান্ডাকে অনুসরণ-অনুকরণ করতে পারে। শঙ্কা থাকার পরও উগান্ডায় একজনও আক্রান্ত হয়নি। পুরো বিশ্ব যখন করোনায় মৃত্যু আতঙ্কে উগান্ডায় গান্ডুরা তখন এই খুশিতে আতশবাজি ফুটাচ্ছে। এ অসম্ভব কীভাবে সম্ভব হলো আমাদের হাসিঠাট্টার প্রতীক রাষ্ট্র উগান্ডায়?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আভাস দেয়ার পর একটুও দেরি করেনি উগান্ডা। চীনের উহানে প্রথম করোনার অস্তিত্ব ধরা পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে অ্যাকশনে নামেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইয়োভেরি মুসেভেনি। দ্রুত সাফ-সতুর করে ফেলা হয় দেশের পথঘাট, হাসপাতালসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। এক মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে দেন সামাজিক-ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় সব ধরনের জমায়েত। বন্ধ করে দেয়া হয় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। দেশের সীমান্ত, বিমানবন্দর সিল করে ফেলা হয়। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় নিজ দেশের ও অন্যান্য ১৬ দেশের নাগরিকদের ওপর। টিভি পর্দায় ভেসে ওঠেন উগান্ডার প্রেসিডেন্ট মুসেভেনি।
তাদের উপকারের জন্যই এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে উগান্ডাবাসীকে আহ্বান জানান, ঘরে বসেই প্রার্থনা করতে। ধর্মীয় নেতাদের টিভি ও রেডিও স্টেশন ব্যবহার করে ধর্ম প্রচারের সুযোগ রাখা হয়। বলা হয় যেসব যুগলের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত তর সইবে না তারা এ সময়ের মধ্যে বিয়ের সুযোগ পাবে। তবে, সেটা একেবারে অল্প আয়োজনে। বর-কনে দু’পক্ষে মানুষ থাকতে পারবে সর্বোচ্চ ১০ জন। মৃতদের দাফনের ক্ষেত্রেও একই আদেশ কার্যকর থাকবে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে তার দাফনের দায়িত্ব নেবে সরকার। এছাড়া, মানুষের চলাচল সীমিত করাসহ প্রতিটি বাসস্টপে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়। গান্ডু দেশের নাগরিকরা মেনে চলেছে সব নিষেধাজ্ঞাসহ নিয়ম-কানুন। ফলও মিলেছে। করোনা আক্রমণ করতে পারেনি উগান্ডার কাউকে।
তাচ্ছিল্যের প্রশ্নে উগান্ডা বিভিন্ন দেশেই পরিচিত। অবজ্ঞা-ইয়ার্কির প্রতীক হিসেবে আমাদেরও দুঃখভারাক্রান্ত অনেক রসিকতায় মিশে থাকে উগান্ডার নাম। স্বাধীনতা প্রশ্নে তারা আমাদের সামান্য সিনিয়র। বাংলাদেশের প্রায় ৯ বছর আগে স্বাধীন হয় উগান্ডা। এত দীর্ঘ সময় পেরিয়েও উগান্ডার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মোটেই সবল হতে পারেনি। আন্তর্জাতিক পরিসরে উগান্ডার শাসকদের বলা হয় ‘হাইব্রিড রেজিম’। বাংলা তরজমায় হাইব্রিড রেজিমের কোনো শব্দ পাওয়া যায় না। গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে কর্তৃত্ববাদ কায়েম হওয়া দেশকে বিশ্বসম্প্রদায় ‘হাইব্রিড রেজিম’ নামে ডাকে।
এসব দেশে রাজনৈতিক জুলুমে বিরোধীদের বিপন্ন থাকতে হয়। ৭৫ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট মুসেভেনি দেশের প্রধান, সরকারেরও প্রধান। প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ ও বয়সের শর্ত দুটোই তুলে নিয়েছেন মুসেভেনি। ২০১৭ সালের আগে উগান্ডায় ৭৫-এর বেশি বয়সীদের প্রেসিডেন্ট হতে বাধা ছিল। মুসেভেনি পার্লামেন্টকে দিয়ে সেটা বাতিল করিয়ে নিয়েছেন। একইভাবে এক ব্যক্তি কয় দফা প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন, সেই আইনও বদলে নেয়া হয়েছে।
জনগণকে ভয়াবহ বিমারিমুক্ত রাখার ইতিহাস গড়েছেন মুসেভেনি। তার, তার সরকার বা পরিবারের সমালোচনা সেখানে সরাসরি শাস্তিযোগ্য। এ ধরনের অপরাধ করলে ধরে নিয়ে পিটিয়ে বেদম টর্চার করা হয়। দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদে দিশেহারা জাতিকে করোনামুক্ত করে স্যালুট পাচ্ছেন মুসেভেনি। জনগণকে রক্ষা ও নিয়মতান্ত্রিকতায় এনে যথাসম্ভব করোনা মোকাবিলায় দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে চীনের পার্শ্ববর্তী দেশ রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানেও।
তাদের এ কৃতিত্ব বিশ্বব্যাপী এ সময়ের অন্যতম আলোচনার বিষয়। এমন সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে সময়মতো জরুরি পদক্ষেপ নিতে পারা। চীনের উহানে করোনাভাইরাস ছড়ানোর খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং সীমান্তে স্ক্রিনিং, সীমান্তের ভেতর থাকা সবাইকে দ্রুত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছে। রাশিয়া তার গোটা সীমান্ত বন্ধ করতে একটুও সময় নেয়নি। চীনে করোনাভাইরাসের বিস্তারের বিষয়টি ৩১ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নজরে এলেও তখন এ সম্পর্কে তথ্য ছিল একেবারে সামান্য। এরপরও বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় উগান্ডা।
তিন দিনের মাথায় সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও হংকং তাদের সীমান্তে স্ক্রিনিং শুরু করে উহান থেকে আসা লোকজনকে পরীক্ষা করতে শুরু করে দেয় তাইওয়ান। পরে করোনা সম্পর্কে যত তথ্য আসতে থাকে, তত বেশি সতর্ক হতে থাকে এ দেশগুলোর সরকার। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনার পাশাপাশি আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন কার্যক্রম চালায়। মেডিসিন না থাকলেও তারা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির তথ্য সংরক্ষণ, উপদ্রুত এলাকা সম্পর্কে তথ্য সহজপ্রাপ্য করা, কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের অবস্থান নিশ্চিতে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে। এসব পদক্ষেপ নেয়ার পারঙ্গমতায় সবাইকে টপকে সর্বোচ্চ সাফল্য তুলে নিয়েছে উগান্ডা।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
এইচআর/বিএ/জেআইএম