করোনা নিয়ন্ত্রণে উহান মডেল ও অন্যান্য কথা

ডা. এম এ হাসান
ডা. এম এ হাসান ডা. এম এ হাসান , চিকিৎসক
প্রকাশিত: ১২:২৯ পিএম, ২৩ মার্চ ২০২০

সারাবিশ্বে যখন করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় ১৪ হাজার ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে এবং ১৮৫ দেশে যখন পৌনে সাড় তিন লাখ ব্যক্তি এতে আক্রান্ত হয়েছে, তখন এই প্যানডেমিক পরিস্থিতির পরিণতি অতি স্পষ্ট। এমন মুহূর্তে বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ২৪ জন এবং মৃত্যু দুইজন হলেও এর বিস্তার জানতে আমাদের আরও দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সরকারে যারা উচ্চপর্যায়ে আছেন তারা যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে কাজটি করতে পারছেন না এবং এর ভয়াবহ প্রকৃতির বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হচ্ছেন না।

বিদেশফেরত এবং তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের ট্র্যাকিং, টেস্ট, আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টাইনের দায়িত্ব যাদের দেয়া হয়েছিল তারা যথাযথ যোগ্যতার সাথে তা করতে পারেনি। এতে আগামী ১৪ দিন পর যদি দেশে করোনার সংক্রমণ এবং করোনার মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায় বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিদেশফেরতদের দেশে আনার কারণে দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার দায়দায়িত্ব মুখ্য করোনা নিয়ন্ত্রক সংস্থার। যারা যথাযথ টেস্ট, স্ক্রিনিং বা কোয়ারেন্টাইন ছাড়া বিদেশফেরতদের নির্বিচারে জাতীয় বিমানে এনে ওই বিমানের সকল আরোহী ও ক্রুসহ দেশের বিমানবন্দরের কর্মী ও গণমানুষকে ঝুঁকিতে ফেলল তাদের বিশাল দায়টি বুঝতে হবে।

প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে করোনাভাইরাস নামক আরএএন ভাইরাস যা কোল্ড ভাইরাস নামে পরিচিত তা অত্যন্ত ছোঁয়াচে; এটি যেমন হাঁচি-কাশির মাধ্যমে মাইক্রোড্রপলেট আকারে ছড়ায়, তেমনি রোগীর ব্যবহার্য, পরিবেশে বিদ্যমান কাপড়, প্লাস্টিক, ধাতব ও অন্যান্য ফোমাইটের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। মাইক্রোড্রপলেট আকারে বাতাসে ভাসমান ভাইরাস প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা জীবিত থাকলেও ধাতব ও প্লাস্টিকসহ অন্যান্য ফোমাইটে আঠার মতো লেগে তা তিনদিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। এ কারণে এটি প্রতিরোধে বহুমুখী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ যাচাই করে দ্রুত পরীক্ষায় এনে কোয়ারেন্টাইনে আনা যেমন অবশ্য করণীয় তেমনি আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা প্রতিটি ব্যক্তি, বস্তুসহ তার পরিপার্শ্বের একটি মূল্যায়ন প্রয়োজন। সংস্পর্শে আসা মানুষগুলোর পরীক্ষাসহ তাদের আইসোলেশন এবং তাদের পারিপার্শ্বিক ডিজইনফেকশন প্রক্রিয়া অতি অপরিহার্য।

এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, ৬০% অ্যালকোহলের মতো সাবান ও ক্লোরিন দ্রবণ এই ভাইরাস মেরে ফেলতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে প্রতিটি ফোমাইটকে বা রোগীর সংস্পর্শে আসা বস্তুকে চার মিনিট ওই দ্রবণের সাথে সংযুক্ত রাখতে হবে। ব্যবহৃত কাপড়গুলো সাবান দিয়ে সিদ্ধ করে ভাইরাসগুলো মেরে ফেলা যেতে পারে। দরজার হাতল, পানির কলের নব, টয়লেট ও গণপরিবহনের আসন ও হাতলগুলো ডিজইনফেক্ট করা অতি জরুরি। এর জন্য মাস্ক, ফিউমিগেশন; কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউভি রেডিয়েশন বা কোমল এক্সরে কার্যকর হতে পারে। তামার পাতের শিল্ড লাগানো হিটার ভাইরাস কমাতে সাহায্য করে- এটা আমি ২০০২-এ সার্স নিয়ে কাজ করার সময় দেখেছি। তাপমাত্রা ৬০-৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হলে ভাইরাসের মৃত্যু হবে। ৪৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে এটা নির্জীব হবে এবং সংখ্যায় কমবে।

সব মিলিয়ে ব্যাপক সংক্রমণ রোধে সকল ধরনের গণজমায়েত নিষিদ্ধ করা উচিত এখনই। সমাবেশ, গণপাঠদান থেকে শুরু করে নামাজের জামাত সব কিছুই নিষেধের আওতায় আনতে হবে এখনই। সারাবিশ্বে যে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স ও আইসোলেশনের কথা বলা হয়েছে তা এখনই, আজ থেকেই দেশে কার্যকর করা উচিত।

এই ভাইরাসের জিনোমিক সিকোয়েন্সিংয়ের আলোকে কিছু ওষুধের কথাও ভাবা প্রয়োজন। জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যে কেউই এই ওষুধের ভ্যাকসিন তৈরি করুক না কেন ছয় মাসের আগে এমন ভ্যাকসিন হাতে আসার সম্ভাবনা একেবারে নেই।

এ প্রেক্ষিতে সার্স ও ফ্লু চিকিৎসায় যে ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তার কিছু কিছু ওষুধ করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের ওপর ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় পরামর্শ মতো ফ্যাভিপিরাভির দিয়ে রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা শুরু করে প্রতিরোধ বাড়াবার জন্য বিটাকাপ্পা ইনহিবিটরগুলো বিশেষ করে সেলিনিয়াম ও জিঙ্কের ব্যাপক ব্যবহার প্রয়োজন। জিঙ্ক ডায়ারিয়া ও নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হার কমিয়ে আনে। এক্ষেত্রে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন যা এইডস প্রতিরোধ সিডিসিকে একসময় ব্যবহার করতে বলেছিলাম যা কি-না রিউমটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগে ইম্যুউন মডুলেটের হিসেবে ব্যবহার করা হয় তা করোনাভাইরাস সংক্রমণে প্রয়োগ করতে বলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বয়স বিবেচনা করে নির্বাচিত ক্ষেত্রে চোখের রেটিনার সমস্যাটি বিবেচনায় এনে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ঢালাওভাবে ব্যবহার করা কখনও নয়। যে বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি বাতরোগে ভুগছেন ও ইম্যুইনোডিফেসিয়েন্সিতে ভুগছেন তাদের জন্য ইন্টারফেরন এবং হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন কিছু কাজে আসতে পারে। এ-সংক্রান্ত সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।

সার্বিকভাবে আইসোলেশন ও টেস্টের কোনো বিকল্প নেই। করোনা টেস্টকিট হাতে না আসা পর্যন্ত ইনফ্লুয়েঞ্জার টেস্ট করে এক্সক্লুশন পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তের কাছে আসা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জার ওষুধগুলো এবং কিছু ভাইরিসাইডাল কাজে আসতে পারে। আমাদের হাতে এমন কিছু ওষুধ রয়েছে। ব্যাপকভাবে ফ্লু ভ্যাকসিন দেয়া প্রয়োজন। এটা ফ্লুজনিত মৃত্যু কমিয়ে আনবে। চিকিৎসক, নার্স ও জনগণের ব্যবহারের জন্য মাস্ক ও টোটাল প্রটেকশন পিপিই নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর অভাবে ২০ জন আক্রান্তের চিকিৎসায় ৭ জন চিকিৎসক করোনা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে ডাক্তারের ঝুঁকির হার ১:৩। এটা অনেক বড় ঝুঁকি। এ ঋণ কীভাবে পরিশোধিত হয়! ডাক্তাদের প্রতি মানবিক হওয়া অতি প্রয়োজন।

এসব ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন প্রচলিত মাস্ক যার ভেতরের ফুটোগুলো দুই মাইক্রোনের বেশি বা যেগুলো এন-৯৫ নয় তার ব্যবহার কোনো সুফল বয়ে আনবে না। এটি পরিধানের পদ্ধতি রয়েছে। মাস্কের সাথে সাথে গ্লাভস ও চোখে চশমা পরা প্রয়োজন। ডাক্তাদের প্রটেকটিভ গাউন, টুপি, জুতা, চশমা অত্যাবশ্যক। প্রতিটি হাসপাতাসহ রোগীর আস্তানা, গণসমাবেশের স্থানগুলো ও বিমানসহ সকল যানবাহন ব্যাপকভাবে ফিউমিগেশন করা প্রয়োজন এবং কিছুক্ষণ পর পর জীবাণুনাশক দিয়ে মুছে ফেলা প্রয়োজন। গণসমাবেশের স্থানগুলোতে ডিসইনফেকটিংয়ের চেম্বার তৈরি করা যেতে পারে। হাসপাতাল, ডাক্তাদের চেম্বার ও করোনার ছোঁয়া পাওয়া স্থানগুলোতে তামার শিল্ডযুক্ত হিটার ও ইউভি লাইটের সহায়তায় ভাইরাসের জন্য অসহনীয় পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। কেমিক্যালস ও ফিউমিগেশন তো আপন স্থানে রয়েছে। বাড়িঘর, পরিধেয় বস্ত্র এবং বিছানাগুলো কড়া রোদে দেয়া প্রয়োজন। যা কিছু ধৌত করা সম্ভব তা সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলা প্রয়োজন। ক্লোরিন দ্রবণ না পেলে এক চামচ ব্লিচিং পাউডার, এক লিটার সাবান ও ফিটকিরি দ্রবণে মিশিয়ে তা ডিজইনফেকশন কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এটি ত্বকের জন্য নয়। এসব কাজে গ্লাভস পরতে হবে।

করোনা শনাক্তে কিট তৈরি করে গণস্বাস্থ্য ১৫ দিনের মধ্যে তা হাজির করবে- এটি একটি সুখবর। ব্যাপক টেস্টের জন্য কিট হাজির করা এখনই সরকারের আশু দায়িত্ব। অধিকতর আক্রান্ত দেশ থেকে ফেরত আসা সকল ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়ে, এ যাবত আসা বিদেশফেরত এবং তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা প্রয়োজন এখনই। সর্বোপরি আতঙ্ক, অজ্ঞতা, নির্বোধ বাচালতা পরিহার করে এই মহাদুর্যোগের নানামুখী আঘাত, জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এবং আর্থিক দুর্যোগ বিবেচনায় এনে মোকাবিলায় সকল শক্তি ও মেধা প্রয়োগ করতে হবে। আসুন চীনের উহান প্রতিরোধ মডেলটি আমরা অনুসরণ করি।

লেখক : আহ্বায়ক, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি
সভাপতি ও প্রধান বৈজ্ঞানিক
অ্যালার্জি অ্যাজমা অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইনিস্টিটিউট।
২০০২ সালে সার্স ও এইডস রোধে হংকং সরকার এবং এনআইএআইডির সহায়ক গবেষক ছিলেন।

এইচআর/বিএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।